প্রায় ১৪ বছর ধরে বেশ দাপটের সঙ্গেই ক্ষমতায় টিকে আছে দলটি। ক্ষমতায় যাওয়া এবং ধরে রাখা যদি চূড়ান্ত কথা হয়ে থাকে, তাহলে রাজনীতির ‘খেলায়’ অন্যদের চেয়ে এখন পর্যন্ত বেশ বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছে তারা। গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে যেভাবে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ, তা নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন আছে। প্রথমবার (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি) বিনা ভোটে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই জয় নিয়ে এসেছিল দলটি। তখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের কৌশল কাজে লাগেনি। দ্বিতীয়বার (২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর) আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। যদিও ওই নির্বাচনে ‘আগের রাতেই ভোট’ হয়ে যাওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ, ‘মেজর না মাইনর’ এই তর্ক–বিতর্কের মধ্যেই ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদেরও চার বছর পার করতে চলেছে আওয়ামী লীগ।
এত কিছুর পরও কোন জায়গায় আওয়ামী লীগ শক্তি–সামর্থ্য দেখাতে পারছে না—সেটি রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ফেসবুকে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি ‘একেবারেই দুর্বল’। বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে (এক অর্থে দলেরও) নানা অপপ্রচার হলেও এসবের কাউন্টার (পাল্টা জবাব) দেওয়া হয় না। মিথ্যাচার ও বিষোদ্গারের জবাব দলের নেতা–কর্মীরা ঠিকমতো দিতে না পারায় নিজের আক্ষেপের কথাও বলেছেন তিনি।
১৪ নভেম্বর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির বৈঠকে কখনো ক্ষোভ, কখনো আক্ষেপের সুরে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রচার উপকমিটির সদস্যদেরও ফেসবুকে সরব উপস্থিতি তিনি দেখেন না। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার (অনলাইনে) চলছে—এ কথা জানিয়ে সেদিন দলের নেতাদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এগুলোর (অপপ্রচার) জবাব আপনারা দেবেন না?’
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার একক কৃতিত্ব দাবি করা আওয়ামী লীগ ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কেন দুর্বল থাকবে—সেটি নিয়ে এখন দলের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে।
গুজব ও অপপ্রচার ঠেকাতে এক লাখ ‘অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট’–এর সমন্বয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু করার কথা গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিল আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপকমিটি। তখন দলের পক্ষ থেকে ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারকৌশল’ শীর্ষক কর্মশালারও আয়োজন করা হয়। এক বছর পরও ‘নিজের মতো করে সত্য বলার’ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের অগ্রগতি যে নেই, সেটি ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেই স্পষ্ট।
হেলমেট পরে লাঠি হাতে রাজপথে মহড়া দিলে বা প্রতিপক্ষকে পেটাতে পারলে অনেক নেতার ‘সুনজরে’ আসা যায়, বাহবা পাওয়া যায়—এমন আলোচনাও রাজনৈতিক অঙ্গণে রয়েছে। রাজপথে সব সময় সক্রিয় থাকা নেতা–কর্মীদের কারও কারও মতে, প্রতিপক্ষের মিছিল–সমাবেশ ঠেকাতে রামদা ও অস্ত্র নিয়ে মাঠে থাকলে নিজেদের ‘ইজ্জত’ বৃদ্ধির পাশাপাশি দলের জন্যও ‘অবদান’ রাখা যায়। এই ‘কৃতিত্বের’ জন্য সময়–সুযোগ হলে দলীয় পদ বাগানো যায়, আবার কখনো উন্নয়নকাজে ‘সাব–কন্ট্রাক্ট’–এ কিছু করে খাওয়ার সুযোগ হয়।
তবে রাজপথে শক্তি দেখিয়ে নিজের ‘জাত’ বোঝাতে পারলে সব সময় পুরস্কারসহ নানা প্রাপ্তিযোগ যে হবেই, তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে বিপদও আসে। বিশেষ করে এসব ‘অবদানের’ ছবি–ভিডিও, ফেসবুক–ইউটিউবে চলে গিয়ে ‘ভাইরাল’ হলে সমস্যায় পড়তে হয়। কখনো এ নিয়ে নেতারা বিব্রত হন, আর খুব বেশি সমালোচনা হলে এবং ভাগ্য সহায় না হলে ‘নিজস্ব গতির’ কথা মনে করিয়ে দেয় আইন।
আবার রাজপথে ঘণ্টাখানেকের মহড়া যত দ্রুত ‘সম্মান’ এনে দেয়, নিজেকে ‘নজরে’ নিয়ে আসা যায়, সেটি অনলাইনে সম্ভব নয়। দলের পক্ষে অনলাইনে কিছু বললে–লিখলে বা ভিডিও পোস্ট করলে সেটা যে বড় কোনো নেতার নজরে আসবেই—এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আর নিজের মতো করে কিছু বললেও, পাল্টা বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়ার মতো ‘দুর্জনেরা’ অনলাইনে ঘোরাফেরা করে। খণ্ডিত, অপূর্ণাঙ্গ কিছু বললে নাস্তানাবুদ হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। অনলাইনে ‘নিজের মতো করে সত্য বলার’ কৌশল রপ্ত করাও এখন বড় গুণ। এটি ঠিক প্রতিপক্ষকে মেরে–কেটে রাজপথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো কাজ নয়। ফলে নিজেদের আনন্দ–উৎসবের ছবি–ভিডিও বা প্রিয় নেতার সঙ্গে তোলা সেলফি ফেসবুকে দিয়েই বেশির ভাগ নেতা–কর্মী নিজেদের অনলাইন কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ রাখেন।
ফেসবুক–ইউটিউবে গুজব ঠেকাতে ও প্রতিপক্ষকে সঠিক জবাব দিতে না পারার বিষয়ে নিজের আক্ষেপের কথা জানিয়ে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়েছিলেন ময়মনসিংহ-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ। অপপ্রচার ও মিথ্যা গুজব ছড়ানোর অভিযোগ এনে ইউটিউব বন্ধ করে দেওয়ার দাবিও তিনি সংসদে তুলেছিলেন।
গত ১৭ জানুয়ারি সংসদে তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে দেখি খালেদা জিয়া মরে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা কালকেই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাচ্ছেন। আবার দেখি, সেনাপ্রধানদের টেনে নামানো হচ্ছে। এভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয় কী করে, আমরা বুঝি না।’
ফেসবুকে সরকারের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা হয়, তার জবাব দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্য সরকারের, দলের নেতা–কর্মীদের নয়। যদিও সরকারের সব অন্যায়, নিপীড়নমূলক আচরণের দায় দিন শেষে ক্ষমতাসীন দলকেও নিতে হয়। দলের বিরুদ্ধে যেসব অপ্রপ্রচার হয়, তার জবাব দেওয়ার দায়িত্ব নেতা–কর্মীদের, সেখানেও যে নেতারা খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না, সেটিও ১৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে পরিষ্কার। দলের যেসব নেতা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নিয়মিত টক শোতে যান, তাঁদের ‘পারফরম্যান্সেও’ বেশ হতাশ তিনি। তাঁর মতে, অপপ্রচারের কাউন্টারটা (পাল্টা জবাব) যথাযথ না হলে কাউন্টার করে লাভ নেই।
কেন প্রতিপক্ষকে অনলাইনে ঠিকমতো কাউন্টার দেওয়া যায় না, কেন অপপ্রচারের জবাব দেওয়া যায় না—সেটি অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের আরেক বক্তব্যেই পরিষ্কার। গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় দলের এক অনুষ্ঠানে নেতা–কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন—এগুলো বন্ধ করেন।’
পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেছে যে তৃণমূলের কমিটির (ঢাকার খিলগাঁও থানা) সম্মেলনেও দল বাঁচাতে নেতা–কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাতে হচ্ছে এখন। তবে টাকাপয়সার লেনদেন তৃণমূলেও কেন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল, সে বিষয়ে সেদিন কিছু বলেননি ওবায়দুল কাদের। কিন্তু এর পরিণতি অনলাইনে ও অফলাইনে (বাস্তবে ঘটা) কী হতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। এই সতর্ক বার্তা কতোটা বিবেচনায় নিলেন তৃণমূলে ও কেন্দ্রে ‘দাপট’ দেখানো নেতা–কর্মীরা তা জানতে আগামী জাতীয় নির্বাচন (অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ) পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ