শীতের মৌসুমের সঙ্গে প্রাণিকুলের খাদ্যসংকটও শুরু হয়। এজন্য অনেক প্রাণী নিজেদের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমকে স্থবির করে দিতে পুরো শীতকাল ঘুমিয়ে কাটায়। কোনো প্রাণী আবার অন্য উষ্ণতর এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।
তবে ছুঁচো এক্ষেত্রে একদম আলাদা। শীতের মাসগুলোতে বেঁচে থাকতে এ প্রাণী নিজের মস্তিষ্কের একটি বড় অংশ ‘খেয়ে ফেলে’। শীতে ছুঁচোরা তাদের মস্তিষ্ক খেতে খেতে চার ভাগের এক ভাগে নিয়ে আসে। এরপর বসন্তে আবার এ মস্তিষ্কের বেশিরভাগ অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে যায়।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট অব অ্যানিমেল বিহেভিয়ার-এর বিহেভিরাল ইকোলজিস্ট ডিনা ডেকম্যান তাই বলেছেন, ‘ছুঁচোদের থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’
মৌসুমের পালাবদলে প্রাণীর মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ ছোট ও বড় হওয়ার এ ঘটনাকে ডেনেল’স ফেনোমেনন বলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রাণী তার শরীরের ক্যালরি খরচ করা টিস্যুগুলো কমিয়ে ফেলতে পারে। ছুঁচোর পাশাপাশি গন্ধমূষিক ও বেজির ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঘটনা লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা।
স্রেফ কৌতূহলপরবশ হয়ে বিজ্ঞানীরা ছুঁচোর মস্তিষ্কের ক্ষয়-বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করছেন না। এ স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো কীভাবে নিজেদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে, তা বুঝতে পারলে চিকিৎসকেরা হয়তো মানুষের আলঝেইমার, মাল্টিপল এস্কলেরোসিস, ও অন্যান্য নিউরন-সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন।
পোল্যান্ডের ওয়ারশতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জীববিজ্ঞানী অগাস্ট ডেনেল। নাৎসিদের আক্রমণের আগ পর্যন্ত তিনি পাখি, বিভার, ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী নিয়ে কাজ করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোলিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তরুণ এ প্রাণীবিজ্ঞানী। তবে অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার থেকে কখনো তার মন সরেনি। জার্মানদের হাতে বন্দি হওয়ার পর তিনি যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্পে জীববিজ্ঞান নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
যুদ্ধের পর ডেনেল আবারও পুরোদস্তুর গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ল্যাবরেটরিতে পর্যবেক্ষণ করলেন, পোল্যান্ড ও বেলারুশের জঙ্গল থেকে ধরা ছুঁচোগুলো মৌসুমের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মস্তিষ্কের ক্ষয় ও বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম।
ছুঁচোদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার এ কৌশলে তারা শীতকালে শক্তি সঞ্চয় করে রাখলেও এর জন্য তাদেরকে একটা মূল্য চোকাতে হয়।
ডেকম্যানের গবেষক দল দেখেছেন, বালির স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে বের করার প্রতিযোগিতায় গ্রীষ্মকালে বড় মস্তিষ্কের ছুঁচো, শীতকালের ছোট মস্তিষ্কের ছুঁচোর চেয়ে বেশি সফল হয়েছে।
ডেকম্যান বলেন, এটা একধরনের আপস। মস্তিষ্ক ছোট করে তারা শক্তি সঞ্চয় করে, তবে এর ফলে তারা আবার কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে দক্ষতা হারায়।
কিন্তু এর পরে যা ঘটে, তা অসাধারণ। গ্রীষ্মকালে যখন ছুঁচোগুলোর মস্তিষ্ক পুনরায় বেড়ে ওঠে, তখন আবার এটির মস্তিষ্ক ব্যবহার করে খাবার সন্ধানের মতো কাজ করার ক্ষমতাও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
ডেকম্যান জানান, কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে ছোট মস্তিষ্ক থাকাটাই শ্রেয়—এ ধারণা অনেকে মেনে নিতে পারেন না। মানুষ মনে করে, আমাদের মস্তিষ্কের আকৃতি বড় বলে আমরা বেশি বুদ্ধিমান।
ছুঁচোরা এ কাজ কীভাবে করে তা বুঝতে পারা গবেষকদের জন্য পরবর্তী ধাপ। প্রাণীটির মস্তিষ্ক অভিন্নভাবে বেড়ে ওঠে না। মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস বিস্তৃত হতে হতে স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু একই সময়ে নিওকর্টেক্স অংশ বাড়ে না। মস্তিষ্কের এ দুটো অংশই স্মৃতিশক্তির সঙ্গে জড়িত।
গবেষকেরা ধারণা করেন, ছোট এ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শরীর শীতকালে টিকে থাকার জন্য মস্তিষ্কের কিছু অংশ খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।
জীববিজ্ঞানীরা বর্তমানে ছুঁচোর এ মস্তিষ্ক পরিবর্তনের পেছনে কী কী প্রোটিন ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান কাজ করে তা অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন। তবে কোনো ফলিত ফলাফল পেতে এখনো দেরি হবে বলেই জানিয়েছেন তারা।
এ প্রোটিন ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান খুঁজে পেলে মানুষের মস্তিষ্কসংক্রান্ত অনেক রোগের চিকিৎসার উপায়ও খুলে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
এসডব্লিউএসএস/০৯২০
আপনার মতামত জানানঃ