সৌরজগতের পৃথিবী নামের একমাত্র নীল গ্রহের বয়স ৪.৫ বিলিয়ন বা সাড়ে চার শ কোটি বছর। এ পর্যন্ত প্রাচীনতম যে শিলার খোঁজ পাওয়া গেছে, তার বয়স মাত্র ৪ বিলিয়ন বা চারশ কোটি বছর।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের অ্যাস্ট্রোবায়োলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তন্তু বা সুতার মতো কিছু জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এ জীবাশ্মগুলোকে অণুজীবের জীবাশ্ম বলে মনে করা হচ্ছে। এসব অণুজীব বিশ্বের বুকে বিচরণ করেছে আজ থেকে ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে।
তন্তুর মতো এই বস্তুকে হয়তো সূর্যকিরণ থেকে শক্তি সংগ্রহ করার কাজে ব্যবহার করা হতো। গ্রিনল্যান্ডের প্রাচীন কিছু শিলায় এর চেয়েও প্রাচীন জীবনের আলামত পাওয়া গেছে। এতে পাওয়া গেছে ৩.৭ বিলিয়ন বছরের পুরোনো সায়ানোব্যাকটেরিয়ার বসতি। এই ব্যাকটেরিয়া স্ট্রোমাটোলাইটিস নামের স্তর গড়ে তুলেছে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানীর দাবি, এর চেয়েও প্রাচীন জীবনের ছাপ পাওয়া গেছে। গ্রিনল্যান্ডের আকিলা দ্বীপে। ৩.৮ বিলিয়ন বা ৩৮০ কোটি বছরের পুরোনো শিলায় এ ছাপ পাওয়া গেছে। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নেচার সাময়িকীতে প্রথম এ গবেষণার খবর প্রকাশিত হয়।
খবরে বলা হয়, শিলাটির আইসোটোপসে রহস্যময় অণুজীবের বিপাকীয় ক্রিয়ার প্রমাণ মিলেছে। এই আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই চলছে গরম গরম বিতর্ক। এটিই জীবনের আদিমতম আলামত কি না, তা নিয়েই তর্ক-বিতর্ক।
সম্প্রতি নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা কানাডাতে কিছু আণুবীক্ষণিক জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন। এসব শিলাভূত অণুজীব পৃথিবীতে বিচরণ করেছে ৩.৭৭ বিলিয়ন থেকে ৪.২৯ বিলিয়ন বছর আগে। এ দাবি করার মধ্য দিয়ে আরেকটি ঘটনা ঘটল।
তা হলো পৃথিবীতে মহাসাগর সৃষ্টির প্রায় পরপরই জীবনের উদ্ভব ঘটেছে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হলো। তন্তুর মতো জীবাশ্মে জীবন শুরু করার মতো রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে। তবে এসব রাসায়নিক উপাদান সত্যিই যে জীবনের বিকাশ ঘটিয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার সম্ভব নয়, বলেন এ গবেষণায় জড়িত বিজ্ঞানীরা।
এ ছাড়া আরও একটা বিষয়ও আছে। প্রাচীনতম শিলায় জীবাশ্ম পাওয়া মানেই এই নয় যে জীবাশ্মরা আদিমতম। তুলনামূলকভাবে নবপর্যায়ের জীব থেকে নির্গত তরল উপাদান প্রাচীনতম শিলার ফাটল দিয়ে ঢুকে জীবাশ্ম বনে যেতে পারেই। জীবাশ্মটির বয়স বের করতে গবেষকেরা আশ্রয় নেন সামারিয়াম-নিউডাইমিয়াম তারিখ নির্ণয়পদ্ধতিতে।
ধারণা, এ প্রক্রিয়ায় জীবাশ্মটির বয়স সর্বোচ্চ ৪.২৯ বিলিয়ন বছর হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় রেয়ার-আর্থ নামে পরিচিত একটি বিরল ধাতুর অবক্ষয় ঘটে অন্য ধাতুতে রূপান্তরের সময়কে হিসাব করা হয়।
তবে এতেও আরেকটি বিপত্তি ঘটতে পারে। শিলার প্রকৃতি বয়স নয় বরং ধরা পড়তে পারে লাভা বা তরল শিলা পর্যায়ে থাকার সময়টি। এ সমস্যাকে আমলে নেওয়া হয়েছে। এবারে পৃথিবীর আদিমতম শিলার দাবির সত্যতা বের করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
আদি শিলায় জীবনের ইঙ্গিতবহ আলামত নিয়ে এবারে একটি প্রশ্ন তোলেন লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রসায়নবিদ এলিজাবেথ বেল। বহির্জগতে বুদ্ধিমান জীবনের অন্বেষণ-সংক্রান্ত আলোচনায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এ প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, আদিতম জীবনের সূচনার যে সময় পাচ্ছি, তা কী নেহাৎ ঘটনাক্রমে ঘটছে নাকি আমাদের গ্রহটির প্রাচীনতম শিলা বিলীন হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আদিমতম জীবনের আলামত মুছে গেছে?
শিলায় আলামত জমতে শুরু করার বা রেকর্ড হওয়ার আগের কালকে হেইডন বা হাদিয়ান বলা হয়। বিশ্বজগতের একটি চরম প্রতিকূল পরিবেশ তখন বিরাজ করছিল। গ্রহাণু এবং উল্কামণ্ডলীর আঘাত হানছিল পৃথিবীর বুকে। বেল এবং সহকর্মীরা মনে করেন,
চরম এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও জীবনের বিকাশ ঘটার মতো প্রমাণাদি থাকতে পারে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে এই গবেষণা দলটি ৪.১ বিলিয়ন বছরের পুরোনো জিরকনের স্ফটিকে কার্বনের একটি রূপ গ্রাফাইট খুঁজে পায়।
প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সে প্রকাশিত নিবন্ধে এ গবেষণা দলটি জানায়, গ্রাফাইট আইসোটোপের আনুপাতিক হার থেকে মনে হচ্ছে গ্রাফাইটটি কোনো জৈব উৎস থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
বেল আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে নানা সংশয় আছে এবং তারও পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে। উল্কামণ্ডলীর আঘাতে তৈরি পরিবেশ বা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারণে কার্বনের এমন অদ্ভুত আনুপাতিক হার তৈরি হয়ে থাকতে পারে। কাজেই আইসোটোপের উপস্থিতিই কেবলমাত্র জীবনের নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে না।
২০১৫-এর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হওয়ার পরপর এমন বিরলজাতীয় কার্বন আরও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এগুলোর বিশ্লেষণে তৎপর হবেন বলেই স্বাভাবিকভাবে আশা করা যায়।
এক সাক্ষাৎকারে বেল বলেন, হাদিয়ান যুগ সম্পর্কে যা জানতে পারি, তা হলো আদিমতম সে যুগেও পৃথিবীতে তরল পানি ছিল। মহাদেশসদৃশ ভূত্বক গ্রানাইটও থাকতে পারে। তবে বিষয়টি বিতর্কিত। সে সময় যদি কোনো জীবন থাকত তার প্রকৃতি কী হবে, সে কথা বলেন বেল।
তিনি জানান, তা হবে ঝিল্লিহীন নিউক্লিয়াস বা সেল অর্গানেলহীন এককোষী জীব প্রোক্যারিওট। দেহরক্ষা বা জীবন ধারণের জন্য চাই পুষ্টি। সে পুষ্টি কোথা থেকে পেত, সে কথাও তুলে ধরেন বেল, ফসফরাসের মতো খনিজ উৎস থেকে পুষ্টি জোগাড় করত এই এককোষীরা।
পৃথিবীর আদিতম জীবনের খোঁজ করতে হলে ভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে। এই পদ্ধতিতে সাগর তলের উষ্ণপানির প্রস্রবণ উৎস বা হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে তালাশ চালাতে হবে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের জুনে নেচার মাইক্রোবায়োলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রোক্যারিওটগুলোকে বিশ্লেষণ করছেন গবেষকেরা।
এ জাতীয় এককোষী জীবের ক্ষেত্রে অভিন্ন আমিষ বা প্রোটিন এবং জিনের হদিস বের করতে এ বিশ্লেষণ চলছে। শেষ সর্বজনীন অভিন্ন পূর্বপুরুষ বা লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর। সংক্ষেপে এলইউসিএ বা লুকার অবশিষ্টাংশ বের করার লক্ষ্যে এই খতিয়ে দেখার তৎপরতা চলছে। আজকের যুগে পৃথিবীজুড়ে জীবনের যে কলকাকলি দেখা যাচ্ছে, তার যাত্রা হয়তো এখান থেকেই সূচনা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা যেসব খুদে জীব নিয়ে গবেষণা-সমীক্ষা চালিয়েছেন, তাদের সবার মধ্যে ৩৫৫টি আমিষ বা প্রোটিন পেয়েছেন। এই তথ্যকে ভিত্তি করে প্রথম জীবনের স্বরূপ কী ছিল তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তারা ধারণা করছেন, আদিমতম জীবন অক্সিজেনহীন উষ্ণ প্রস্রবণের কাছাকাছি হয়ত থাকত।
যদি এ ধারণা সত্য হয়, তাহলে প্রথম জীবনের স্বরূপের সাথে উষ্ণ প্রস্রবণের চারপাশে বসবাসকারী খুদে অণুজীবের মিল পাওয়া যাবে।
এসডব্লিউএসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ