ভাষা নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে ছয় হাজারের মতো ভাষা আছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রথম কবে কথা বলতে শিখেছিল? এখন যে হাজার হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলে সেগুলো কী ঐ একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকেই এসেছিল? ভাষার উৎস কী?
এসব সম্পর্কে জানতে দারুণ উৎসাহী মানুষ। আজকে আমরা এসব বিষয় জানার চেষ্টা করবো। মূলত ভাষার উৎপত্তি নিয়ে মত বিরোধের শেষ নেই। পৃথিবীতে সবচেয়ে পুরনো ভাষার নাম জানতে চাইলে আমরা অনেকেই ভাবি ব্যাবিলনীয়, সংস্কৃত অথবা মিশরীয় ভাষার কথা।
কিন্তু অধ্যাপক টলারম্যান বলছেন, ‘এসব ভাষা তার ধারে-কাছেও নেই। সাধারণত আমরা বলি যে ভাষা ছয় হাজার বছর পুরনো। কিন্তু ভাষার প্রকৃত উৎস যদি খুঁজে দেখতে হয় তাহলে অন্তত ৫০ হাজার বছর পেছনে ফিরে যেতে হবে। আমাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ভাষার উৎপত্তি পাঁচ লাখ বছর আগেও হতে পারে।’
অনেক ভাষাবিজ্ঞানী মনে করেন, ভাষার ইতিহাস আসলে এর চেয়েও পুরনো। অধ্যাপক ফোলির মতে, পৃথিবীতে যত ভাষা আছে সেগুলোর চরিত্র আলাদা আলাদা হলেও এটাও সম্ভব যে বর্তমানে সব ভাষাই একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এসেছে।
জীববিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাসের সূত্র ধরে বিজ্ঞানীরা ভাষা কবে শুরু হয়েছিল তার কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। জিন-বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে আমরা কমবেশি সবাই এসেছি আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে। ভাষার এই তালিকার বাইরেও হয়তো অন্যান্য ভাষাও থাকতে পারে, কিন্তু আজকের দিনে যেসব ভাষায় কথা বলতে শোনা যায় সেগুলোর সবই সম্ভবত একই ভাষা থেকেই বিবর্তিত হয়েছে।
আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবাশ্ম থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায় যে আমরা ঠিক কবে থেকে কথা বলতে শুরু করেছিলাম। অধ্যাপক ফোলি বলছেন, কথা হচ্ছে একধরনের শ্বাস প্রশ্বাস নেয়া। এটা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই আমরা শব্দ তৈরি করে থাকি। এটা করার জন্যে শরীরের পেশীর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয়। আমাদের বক্ষ এবং উদরের মাঝখানে যে ঝিল্লির পর্দা সেটি অন্যদের থেকে আলাদা। আমাদের কাছাকাছি যে প্রাণী, অর্থাৎ বানর বা এইপ, যারা কথা বলতে পারে না, তাদের ঝিল্লির তুলনায় আমাদের ঝিল্লিতে নার্ভের সংখ্যা বহুগুণে বেশি।
এসব নার্ভের অর্থ হচ্ছে, আমাদের স্পাইনাল কর্ড এইপের স্পাইনাল কর্ডের চেয়ে মোটা এবং আমাদের ভার্টিব্রাল কলামও একটু বেশি প্রশস্ত। নিয়েন্ডারথাল নামে আমাদের যে আত্মীয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যারা ছয় লাখ বছর আগেও পৃথিবীতে বেঁচে ছিল, তাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তাদের স্পাইনাল কলামও প্রশস্ত ছিল।
কিন্তু আপনি যদি দশ লাখ বছর আগের হোমো ইরেক্টাসের দিকে তাকান, যারা মানবজাতির প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ, তাদের দেহে এরকম ছিল না। এ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় যে মানুষ কবে থেকে কথা বলতে শুরু করেছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাশ্মের রেকর্ডের বাইরেও জিন-বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে ভাষার বয়স জানা সম্ভব হচ্ছে। অধ্যাপক ফোলি বলেন, এফওএক্সপিটু নামের একটি জিন আছে। স্তন্যপায়ী প্রায় সকল প্রাণীর শরীরেই আছে এই জিন। কিন্তু মানবদেহে যেটি আছে সেটি এর রূপান্তরিত জিন।
জিনের এই রূপান্তর গবেষণা করেও বোঝা যায় কেন মানুষ কথা বলতে পারে, কিন্তু শিম্পাঞ্জি পারে না। কথা বলা ও ভাষার বিকাশে এই জিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কারণ যেসব মানুষের শরীরে এই জিনটি রূপান্তরিত অবস্থায় থাকে না, তাদের কথা বলতে অসুবিধা হয়।
আদিম পৃথিবীতে মানুষের আগেই এসেছিল এপরা। এই এপদের গলায় বড় আকারের বায়ুথলী ছিল। এটা দিয়ে তারা ‘গোঁ গোঁ’ ধরনের শব্দ করে প্রতিপক্ষ বা অন্যান্য প্রাণীকে ভয় দেখাত। সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের বায়ুথলী স্বরবর্ণের উচ্চারণে বাধা দেয়। এটা কিন্তু বিজ্ঞানীরা ইচ্ছেমতো বলে দেননি। বেলজিয়ামের ফ্রি ইউনিভার্সিটি অফ ব্রাসেলসে বিজ্ঞানী বার্ট দ্য বোর সিমুলেশন করে দেখিয়েছেন। কিন্তু মানুষের ভাষার পেছনে স্বরবর্ণ, যাকে বলে, আবশ্যক।
এপদের মধ্যে এ ধরনের বায়ুথলী ছিল ঠিকই, কিন্তু হোমো হাইডেলবার্জেনিস প্রজাতীর দেহে এরকম কিছু দেখা যায় না। এই হোমো হাইডেলবার্জেনিস থেকেই পরে নিয়ান্ডারথাল ও স্যাপিয়েন্সরা এসেছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। হোমো হাইডেলবার্জেনিস পৃথিবীতে ছিল প্রায় সাত লাখ বছর আগে। অর্থাৎ এ সময় পৃথিবীতে ভাষা না থাকলেও, ভাষা তৈরি হওয়ার বেশ কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান ততদিনে চলে এসেছে।
আধুনিক মানুষের কথা যদি ভাবি, মস্তিষ্ক থেকে মেরুদণ্ড হয়ে অনেক অনেকগুলো স্নায়ু ডায়াফ্রাম এবং পাঁজরের মধ্যকার পেশীতে এসে যুক্ত হয়েছে। ঠিকভাবে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ ও যথার্থ শব্দ করার জন্য এগুলো জরুরি ভূমিকা রাখে। এই একই জিনিস নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও দেখা যায়।
এই দুই প্রজাতির কানের ভেতরের অংশেও একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। ফলে, মানুষের উচ্চারিত শব্দের কম্পাংকের যে পরিসীমা আছে- এই সীমায় প্রজাতি দুটির কানের ভেতরে দারুণ সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। কথা বলার জন্য শোনা ও এর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বোঝাটা জরুরি। এটার খুব সহজ একটা উদাহরণ আমরা বর্তমানেই দেখতে পারি। যারা কথা বলতে পারেন না, তারা কানেও শুনতে পান না। কারণ, শুনে সেটা প্রকাশ না করতে পারলে, এই ভার মস্তিষ্ক নিতে পারবে না। আবার, না শুনলে বলার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি হওয়া একরকম অসম্ভব।
এরপরেও, কথা বলার জন্য আরেকটা জিনিস দরকার। এফওএক্সপিটু জিন। মস্তিষ্কের যে অংশ কথা নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে কারিকুরি ফলায় এটি। অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যেই এটা থাকে। কিন্তু মানুষের ভেতরে এই জিনটি কিছুটা উন্নত। সেজন্যই আমরা মুখ ও চেহারায় ভাষার জন্য প্রয়োজনীয় নড়াচড়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও এই জিন ছিল, কিন্তু এতটা উন্নত ছিল না।
মজার বিষয় হচ্ছে, এখনকার মানুষদের মতো নিয়ান্ডারথালদের এই এফওএক্সপিটু ধরনেরই জিন ছিল। এর ফলে ধারণা করা যায় যে তাদের মধ্যেও কোন না কোন ধরনের কথা বা ভাষা ছিল। তবে তাদের সেই ভাষা সম্পূর্ণ এবং উন্নত ছিল কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়।
অধ্যাপক টলারম্যান বলছেন, কথার সঙ্গে ভাষার পার্থক্য আছে। তবে কী কারণে কথা একসময় ভাষা হয়ে উঠে সেটা জিনগত তথ্যপ্রমাণ থেকে নির্ণয় করা কঠিন।
আদি-মানবের মাথার খুলির আকৃতি থেকে কি ভাষার উৎপত্তির সময় খুঁজে বের করা সম্ভব? অবশ্যই না। সবচেয়ে সহজ কারণ হলো আমরা ঠিক জানি না যে একটি ভাষা তৈরির জন্যে কতো বড় মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়। অধ্যাপক টলারম্যান বলেন, ‘নিয়ান্ডারথালদের মস্তিষ্ক আমাদের চেয়েও বড় ছিল। কারণ প্রাণী হিসেবেও তারা বড় ছিল’।
এসডব্লিউএসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ