পড়াশোনার শেষে কর্মজীবনে পা দিয়ে অনেকেই হাহুতাশ করেন শৈশবে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সময় যে বয়ে চলেছে নিজের খেয়ালে। আমাদের ইচ্ছে মতো তাকে তো আটকে রাখা যায় না।
তবে সময় নিজের তালে চলতে থাকলেও, দেহের জৈবিক ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে পারে উল্টোদিকে, এবার তেমনটাই প্রমাণ করলেন গবেষকরা।
হ্যাঁ, মানুষ তো বটেই, প্রতিটি প্রাণীর শরীরেই উপস্থিত রয়েছে এক বিশেষধরনের জেনেটিক ঘড়ি। আর এই ঘড়িই নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণীদের বার্ধক্য। এই জৈবিক ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করে প্রাণীদের দৈহিক বৃদ্ধির হার, কোষের পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া।
সম্পতি বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সেল’-এ প্রকাশিত গবেষণা জানাচ্ছে, এই ঘড়ি বা জেনেটিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে কোষের বৃদ্ধি এবং বার্ধক্যের গতি বাড়ানো বা বিপরীত করা সম্ভব। অর্থাৎ, চাইলে এই ঘড়িকে নিয়ন্ত্রণ করেই বয়স বাড়ানো কিংবা কমানো যায় মানুষের। কিন্তু কীভাবে?
প্রধান গবেষক ডেভিড সিনক্লেয়ার জানাচ্ছেন, শৈশব থেকে বার্ধক্য— সময়ের সঙ্গে মানুষের শারীরিক গঠন ঠিক কেমন হওয়া উচিত কিংবা তার কোনো নির্দিষ্ট বয়সে কোষের বৃদ্ধি ঠিক কতটা হওয়া উচিত, মানব জিন এসব তথ্য ধরে রাখে ব্যাকআপ হিসাবে। ফলে, নির্দিষ্ট জিনকে বেছে নিয়ে তার অনুলিপি পুনরুৎপাদন করলেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব মানুষের বয়স।
সহজ কথায় বলতে গেলে, কম্পিউটার বা ফোন স্লো হয়ে গেলে ঠিক যেভাবে আমরা ফরম্যাট করে থাকি, এ যেন সেই প্রক্রিয়াই। অর্থাৎ, মূল কথা হল বার্ধক্যও পরিবর্তনযোগ্য।
কিন্তু এ তো গেল তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ। বাস্তবে কি এমনটা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত বয়স নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত পরিকাঠামো বা প্রযুক্তি পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেননি গবেষকরা। অবশ্য ইঁদুরের ওপর এই পরীক্ষা চালিয়েছিলেন তারা। বলাই বাহুল্য, সফল হয়েছিল সেই পরীক্ষা।
মানুষের স্টেম কোষ এবং একটি বিশেষ জিনের ব্যবহারে অন্ধ ইঁদুরের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন ডেভিড সিনক্লেয়ার ও তাঁর সহকর্মীরা। আলাদা করে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল ইঁদুরের মস্তিষ্ক, পেশি এবং কিডনিতেও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য মিলেছে অল্পবিস্তর।
সম্প্রতি বোস্টনের গবেষণাগারগুলোতে থাকা বৃদ্ধ, অন্ধ ইঁদুরেরা তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে; তাদের নতুন ও আরও বুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে এবং আরও স্বাস্থ্যকর পেশি ও কিডনি টিস্যু তৈরি করেছে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ব্লাভাটনিক ইনস্টিটিউটের জেনেটিক্সের অধ্যাপক এবং পল এফ গ্লেন সেন্টার ফর বায়োলজি অফ এজিং রিসার্চের সহ-পরিচালক, অ্যান্টি-এজিং বিশেষজ্ঞ ডেভিড সিনক্লেয়ার বলেন, পরীক্ষাগুলো দেখায় যে, বার্ধক্যকে উল্টোদিকে পরিচালিত করা সম্ভব, এবং এটিকে ইচ্ছানুযায়ী সামনের দিকে বা পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
আমাদের শরীর আমাদের যৌবনের একটি ব্যাকআপ কপি ধারণ করে যা পুনরায় কার্যকর হতে পারে বলে তাদের নতুন গবেষণাপত্রটিতে জানিয়েছেন সিনক্লেয়ার, যেখানে তার ল্যাবরেটরি এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের কাজের প্রমাণ দেখানো হয়েছে।
সম্মিলিতভাবে করা পরীক্ষাগুলোর ফলাফল গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো সেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বার্ধক্য হলো জেনেটিক মিউটেশনের ফল, যা আমাদের ডিএনএকে দুর্বল করে ফেলে, ক্ষতিগ্রস্ত কোষের টিস্যুগুলোর একটি ভাগাড় তৈরি করে, যার ফলে দেহের কার্যকরিতার অবনতি, রোগ এবং মৃত্যু হয়: বার্ধক্য নিয়ে এ বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এ ফলাফলগুলোতে।
সিনক্লেয়ার বলেন, এটি আবর্জনা নয়, এটি এমন ধরনের কোনো ক্ষতি নয় যা আমাদেরকে বুড়ো বানিয়ে ফেলে। আমাদের বিশ্বাস এটি তথ্যের হারিয়ে যাওয়া, মূল ডিএনএ পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কোষগুলো। ফলে এটি কীভাবে কাজ করবে তা ভুলে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা পুরোনো কম্পিউটারের সফটওয়্যার করাপ্ট হওয়ার মতো। আমি একে ‘ইনফরমেশন থিওরি অব এজিং’ নাম দিয়েছি।
সিনক্লেয়ার ল্যাবের জেনেটিক্স রিসার্চ ফেলো জায়ে-হিয়ুন ইয়াং গবেষণাপত্রটির সহলেখক ছিলেন। তিনি আশা করেন এ গবেষণার ফলাফল, “আমরা বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে যেভাবে দেখি এবং বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসা সারাতে আমরা যেভাবে চিন্তা করি, তা পরিবর্তন করবে।”
এসডব্লিউএসএস/০৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ