জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ওপর সহিংসতা ও দমনপীড়ন বেড়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, আন্তর্জাতিক চাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু উল্টো তারা দমন-পীড়ন বাড়িয়ে দিয়েছে। দাতাগোষ্ঠী এবং স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারদের জোর দেয়া উচিত, যাতে বাংলাদেশিরা আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে নির্ভয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করতে এবং তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারে।
২০২২ সালে বিশ্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার বিষয়ক ৭১২ পৃষ্ঠার বার্ষিক ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও সমালোচনা করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সমালোচকদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রেখেছে কর্তৃপক্ষ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অংশীদাররা এই নিপীড়নমূলক আইন স্থগিত এবং সংস্কারের আহ্বান জানালেও সরকার তা উপেক্ষা করছে। পক্ষান্তরে জুলাইয়ে সরকার ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট-এর খসড়া প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর ফলে নজরদারি বৃদ্ধি করা হবে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লংঘিত হবে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে
রিপোর্টের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বলপূর্বক গুমের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমে যায়।
এতে ইঙ্গিত মেলে যে, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ম লংঘনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা আছে কর্তৃপক্ষের। সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে মানবাধিকারের পক্ষের কর্মী এবং জোরপূর্বক গুমের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে কর্তৃপক্ষ।
রিপোর্টে বলা হয়, কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তার অব্যাহত রেখেছে সরকার। গত বছর নভেম্বরে বিরোধীদলীয় নেত্রী সুলতানা আহমেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সুলতানা আহমেদের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযোগ, তিনি সেপ্টেম্বরে এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন।
বিরোধী দল বিএনপি দাবি করেছে, তাদের দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার অন্তত ২০ হাজার মামলা দিয়েছে, যার বেশির ভাগই অজ্ঞাতনামা। এই মামলাগুলোকে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্যদের বাড়িতে অভিযান চালানোর জন্য ওয়ারেন্ট হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
এ ধরনের আচরণকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শন বলে অভিহিত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
মানবাধিকার সংস্থাটির দাবি, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের ভিন্নমতাবলম্বীদেরও ছাড়ছে না কর্তৃপক্ষ। নভেম্বরে ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ফেসবুকে ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার’ অভিযোগে প্যারিসে বসবাসরত বাংলাদেশের ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা দিয়েছে।
এ ছাড়া ওই একই সময়ে ঢাকাতেও দু’জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। জাতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে থাকা ভিন্নমতাবলম্বীদের একটি তালিকা তৈরি করেছে যারা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কার্যকলাপ করছে। কর্তৃপক্ষ প্রবাসী ভিন্নমতাবলম্বীদের আত্মীয়দের টার্গেট করা বৃদ্ধি করেছে।
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সাময়িক সময়ের জন্য নিপীড়ন কমে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আইনপ্রয়োগকারীরা এটা প্রদর্শন করেছেন যে, তারা পুরনো ধারায় ফিরে গেছেন। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের টার্গেট করছে। যে অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।
তারা বলেছে, এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন র্যাবের এমন দু’জন কর্মকর্তাকে জানুয়ারিতে তাদের ‘সাহসিকতা ও দেশের সেবার’ জন্য অভিজাত পুলিশ মেডেল পুরস্কার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, বাংলাদেশে ব্লক করা নেত্র নিউজ ১৪ই আগস্ট একটি হুইসেলব্লোয়ার রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, একটি গোপন বন্দিশিবিরে জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখেন এবং নির্যাতন করেন কর্মকর্তারা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকারকর্মী নবায়ন চাকমা মিলনকে নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন করা হয় এবং তিনি মারা যান।
রিপোর্টে মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীদের ওপর হামলার তথ্যও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ভিকটিমদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন যে, কর্মকর্তারা তাদের বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছেন, জোর করে মিথ্যা বিবৃতিতে স্বাক্ষর নিয়েছেন যে, তাদের স্বজনকে জোরপূর্বক গুম করা হয়নি এবং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছেন। মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীদের বিরুদ্ধে নজরদারি বৃদ্ধি করেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনকে হয়রান করা হয়েছে।
বিভিন্ন রিপোর্টে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ
সরকারকে প্রতিশোধ নেয়া বন্ধ করতে অনুরোধ করেছে জাতিসংঘের অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। এতে আরও বলা হয়েছে, যেসব ভিন্নমতাবলম্বী বিদেশে বসে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিদেশে বসবাসকারী এসব ভিন্নমতাবলম্বীদের আত্মীয়স্বজনকে টার্গেট করা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় এবং গুমের বিরুদ্ধে বৃটেনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আয়োজনের খবর প্রকাশ করার পর লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক শামসুল আলম লিটনের ভাইকে সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করে ডিবি কর্মকর্তারা। একই মাসে পুলিশ ত্রেপ্তার করে আবদুল মুকতাদির মানু’কে। তিনি একই পত্রিকার লন্ডনভিত্তিক একজন প্রতিনিধির ভাই। প্রায় ৬ মাস বন্দি থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাংবাদিক কনক সারোয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকা।
এতে আরও বলা হয়, মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনকে টার্গেট বৃদ্ধি করেছে সরকার। ২৫শে জানুয়ারি স্বাক্ষরিত একটি সার্কুলার ফাঁস হয়ে যায়। তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনের বৈদেশিক অর্থায়নে নজরদারি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে।
৫ই জুন দেশের সুপরিচিত মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকার’কে একটি চিঠি পাঠায় এনজিও বিষয়ক ব্যুরো। এতে তাদের নিবন্ধন নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ২০১৩ সালের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের রিপোর্ট করার কারণে শাস্তি দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে হয়রানির জন্য বিচারের মুখোমুখি অধিকার-এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক আসম নাসিরুদ্দিন এলান।
এই রিপোর্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট আগস্টে তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তের জন্য নিরপেক্ষ মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করতে এবং এসব অধিকার সুরক্ষিত রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি স্পেশাল মেকানিজম সৃষ্টিতে তার অফিসের সমর্থন দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন মিশেল ব্যাচেলেট। তিনি আরও সতর্ক করেন যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ যেহেতু সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে, তাই বাংলাদেশকে এটা নিশ্চিত করা উচিত- নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের মানবাধিকার বিষয়ক রেকর্ড স্ক্রিনিংয়ে একটি যথাযথ ব্যবস্থা আছে।
২০১৯ সালের এক রিভিউয়ে রিপোর্ট করা নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তথ্য চেয়েছিল জাতিসংঘ। কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চারের অধীনে এতে বাধ্য সরকার। তবে দু’বছর ধরে সরকার তা উপেক্ষা করে আসছে।
মার্চে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে সফরে আসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি মনিটরিং মিশন। একই সঙ্গে তারা এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) স্কিমের অধীনে সংযুক্ত হওয়া বৃদ্ধির বিষয়ে অগ্রগতির আহ্বান জানায়। মে মাসে আরও আলোচনা হয়।
মার্চ মাসে ইউএস-বাংলাদেশ পার্টনারশিপ ডায়ালগের সময়ে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। সফরে তিনি নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের নিয়ম লংঘনের জবাবদিহিতার আহ্বান জানান। এ ছাড়া চীন ও ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে বাংলাদেশ। কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং জাপান যে আহ্বান জানিয়েছে, প্রকাশ্যে সেই আহ্বানে সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয়েছে ওই দুটি দেশই।
এ ছাড়া ওই রিপোর্টে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, নারীর অধিকার, যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয়, বিকলাঙ্গদের অধিকার, রোহিঙ্গা শরণার্থী সহ আরও কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন। এই গ্যাসের নির্গমনে বাংলাদেশের ভূমিকা নেই বললেই চলে।
তা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড় এখানে আরও ঘন ও তীব্র হবে। এতে নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের জন্য হুমকি বৃদ্ধি পাবে। জুনে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রেকর্ড পর্যায়ে বন্যা হয়। তাতে প্রায় ৭২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চট্টগ্রামে একটি কয়লা ও গ্যাস বিষয়ক প্রকল্প নির্মীয়মাণ। যদি এটা নির্মিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ ৫ বছরে যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করবে, এখান থেকে প্রায় সমতুল্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হবে। একই সঙ্গে ঘটবে বায়ুদূষণ। ফলে স্থানীয় জনগণ এবং জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে।
জুনে সরকার ঘোষণা করেছেন যে, তারা জাপানি বিনিয়োগ হারানোর পর বিতর্কিত মাতারবাড়ি ২ কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিল করেছে। কিন্তু সরকার এখন পরিকল্পনা করছে একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বিষয়ক (এলএনজি) বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে।
এসডব্লিউএসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ