বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নামটি আমরা প্রায় সবাই শুনে থাকবো। কারো কারো কাছে এটি এক অজানা রহস্য কারো কাছে আবার এটি কিছুই না। বর্তমানে বহুল আলোচিত ঘটনার মধ্যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল একটি। বারমুন্ডা ট্রায়াঙ্গাল আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে এর রহস্য সমাধান করার। অনেকে মনে করেন যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য কাল্পনিক মোটেও বাস্তবিক নয়। আজ আমরা জানবো ওই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে। এটি আবার শয়তানের ত্রিভূজ নামে সমধিক পরিচিত।
অবস্থান
এই অঞ্চলটি যে একদম ঠিকঠাক আটলান্টিক মহাসাগর কোথায় অবস্থিত তা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। একদল গবেষকদের মতে এই অঞ্চলটির এক প্রান্ত হল পুয়ের্তো রিকো আরেক প্রান্ত আছে যুক্তরাষ্ট্রের বাহমা ও ফ্লোরিডার দক্ষিণাংশ আর অন্য প্রান্ত হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপপুঞ্জ। কেউ কেউ আবার এ জায়গার সাথে মেক্সিকো উপসাগর যুক্ত আছে বলে মনে করেন। আবার অনেকের কাছে এটা ত্রিভুজ আকৃতির নয় বরং ট্রাপিজিয়াম আকৃতির।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল আবিষ্কার
পঞ্চদশ শতকে ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন ইউরোপ থেকে আমেরিকায় যান তখনই তিনি সাগরে অদ্ভুত এলাকা লক্ষ করেন। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় ১৪৯২ সালের ১১ ই অক্টোবর এই জায়গাটি নিয়ে তিনি অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন।
তিনি লিখেছেন তার জাহাজের নাবিকরা দূর থেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অঞ্চলের দিকে আলোর নাচানাচি আর আকাশে ধোয়া দেখেছিল। আর তার কম্পাস এলোমেলো ছোটাছুটি করছিল। অদ্ভুত এই জায়গাটি প্রায় ৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত জুড়ে রয়েছে।
যদিও এই অঞ্চলের আবিষ্কারক কলম্বাস তবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন লেখক ভিনসিয়েন্ট গ্যাডিস তার লেখা একটি কাহিনীতে ১৯৬৪ সালে। ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে আটলান্টিক মহাসাগরের নামহীন এক অদ্ভুত এলাকা নিয়ে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। আর এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই গ্যাডীস লিখেছিল “The Deadly Bermuda Triangle” নামক কাহিনীটি।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য
যখনই কোন বিমান বা জাহাজ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে গিয়েছে তখন সেগুলো কিভাবে যেন হারিয়ে যায় কিংবা সেখান থেকে যদিও ফিরে আসে তবু মুখোমুখি হয় অদ্ভুত সব ঘটনার। এসব ঘটনার কারণ এই রহস্য যেন আরো গভীর হয়ে উঠেছে।
মারি সেলেস্ত নামের একটি মালবাহী জাহাজ ১৮৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে নিউইয়র্ক থেকে রওনা হয়। অনেকদিন পর যখন গন্তব্যে পৌঁছায় নি তখন শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। অনেক চেষ্টার পর জাহাজটিকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় খুঁজে পাওয়া গেল ভাসমান অবস্থায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল যে সব মালপত্র খাবার-দাবার একদম অক্ষত ছিল শুধুমাত্র ১১ জন কর্মী উধাও।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার ব্রিটিশদের সাহায্য করার জন্য ইউএসএস সাইক্লোপস নামক একটি জাহাজ পাঠায়। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে জাহাজটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাছে এসে কোন চিহ্ন না রেখে উধাও হয়ে যায়। এর সাথে ৩০৬ জন ক্রু উধাও হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে একই জায়গা থেকে ১৯৪১ সালে গায়েব হয়ে যায় ইউএসএস প্রটিয়াস আর ইউএসএস নিরিয়াস নামের দুটি জাহাজ।
তবে জাহাজের ঘটনাগুলোর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো মেরিন সালফার কুইন নামক জাহাজ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি। ১৫ হাজার টন সালফার আর ৩৯ জন ক্রু নিয়ে ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তে রওনা হয় জাহাজটি। ফেব্রুয়ারি ৪ থেকে জাহাজটি যখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অবস্থান করছিল হঠাৎ রেডিও ট্রানস্মিশন অফ হয়ে যায় অথচ কিছুক্ষণ আগেও কমাণ্ডার বলেছিলেন “)কত সুন্দর আবহাওয়া! কি চমৎকার ভাবে নেভিগেশন চলছে!” এভাবে হঠাৎ ৬০০ ফুটের এই জাহাজটি মানুষগুলোকে নিয়ে একদম নেই হয়ে গেল ।
এখন আসি বিমানের কথায়। সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে ফ্লাইট নাইনটিন নামক পাঁচটি বিমান নিখোজ হওয়া নিয়ে। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে শুরুর দিকে ইউএস নেভির সেরা পাঁচজন এভেঞ্জার বম্বার একটি প্রশিক্ষণ মিশনের জন্য রওনা হয়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল এ অবস্থান করছে এমন অবস্থায় বিমানগুলির সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই পাচটি বিমানের খোজ আজও পাওয়া যায় নি।
রহস্যের সমাধান
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্য সমাধানের জন্য অনেক বিজ্ঞানীই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। প্রচুর গবেষণার পর ২০১৬ সালের ৪ মার্চ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। যার তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০০ টি জাহাজ আর ৭৫ টির মত বিমান নিখোঁজ হয় বারমুন্ডা ট্রায়াঙ্গেলে। অনেকে করেন যে এসব ঘটনার পেছনে অতিপ্রাকৃত কোন কারণ নেই বরং বৈরী আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমেরিকা, ইউরোপ, আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে চলাচলের জন্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল পথেই পড়ে। প্রায় প্রতিদিন অনেক জাহাজ আর বিমানকে ওই পথ পাড়ি দিতে হয়। আর বেশি চলাচলের জন্য দুর্ঘটনার খবর গুলো একটু বেশি শোনা যায় ।
ওই অঞ্চলে কম্পাস কাটা চুম্বকীয় উত্তর মেরু নির্দেশ করে যা ভৌগোলিক উত্তর মেরু থেকে প্রায় ১১০০ মাইল দূরে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে এই পার্থক্য কম্পাস কাটায় প্রায় ২০ ডিগ্রি। জাহাজ বা এরো প্লেন চালানোর সময় এই পার্থক্য হিসেবে রাখা হয় যদি কোনো কারণে ভুল হয় তাহলে নানা বিভ্রাট লাগতে পারে।
জানা গেছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অনেক অংশ জুড়ে থাকে ষড়ভুজ আকৃতির মেঘ এবং কোন মেঘ প্রায় ৫৫ থেকে ৭৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এখানকার বায়ুর গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় 170 মাইল। আর এ সবই হলো জাহাজ আর বিমান দুর্ঘটনার কারণ। আর এ অঞ্চলে প্রায়ই টর্নেডোর উৎপত্তি হয়।
আবার অনেকে মনে করেন মিথেন হাইড্রেট গ্যাস এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। এই মহাসাগরের তলদেশে থেকে উৎপন্ন হওয়া মিথেন হাইড্রেট গ্যাস পানির ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। ফলে কিছু বুঝে উঠার আগেই জাহাজ ডুবে যায় ।
এরপর ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় Larry kusche এর “The Bermuda Triangle Mystery: Solved” বইটি। যুক্তিতে ভরপুর এই বইটিতে দেখানো হয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে বেশিরভাগ গল্পই ভুয়া এবং অতিরঞ্জিত। প্রমান সহকারে লেখক দেখান যে বেশিরভাগ পথদুর্ঘটনাই আসলে সেখানে নয় বরং অন্য কোথাও ঘটেছে আর তা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ট্রপিক্যাল সাইক্লোন প্রবণ অঞ্চলের জাহাজডুবিতে স্বাভাবিক ঘটনা।
উপরে উল্লেখিত যে সব রহস্যের কথা শোনা যায় তার অনেকগুলোরই কিন্তু সমাধান হয়েছে। কলম্বাস আসলে দূরে অন্য জাহাজের নাবিকদের রান্নার আগুনের ধোঁয়া দেখেছিলেন। ফ্লাইট নাইনটিন এর তদন্তে দেখা গেছে রেডিও ট্রানস্মিশন অফ হওয়ার আগে পাইলট বলেছিলেন কম্পাস কাজ করছে না। কোথায় আছি বুঝতে পারছি না সম্ভবত ফ্লোরিডা। এই জিপিএসহীন যুগে একবার পথ হারালে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব । জ্বালানি শেষ হলে তো কথাই নেই। এই ছিল ফ্লাইট নাইনটিন-এর নিখোঁজ হওয়ার রহস্য।
মেরিন সালফার কুইন জাহাজের কাঠামো খুবই দুর্বল ছিল। এজন্য এটি দুর্ঘটনায় পড়ে। এখন আসি অমীমাংসিত ক্যাম্পাসের কম্পাসের এলোমেলো ঘোরা নিয়ে। ধারণা করা হয় যে ওই এলাকায় ম্যাগনেটিক এনোমালি বা চুম্বকীয় শৃঙ্খলা আছে সে কারণে কম্পাস এরকম আচরণ করে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে কম্পাস থেকে চুম্বক মেরুর দূরত্বের উপর ভিত্তি করে এর দিক নির্দেশনায় বিচ্যুতি আসে। একজন দক্ষ পথ প্রদর্শকের এই কথা জানা থাকার কথা। কিন্তু সমস্যা হলো সাধারণ মানুষকে নিয়ে যারা এই বিষয়ে কিছুই জানে না।
মেরিন বীমা কোম্পানি Lloyd’s of London দেখেছে যে এই ত্রিভুজে অন্য সমুদ্রের চেয়েও উল্লেখ করবার মতো ভয়ঙ্কর কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড লেখকদের বর্ণনার উপর ব্যাপক অনুসন্ধানের পর অনুমোদন করেছে এই অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৯৭২ সালে ভি. এ. ফগ নামের একটি ট্যাংকার মেক্সিকো উপসাগরে বিস্ফোরণের পর ডুবে যায়। কোস্টগার্ডরা সে বিধ্বস্ত ট্যাঙ্কারের ছবি তুলেন এবং বেশ কিছু মৃতদেহ উদ্ধার করেন। কিন্তু কতিপয় লেখক বলেছেন ট্যাংকারের সব আরোহী অদৃশ্য হয়ে গেছে শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন কে তার কেবিনে টেবিলে হাতে কফির মগ ধরা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
সংশয়বাদী গবেষকগণ যেমন Ernest Taves এবং Barry Singer দেখিয়েছেন যে মিথ্যে রহস্য তৈরি করা বেশ লাভজনক। কারণ তখন ওই মিথ্যে রহস্য এর উপর ভিত্তি করে বই লিখে বা টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে প্রচুর অর্থ কামানো যায়।
অনেকে মনে করে থাকেন যে এই অঞ্চল জলদস্যু প্রবণ । জলদস্যুরা আলো জ্বেলে জাহাজের নাবিকদের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করত। তারা ভুলবশত জলদস্যুদের আলোর ফাঁদে পড়ে ওই দিকে যেতে এবং ডুবোপাহারের সাথে ধাক্কা খেয়ে জাহাজটি ডুবে যেত এবং ধন-সম্পদ ও মালপত্র সব ভেসে যেত। দস্যুরা পরে সেগুলো সংগ্রহ করতো। আবার অনেক জলদস্যু পরিকল্পিতভাবে জাহাজ লুট করতো এবং পরে জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দিত। ফলে অনেকে মনে করত জাহাজগুলো হারিয়ে গেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল কোন রহস্য নেই। যদি তাই হতো তাহলে ওই এলাকা দিয়ে চলাচলকারী জাহাজ উড়োজাহাজ এর বীমার হার অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি হতো। অথচ সেখানে বাড়তি বীমা আরোপ করা হয় না। বীমা কোম্পানিগুলোর যা হিসেবে তাতে রহস্যের সন্ধান পেলে আর অবশ্যই বীমার হার বাড়িয়ে ধরত।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের দুর্ঘটনা ঘটে তার অনেকগুলোই মানব ঘটিত অর্থাৎ ভুলবশত ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা। মানুষের ভুল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর এই ঘটনা এই অঞ্চলে ঘটতেই পারে। আবার অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের নাম দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক কোম্পানি তাদের পরিত্যক্ত জাহাজ বা বিমান ওই অঞ্চলে ধ্বংস করে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে বীমার টাকা আদায় করেছে এরকম কিছু তথ্যও পাওয়া যায়।
এসডব্লিউএসএস/২০১৫
আপনার মতামত জানানঃ