চামড়া বা ত্বক, যা গোটা মানব দেহকে আবৃত করে রেখেছে, সেই ত্বককে এবার কৃত্রিমভাবে গবেষণাগারে তৈরি করতে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷
অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের জন্য ‘কৃত্রিম ত্বক’ তৈরির এই উদ্যোগ নিয়েছে চিকিৎসাসামগ্রী উৎপাদনকারী ফরাসি প্রতিষ্ঠান উরগো। আগুনে পুড়ে যাওয়া অংশে এই কৃত্রিম ত্বক প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের জন্য একটি স্থায়ী সমাধান তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা। তারা এ প্রকল্পের নাম দিয়েছেন ‘জেনেসিস’।
উল্লেখ্য, একটি মানব ত্বকের আকার দুই বর্গমিটার পর্যন্ত হতে পারে এবং গোটা দেহের শতকরা ১৬ ভাগ ওজন হচ্ছে এই চামড়া বা ত্বকের৷ অত্যন্ত পাতলা হলেও এই ত্বক কিন্তু কয়েকটি স্তরে বিভক্ত৷ মানব শরীরের এক বর্গইঞ্চি ত্বকে রয়েছে সাড়ে ছয়শ ঘামের গ্রন্থি, ২০টি উপশিরা, ৬০ হাজার মেলানোসাইটস এবং এক হাজারেরও বেশি স্নায়ুতন্তু৷ এছাড়াও এই ত্বকের মধ্যে রয়েছে চুল, ঘ্রাণের গ্রন্থি, চর্বির টিস্যু, রোগ প্রতিরোধ কোষ, তাপ নির্ণায়ক কোষ সহ আরও কিছু৷ এইসবকিছুর মাধ্যমে ত্বক মানবদেহকে নানা ধরণের রোগ ব্যধি থেকে আগলে রাখে৷
প্রসঙ্গত, বর্তমানে গুরুতর অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের কষ্টকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘ড্রেসিং’ করা হয়। একবার নয়, একাধিকবার এই কষ্ট সহ্য করতে হয়। এ কষ্ট লাঘবে ১০ কোটি ইউরো ব্যয়ে ‘জেনেসিস’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
দেড় বছর ধরে গবেষকেরা এ নিয়ে কাজ করছেন। তাদের আশা, ২০৩০ সালের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি তৈরি হবে।
ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলে শেনভ এলাকায় উরগোর গবেষণাগারে কৃত্রিম ত্বক তৈরির কাজ চলছে। উরগোর মেডিকেল শাখার প্রেসিডেন্ট জিউহেক লেলুস জেনেসিস বলেন, তারা গবেষণাগারে কৃত্রিম ত্বক আবিষ্কারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
কৃত্রিম ত্বক আবিষ্কারের এ চেষ্টাকে যুগান্তকারী বর্ণনা করে উরগোর গবেষণা পরিচালক লরেন্ট অ্যাপার্ট বলেন, ‘এ শতাব্দীর শুরু থেকে আমরা অগ্নিদগ্ধ মানুষদের সারিয়ে তোলা নিয়ে কাজ করছি। ড্রেসিং খুবই দারুণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে।
ক্ষত সারিয়ে তুলতে এটা বেশ কার্যকর। এটা অগ্নিদগ্ধ মানুষের অনেক উপকার করে।’ তবে অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের সারিয়ে তোলার বিষয় নিয়ে আরও কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা অনেকেই করছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ার গবেষকেরা ড্রেসিংয়ের নতুন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন।
এ পদ্ধতির মাধ্যমে রুপার ক্ষুদ্র কণা দেওয়া হয়, যা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ভেঙে দিতে পারে।
গবেষকেরা বলছেন, কৃত্রিম ত্বক আবিষ্কার হলে সবচেয়ে উপকৃত হবে শিশুরা। কারণ, অগ্নিদগ্ধ মানুষের বেশির ভাগ শিশু। ‘গ্লোবাল বার্ন রেজিস্ট্রি’ নামে বিশ্বে অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের যে হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) রাখে তাতে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে যারা অগ্নিদগ্ধ হয়, তাদের প্রায় অর্ধেকের বয়স এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে।
প্যারিসের কুরি ইনস্টিটিউটের ক্ষত ও নিরাময় গবেষণা ইউনিটের প্রধান ইসাবেল ফ্রোম্যান্টিন বলেন, দুই দশক আগের তুলনায়, ক্ষতের যত্নের ক্ষেত্রে এখন রাত-দিন পার্থক্য চোখে পড়বে। তবে তাঁর মতে, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব ক্ষত রাতারাতি সারানো যাবে না। নিরাময় প্রক্রিয়াটি ব্যক্তিভেদে আলাদা। এটি বয়স ও স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে।
এদিকে, বেশ আগেই অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক কৃত্রিম ইলেকট্রনিক ত্বক বানিয়েছেন যা আসলে ত্বকের মতই ব্যাথার অনুভূতির প্রতি সাড়া দেয়। গবেষক দলের প্রত্যাশা এই আবিষ্কার কৃত্রিম প্রত্যঙ্গের প্রযুক্তিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
কৃত্রিম এই ত্বক ব্যাথার অনুভূতির বৈদ্যুতিক প্রতিরূপ তৈরি করতে সক্ষম। মানুষের ত্বক যেভাবে প্রায় সাথে সাথে আঘাতের অনুভূতিকে মস্তিস্কে পৌছে দেয়, নতুন ধরনের এই কৃত্রিম ত্বকটিও একই গতিতে অনুভূতিকে প্রক্রিয়াজাত করতে পারে।
কৃত্রিম অনুভূতিসম্পন্ন এই ত্বক তৈরিকে বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট গবেষণার এক মাইলফলক দাবি করেছেন গবেষক দলের প্রধান মাধু ভাস্করন, ‘এর আগে কোন বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি এতটা বাস্তবসম্মত ভাবে মানুষের ব্যাথার অনুভূতিকে অনুকরণ করতে পারেনি। বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়াশীল একটি স্নায়ু ব্যবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
এসডব্লিউ/এসএস/১১২৭
আপনার মতামত জানানঃ