বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে অনেক দিন ধরেই হতাশা চলে আসছিল। অনেক দিন ধরেই সংস্কারের কথা বলা হচ্ছিল। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এসে আমাদের অনেক পর্যবেক্ষণ দিয়ে গেছে।
সরকার তার বাড়তি ডলার দেখানোর অবস্থা থেকে সরে এসে আসল রিজার্ভ দেখানো শুরু করেছে গত মাস থেকে। কিন্তু এখানেও কথা আছে। আইএমএফের মতে, রিজার্ভ হতে হবে রিজার্ভ, যেকোনো সময় ব্যবহারযোগ্য। (আইএমএফ ওয়েবসাইট) বাংলাদেশের এই রিজার্ভের হিসাবে এখনো সোনা, বন্ড, ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত ডলারও আছে, যা যেকোনো সময় ইচ্ছা করলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবহার করতে পারবে না।
তাই এখনো আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ দেখানো শুরু হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন ধরে তাই সোনা বিক্রিও শুরু করেছে। আইএমএফ রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল ছোট করতে বলেছে, যার কোনো কিছু এখনো দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ব্যবসা উন্নয়নের জন্য রিজার্ভ থেকে ঋণ চেয়েছে।
আমাদের অনেক দিন ধরে এই জিনিস নিয়ে প্রশ্ন ছিল, যা আইএমএফ সংস্কার করতে বলেছে। অনেকের মতেই দেশে এখন মুদ্রাস্ফীতি স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। মানুষের নাভিশ্বাস হচ্ছে। কিন্তু বিবিএস এখনো ১০ শতাংশের নিচে দেখিয়ে যাচ্ছে, যা পুরোই অবাস্তব। সরকার যদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে চিন্তিত হতোই এ সময়ে টাকা ছাপানোর মতো কাজ করত না। যদিও সরকার আগামী অর্থবছর থেকে মুদ্রাস্ফীতি জাতিসংঘের স্ট্যান্ডার্ড মেনে করবে বলছে।
এদিকে জিডিপি যদি সঠিক তথ্য না পায়, তাহলে দিন দিন বড় জিডিপি হবেই। যত দিন সব তথ্য সঠিক না পাওয়া যাবে, তত দিন জিডিপির সঠিক হিসাবও পাওয়া যাবে না। আমি আগের এক লেখায় জনসংখ্যা হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। আইএমএফ ও ভিত্তিবছর নিয়ে প্রশ্ন করেছে। সরকার কতটুকু ঠিক করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, এর মধ্যেই মাথাপিছু আয় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে আয় বৃদ্ধির কোনো প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।
যদিও ভর্তুকি বন্ধ করার ব্যাপারে সরকার সবচেয়ে সক্রিয়। তারা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এমনকি আইন পরিবর্তনও করে ফেলছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়া সত্ত্বেও এই দেশে কমানোর কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত দেখা যাবেও না। সঞ্চয়পত্রের সুদও কমিয়ে ফেলা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, একটা দেশের আর্থিক অবস্থা বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় সেই দেশের ব্যাংক খাত দেখা। আর আমরা এখানে চরমভাবে ব্যর্থ। প্রথমত, রাজনৈতিক বিবেচনায় এত ব্যাংক দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশের ব্যাংকের সংখ্যা ভারতের থেকেও বেশি। আমরা কি ভারতের থেকেও বড় অর্থনীতির দেশ?
তারপর ব্যাংক খাতে এত এত লুটপাটের কথা শোনা যায়, তাদের কি কোনো শাস্তি হয়েছে? একটাও না। আইএমএফ লোন কমাতে বলেছে। ফলাফল লোন তোলার চেষ্টা না করে সব পুনঃ তফসিল করার চেষ্টা চলছে। ব্যাংক আইনের সংস্কার করে যে পারিবারিককরণ করা হয়েছে, তা সংশোধনের কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
ব্যাংকের তারল্যসংকট নেই বলে বললেও এর মধ্যেও টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হচ্ছে। ডলার–সংকটের অভাবে এলসি করা যাচ্ছে না। ডলার–সংকটের কোনো সমাধানও দেখা যাচ্ছে না।
ইদানীং কালে ব্যাংকে টাকা রাখা সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতি। ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিয়ে লোন পুনঃ তফসিল করছে কিন্তু নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ হবেই কী করে, ডলার না থাকাতে মেশিন আমদানিও তো কমে গেছে। আইএমএফের পরামর্শ ছিল এলসি বন্ধ না করতে। এলসি বন্ধের ফলাফল হচ্ছে, ডিএইচএলের সূচক বলছে, বাংলাদেশের ব্যবসা আগামী বছর কমে যাবে। এসব নিয়ে অনেকেই কথা বলছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থায় নেওয়া হচ্ছে না।
দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। দেশের এক–চতুর্থাংশ ব্যাংকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক। চোর পালানোর পর পর্যবেক্ষক দিয়ে কী লাভ। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে এখন ১ হাজার টাকার নোট বেশ কম পাওয়া যায়, আবার ৫০০ টাকার নতুন নোটগুলোও সমসাময়িক সময়ের (এত তাড়াতাড়ি নোট নষ্ট হয়েছিল?)।
এদিকে, সরকারের সবচেয়ে সফলতার একটা খাত এখন সবচেয়ে ব্যর্থ এখন। ভর্তুকি না পাওয়ায় পিডিবি লোনে জর্জরিত। শেয়ার বিজের তথ্যমতে এখন থেকেও যদি আর নতুন চুক্তি না করাও হয় কুইক রেন্টাল চলবে ২০২৬ পর্যন্ত এবং ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ২০৫১ পর্যন্ত। কিন্তু গরম এলেই আমাদের আগের অবস্থায় চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
এর মধ্যে আইএমএফ বলেছে, ডলার রেট বাজারদরের ওপর ছেড়ে দিতে। যদি তা রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় এই রেট অন্তত ১৩০ শতাংশের কাছাকাছি বাড়বে। বাংলাদেশ কি সেই রেটে কাজ করার মতো প্রস্তুত? বছরে দুবার মুদ্রানীতি হয়তো করল। কিন্তু এত এত দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য কোনো কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? দেশের দুর্নীতি এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে, কিন্তু কোনো চেষ্টাই নেই। এখনো চেষ্টা নেই পাচার করা টাকা ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা।
পাশাপাশি খারাপ খবর হচ্ছে, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি থেকে আমাদের রেটিং নামিয়ে দেওয়া। ইতিমধ্যেই অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের এলসি নিতে চাইছে না, ডলারের সংকটের জন্য। এই রেটিং কমে গেলে আরও সমস্যা বাড়বে। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। যুদ্ধরত রাশিয়া কিন্তু তাদের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আগের অবস্থায় নিয়ে গেছে, আমরা পারছি না কেন?
এর মধ্যে নতুন রিপোর্টে আমাদের খাদ্যঘাটতির ৪৫টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের নাম। বলা হচ্ছে, আইএমএফের লোন পেলে সব সমস্যা কমে যাবে, কিন্তু আইএমএফের লোন দেওয়া হচ্ছে ‘ম্যাক্রো ইকোনমিকস স্ট্যাবিলিটি’ দেওয়ার জন্য। এই টাকা দিয়ে কি অন্য লোন শোধ করা যাবে বা এলসি করা যাবে? আইএমএফ লোন দিলেও তা দিয়ে কাজ নির্দিষ্ট করে দিবে, এটা আসলে এখন সব দাতাই করছে। আগে জাপান ছাড়া মনিটরিং কম হতো, কিন্তু এখন সবাই সিরিয়াস।
যেকোনো সমস্যা থেকেই বের হতে আগে সমস্যা স্বীকার করতে হবে, সমস্যা থাকলে সমাধান আসবেই। বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতি না কমালে, লোনের টাকা এবং পাচার করা টাকা ফেরত না আনতে পারলে দেশের কোনো সংস্কার কাজে আসবে না। আর কাজে না এলে আমাদের দুর্ভিক্ষের হুমকি থাকবে, সিন্ডিকেট ব্যবসা করবে, বেসরকারি চাকরিজীবীরা হুমকির মুখে পড়বে, ছোট ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়বেন, আর এই বিপদ থেকে বের করার দায়িত্ব নিতেই হবে সরকারকেই। কিন্তু সরকার তো কোনো সমস্যাই স্বীকার করছে না।
এসডব্লিউএসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ