ভূত্বক, তার নিচে ম্যান্টেল এবং তার অভ্যন্তরে পৃথিবীর কেন্দ্রক। সেটিও আবার দুটি ভাগে বিভক্ত। পৃথিবীর এই অভ্যন্তরীণ গঠনের সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তক এমনটাই শিখিয়েছে আমাদের। এমনকি গবেষণার ক্ষেত্রেও এতদিন ধরে নেওয়া হত, পৃথিবীর বাইরের অংশটি কঠিন এবং কেন্দ্রে আবর্তন করে চলেছে গলিত-উত্তপ্ত লৌহ আয়ন।
তবে চিরাচরিত এই মডেলকেই এবার চ্যালেঞ্জ জানালেন ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কুল অফ আর্থ সায়েন্সেসের গবেষকরা। পৃথিবীর গলিত কেন্দ্রকের মধ্যেই নাকি ভেসে বেড়াচ্ছে প্রকাণ্ড একটি কঠিন লৌহগোলক।
সম্প্রতি, নেচার কমিউনিকেশন বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এই বিশেষ গবেষণাপত্রটি। ইতিমধ্যেই যা সাড়া ফেলে দিয়েছে বিজ্ঞানীমহলে।
কারণ এই গবেষণার ফলাফল সত্যি হলে, চারটির বদলে পাঁচটি স্তর রয়েছে পৃথিবীতে। অথচ, ভূতাত্ত্বিক গণনার ক্ষেত্রে এতদিন গাণিতিক দিক থেকে ৪টি স্তরই ধরে এসেছি আমরা।
কাজেই এই গবেষণা বদলে দিতে পারে গোটা ভূ-বিদ্যাকে। কিন্তু কীভাবে আবিষ্কৃত হল পৃথিবীর কেন্দ্রে লুকিয়ে থাকা এই কঠিন স্তরটি?
সিসমিক তরঙ্গ বা ভূমিকম্পন নিয়েই গবেষণা করছিলেন ক্যানবেরার গবেষকরা। সে-সময় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েই তাদের চোখে পড়ে এক আশ্চর্য ঘটনা।
সাধারণত, ভূমিকম্পের তরঙ্গ বা সিসমিক তরঙ্গ পৃথিবীর অভ্যন্তরের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়, তার গতিবেগ পরিবর্তন করে। অনেকটা শব্দের মতোই।
যেমন গ্যাসীয় পদার্থের থেকে তরলে শব্দের গতি বেশি, কঠিন পদার্থে তার চেয়েও বেশি—তেমনই পৃথিবীর ঘনত্বের ওপর নির্ভর করেই সিসমিক তরঙ্গের গতি বৃদ্ধি বা হ্রাস পায় পৃথিবীর অভ্যন্তরে। ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করতে গিয়ে, এই একই ঘটনা লক্ষ করেছিলেন ক্যানবেরার গবেষকরা।
পৃথিবীর কেন্দ্রকের অর্থাৎ ‘কোর’-এর একটি বিশেষ অঞ্চলে সিসমিক তরঙ্গের গতিবেগ বেড়ে যায় হঠাৎ করেই। অর্থাৎ, গলিত কেন্দ্রকের তুলনায় তার ঘনত্ব অনেকটাই বেশি। সম্ভবত সেটি কঠিন গোলক।
৬৪৪ কিলোমিটার বা ৪০০ মাইল প্রশস্ত এই গোলকটি নির্মিত মূলত লোহা দিয়েই। তাছাড়াও তার বাইরের অংশে স্বল্পমাত্রায় রয়েছে নিকেল ও অন্যান্য ধাতু। এমনটাই অনুমান গবেষকদের।
যদিও এই মডেল নিয়ে আরও পরীক্ষানিরীক্ষা করার বিস্তর প্রয়োজন আছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। যদিও পৃথিবীর কেন্দ্র গিয়ে, তা চাক্ষুষ করার সুযোগ নেই মানুষের কাছে।
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ বিবর্তন, জন্মরহস্য এবং ভূতাত্ত্বিক নানান ঘটনাবলির রহস্য তো বটেই, এই গবেষণা সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন বুঝতেও সাহায্য করবে এই যুগান্তকারী গবেষণা। সবমিলিয়ে এই গবেষণাপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।
এখানে একটি প্রসঙ্গে বলা উচিত। আর এই প্রসঙ্গটা শুরু করা উচিত একটি প্রশ্ন দিয়ে। আর সেটা হল, কিভাবে আমরা পৃথিবীর কেন্দ্র সম্পর্কে জানব? সেখানে রয়েছে অতি উচ্চ তাপমাত্রা, অত্যন্ত বেশি চাপ এবং প্রচলিত যন্ত্রপাতির পক্ষেও ওই দূরত্বে যাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য বিজ্ঞানীরা সিসমিক ওয়েভ বা ভূকম্পন তরঙ্গের ওপর নির্ভর করেন।
এ তরঙ্গগুলো ভূমিকম্প, বিস্ফোরণ ইত্যাদির ফলে উৎপন্ন হয় এবং পৃথিবীর অভ্যন্তর ও উপরিভাগ দিয়ে চলাচল করে। এগুলো থেকেই পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এসব তথ্যের মাধ্যমেই ঊনিশ’শ শতাব্দীর শেষদিকে জিওফিজিসিস্টরা বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে তরল পদার্থ, যাকে ঘিরে আছে কঠিন আবরণ। এ আবরণকে আবার ঘিরে আছে কঠিন পৃষ্ঠদেশ যাকে আমরা ভূত্বক বলি। কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেন ডেনিশ সিস্মোলজিস্ট ইঙ্গ লেম্যান।
১৯২৯ সালে নিউজিল্যান্ডের কাছে বিশাল এক ভূমিকম্প হয়। ইঙ্গ এই ভূমিকম্পের শক ওয়েভগুলো পর্যবেক্ষণ করে অবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন কিছু পি-ওয়েভ, পৃথিবীর কেন্দ্র দ্বারা যেগুলোর বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো ভূকম্পন স্টেশনে ধরা পড়েছে।
এ থেকে তিনি ধারণা করেন, ওয়েভগুলো কেন্দ্রের কিছুটা ভেতরে ঢোকার পর কোনো এক সীমানার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে এসেছে। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে তিনি ১৯৩৬ সালে একটি গবেষণাপত্রে লিখেন- পৃথিবীর কেন্দ্র দুটো অংশ দিয়ে গঠিত। একদম কেন্দ্রে একটি কঠিন অংশ এবং কঠিন অংশটিকে বেষ্টন করে থাকা একটি তরল অংশ। ইঙ্গের হাইপোথিসিস নিশ্চিতভাবে গৃহীত হয় ১৯৭০ সালে।
১৯৯৩ সালে ১০৫ বছর বয়সে ইঙ্গ লেম্যান মৃত্যুবরণ করেন। এ নারী বিজ্ঞানী জীবদ্দশায় খুব দুঃখ করেছিলেন মেয়েদের প্রতি বিজ্ঞানী মহলের আচরণ দেখে। ১৯৮০ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ছেলে এবং মেয়ের বুদ্ধিমত্তায় কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু হতাশ হয়ে লক্ষ করলাম, সবাই এভাবে ভাবে না।’
আরেকবার নিজের ভাগ্নে নীল গ্রোসকে বলেছিলেন, ‘তোমার জানা উচিত কত অযোগ্য পুরুষের সঙ্গে আমাকে প্রতিযোগিতা করতে হয়- অকারণে।’
এসডব্লিউএসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ