বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা থেকে : ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর ও সংবাদপত্র’ শীর্ষক এক বক্তৃতা আয়োজনে সংবাদপত্র শিল্পের নানা সঙ্কট ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন দেশের শীর্ষ দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। কিন্তু প্রধান বক্তার দীর্ঘ ভাষণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা বললেও সংবাদকর্মীদের জন্য একটি শব্দও খরচ করেননি তিনি। পুরো ভাষণে সংবাদকর্মীদের চিন্তা ও কাজের পরিবেশ কিংবা তাদের বেতন-ভাতা ও ছাঁটাইয়ের মতো বিষয়গুলো একবারও স্পর্শ করেননি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই সম্পাদক।
সভার মধ্যেই উপস্থিত সংবাদকর্মীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হন তিনি। একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেন, ৫০ বছরের অভিজ্ঞ সম্পাদকের প্রজ্ঞার প্রতিফলন দেখা যায়নি ওই ভাষণে। অনুষ্ঠান শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে মতিউর রহমান স্বীকারও করে নেন যে, বক্তৃতার জন্য তিনি খুব ভালো প্রস্তুতি নিতে পারেননি। উপস্থিত অপর এক সাংবাদিক মন্তব্য করেন যে, মতিউর রহমান সংবাদপত্রের একজন মালিক হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন, সাংবাদিক হিসেবে নয়।
পরবর্তীতে স্টেটওয়াচের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে ওই সংবাদকর্মী বলেন, ‘সাংবাদিকদের চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা ছাড়া সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার আলাপ অর্থহীন। অথচ এটা আমাদের অবাক হয়ে দেখতে হলো যে, দেশের শীর্ষ পত্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্পাদক সংবাদপত্র নিয়ে আধ ঘণ্টার বেশি কথা বলেন, পত্রিকার লাভ-ক্ষতির হিসাব তিনি তুলে ধরেন, কিন্তু তার আলাপে কোথাও সংবাদকর্মীদের কথা উঠে আসে না। সংবাদকর্মীদের বেতন নেই, অধিকার নেই, তাদের দাবি-দাওয়া উপেক্ষিত, এই সমস্যার সমাধান হয়নি ৫০ বছরে। সংবাদপত্রের আলাপে তো এর চেয়ে জরুরি আর কিছু হতে পারে না। মতিউর রহমান সাংবাদিকদের প্রতিনিধি নেই। সাংবাদিক হলে তিনি সংবাদকর্মীদের পক্ষেই আগে দাঁড়াতেন। বাস্তবে তিনি দাঁড়িয়েছেন সংবাদপত্র মালিকদের স্বার্থের পক্ষে। সম্পাদকের দায়িত্বটি এক্সিকিউটিভের পদে রূপান্তরিত হচ্ছে, এটা হতাশাজনক।’
রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট্রের ৪০০তম সাপ্তাহিক এই পাবলিক লেকচারটি আয়োজিত হয়েছে অনলাইনে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল শনিবার সন্ধ্যায়। এতে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনারারী অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত গুণীজনদের মধ্যে ছিলেন গোলাম মুরশিদ, আলী রিয়াজ, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ডা. শুভাগত চৌধুরী, আবুল বারকাত, এম এম আকাশ, অধ্যাপক জাকির হোসেন রাজু, অধ্যাপক জাকিয়া আফরিন প্রমুখ।
স্টেটওয়াচ ডটনেট ওই আলোচনা অনুষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ বিবরণী জোগাড় করেছে। মতিউর রহমানের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংবাদকর্মীদের অধিকারের প্রশ্নটি উপেক্ষিত থাকলেও এতে উঠে এসেছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে সংবাদপত্রের ওপর দমন নিপীড়ন ও হস্তক্ষেপের কথা। এছাড়া কোভিড সংকট, মহামারী ও সংবাদপত্রের ডিজিটাইজেশনের বিষয়েও আলোকপাত করেছেন তিনি। সম্পাদক মতিউর রহমানের আলোচনার বিশদ অংশই এখানে তুলে ধরা হলো।
পাকিস্তানে সাংবাদিকতার সূচনা
বক্তব্যের সূচনায় মতিউর রহমান বলেন, ‘এটা আমার জন্য আনন্দের যে, আমার সাংবাদিকতা জীবনের বয়স হলো ৫০ বছর। ২৫ মার্চ সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগে আমি সরাসরি সাংবাদিকতায় যুক্ত হই। ১৯৭০ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক একতা। সম্পাদক বজলুর রহমান আর আমি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। প্রায় এক দশক ছাত্ররাজনীতি শেষে এভাবেই আমার সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয়েছে। সাপ্তাহিক একতা সে সময় বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ছিল।’
শেখ মুজিব আমলে
পত্রিকা বন্ধ করার পাকিস্তানি সংস্কৃতির পর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে মতিউর রহমান জানান, ‘স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালে দ্রুত আবার সাপ্তাহিক একতা বের করল। সারা দেশব্যাপী তখন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে পত্রিকা প্রচার বাড়তে থাকল কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর, ৭৫ সালের জুন মাসে, আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশে একদল বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে, শুধু চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সকল সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেল। তখন আমাদের সাপ্তাহিক একতাও বন্ধ হয়ে গেল। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সহ পরিবারের সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল। এবং সামরিক শাসন জারি করল। সংবাদপত্র বন্ধ থাকল।’
সামরিক জান্তার যুগে
সামরিক শাসনামলে সংবাদপত্রের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মতিউর রহমান বলেন, ‘ধীরে ধীরে সীমিত আকারে রাজনীতি শুরু হলে একতা আবার প্রকাশিত হল। ভুল না হলে সেটা ১৯৭৮ সাল। তখনো সামরিক শাসন চলছে। অনেক কিছু লেখা যেত না। চাপ ও ভয়ে কাজ করত আমাদের। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসন এলো নতুন করে চাপ, ভয় ভীতির মধ্যে পত্রিকা প্রকাশ করতে হত। ১৯৮৬ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর, এরশাদ সরকার একতা প্রকাশ আবার বন্ধ করে দিল। দু’বছর পর একতা আবার শুরু হল ৮৭ বা ৮৮ সাল।’
৯০ পরবর্তী গণতন্ত্রে
সামরিক বা বিশেষ ক্ষমতার আমল নয় কথিত গণতান্ত্রিক পর্বেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খুব ভালো ছিল না বলে জানান প্রথম আলো সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘৯০ এর গণ আন্দোলনের পর (১৯৯১ সালের) নির্বাচনে জয়ী হলে বিএনপি সরকার গঠন করল। ১৯৯২ সালের শুরুর দিকে দৈনিক ভোরের কাগজ বের করল। আমি সম্পাদক ও প্রকাশক। কিছু সময় পর ১৯৯৩ সালে সরকার ভোরের কাগজের সকল সরকারী বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করে দিল। বেশ কিছু দিন আন্দোলন, মিছিল, প্রচারণার পর আমরা পুনরায় সরকারের বিজ্ঞাপন ফিরে পেলাম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলো। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরের শুরুতে আমরা প্রথম আলো শুরু করলাম। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম আলোর সরকারি বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিল। এবার শুধু বিজ্ঞাপন বন্ধ নয়, তখন প্রথম আলোর অনলাইন সংবাদ প্রচার পুরোপুরি বন্ধ করে দিল।
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসলে সরকারের বিজ্ঞাপন আমরা ফিরে পেলাম, অনলাইন পত্রিকায় সংবাদ দেওয়া পুনরায় শুরু হল। নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলো। কিছু দিন পরে আবার সেই একই অবস্থা, প্রথম আলোর জন্য সরকারের বিজ্ঞাপন বরাদ্দ করে দেওয়া হলো দৈনিক মাত্র ১০ ডলার ইঞ্চি বিজ্ঞাপন আমরা পাব। এই সিদ্ধান্ত জানার পরদিনই আমরা গেলাম তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের কাছে। আমরা গিয়ে বললাম, আমরা বিজ্ঞাপন চাইতে আসিনি, শুধু একটি কথা আপনাকে বলতে চাই, সেটা হল, যে সরকার সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যে সরকার সব সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয় তারা পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত হয়। এটাই বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে বলে। আসলেই বিএনপি’র সেই সরকার যে অবস্থা তৈরি করেছিল, তার বিজয়ের আর কোনো সম্ভাবনা পরবর্তী নির্বাচনে ছিল না।’
শেখ হাসিনা আমলে
মতিউর রহমান আরো বলেন, ‘২০০৮ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আসে, শুরুতে না হলেও ধীরে ধীরে প্রথম আলোর প্রতি তাদের বৈরিতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। এখানে উল্লেখ করা যায় ২০১০ সালে ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সংসদে দীর্ঘ সময় ধরে প্রথম আলো এবং এর সম্পাদকের বিরুদ্ধে একাধিক মন্ত্রীসহ বেশ কয়েক জন সাংসদ তীব্র আক্রমণ করেছিল। গ্রেপ্তার ও সংসদে তলব করার দাবী করেছিল। মনে আছে ২০০১ সালে তখনও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, সে বছর ১২ এবং ২৬ জুন জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে সংসদে অত্যন্ত কুৎসিত, নোংরা আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। তবে আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুবারই স্পিকারের নির্দেশে এসব বক্তব্য সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
২০০৯ সালের পর থেকে প্রথম আলোকে নানা চাপে থাকতে হচ্ছে বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে। বিশেষ করে ২০০০ সালের মাঝামাঝি থেকে, সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশে বড় বড় ৪৮ কোম্পানির বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখনো বেশ কিছু কোম্পানি তারা বিজ্ঞাপন নিয়ে ফিরে আসেনি। এখন পর্যন্ত অনেক সরকারি মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও বন্ধ রয়েছে আমাদের জন্য, সরকারের ক্রোড়পত্রের মধ্য শুধু তথ্য মন্ত্রণালয়ের ক্রোড়পত্র আমাদের দেওয়া হয়। অন্য কোনো সরকারি ক্রোড়পত্র অনেক বছর ধরে প্রথম আলোকে দেওয়া হয় না। আর নানা প্রচারের মাধ্যমে সরকার ও প্রশাসনের ভেতরে প্রথম আলোর জন্য একটি বিরূপ পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। এভাবেই বলা যায় বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারের আমলে একতা বলেন, ভোরের কাগজ বলেন, প্রথমা আলো বলেন, আমাদেরকে নানা ঝামেলায় ও নানা রকম হয়রানির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে।
এসবের বাইরে মামলা মোকদ্দমায় জোড়ানো হচ্ছে, সকল সরকারের আমলে এটা হয়েছে। এখনো দেশের নানা স্থানে অনেক মামলা রয়েছে। ২০১৫ সালে ঝিনাইদহে আমাদের স্থানীয় সাংবাদিক ও আমার বিরুদ্ধে ৮টি মামলা ৮টি মানহানি ও দুটি চাঁদাবাজি মামলা দেওয়া হয়েছিল। সে সময়ের মন্ত্রী আমাদের বিরুদ্ধে সংসদে ৩ দিন ৩টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আগের বছর এই সময় একদিনে ৫ জেলায়; ঠাকুরগাঁও, ঝালকাঠি, বরিশাল, কুড়িগ্রাম ও ঢাকায় ৫টি অসত্য মামলা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি জায়গাতে আমাদেরকে যেতে হয়েছে নিয়মিতভাবে। এখনো সে ধারা অব্যাহত রয়েছে।’
মামলা মোকদ্দমার বর্তমান চিত্র
মতিউর রহমান মামলা মোকদ্দমার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘এখনো সেই বিভিন্ন জেলায় গিয়ে মামলার হাজিরা দিতে হয়। এখনো হিসাব করে দেখা যায় দেশজুড়ে প্রায় ৫০টির মত মামলা রয়েছে আমার এবং আমার সহকর্মী বন্ধুদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে ১ বছর ধরে একটি ছাত্রের দুঃখজনক মৃত্যুর পর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট জজ কোর্ট হাইকোর্টে যাওয়া আসা করছি, এখন আপিল বিভাগ বাকি আছে, সেখানে অর্থাৎ চেম্বার জজের কামরায় একবার শুনানি হয়েছে, ৬ মাসের জন্য স্থগিত রয়েছে মামলা, অথচ এই ঘটনায় সরকারের তদন্ত রিপোর্টে আমার কোনো নাম নেই। আমি সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলামও না। কোনোভাবেই যুক্ততা আমার নেই। তবুও আমার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা হয়েছে, চলছে, স্থগিত।’
মহামারি ও সাংবাদিকতা
বিশ্বজুড়ে কোভিডের ভয়ঙ্কর রূপের চিত্র তুলে ধরে মহামারির এই যুগে সংবাদপত্রের করণীয় আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘চলমান কোভিডকালে বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্র শিল্প গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। সারা বিশ্বের অনেক ছোট বড় সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। সংবাদপত্র ছোট হয়ে গেছে, পৃষ্ঠার সংখ্যা কমে গেছে। টিকে থাকতে সংবাদ পত্রের ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে। দেশে দেশে সংবাদপত্র ছাপা কমেছে বিক্রিও কমেছে। বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে গেছে। বাংলাদেশেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। দেশের পরিচিত প্রায় সকল সংবাদপত্রের বিক্রির সংখ্যা অর্ধেক বা তার চেয়েও নিছে নেমে গেছে। শুরুতে এর পরিমাণ বেশি ছিল। বিজ্ঞাপন থেকে এখন কিছু আয় হলেও তা অর্ধেক পরিমাণে নেমে গেছে। এভাবে দেশে সংবাদপত্র সংকলন অনেক কমে গেছে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
চলমান কোভিড কালে সংবাদপত্রের বিষয় আবার অন্যদিকে নতুন কিছু ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। বিগত এক দশক ধরে আমরা জানতাম যে, ছাপা সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ ভালো নয়। পাঠক কমে যাবে। বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাবে। পাঠক সংবাদ পড়বে অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে, সেজন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছিলেন বিশেষজ্ঞরা। আমরাও প্রথম আলোতে কিছু কিছু উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলাম। আসলে চলমান কোভিডকালে এর বাস্তবতা, সত্যতা আমরা দেখলাম। এই কমে যাওয়ার প্রবণতা এই কোভিডকালে দ্রুততর, আরো বেশি সংখ্যায় পাঠক কমে গেল। আয় কমে গেল।
আমরা দেখছিলাম যে, কোভিডকালে কম্পিউটার, আইপ্যাড, ল্যাপটপের মাধ্যমে ধীরে ধীরে অনলাইনে সংবাদ পাঠক বাড়ছে। ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু এই কোভিডকালে এই ধারা আরো দ্রুত হয়ে আরো বেড়ে গেছে। আমরা প্রথম আলো থেকে দেখছিলাম, যে ২০১৫-১৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে পাঠক সংখ্যা কমছে, তারা অনলাইনে সংবাদ পড়ছে। এ সময় থেকে ছাপা পত্রিকার পাঠকও কমতে লাগল, একই সময় এবং এটাও দেখলাম, যে ধীরে ধীরে অনলাইন এবং সামাজিক মাধ্যমে পাঠক বাড়ছে। আর এগুলোর সঙ্গে কিছু উদ্যোগ নেয়াতে, আমাদেরও পাঠক বাড়ছে অনলাইনে।’
সংবাদপত্রের ডিজিটাইজেশন
আজকের যুগে সংবাদপত্র টিকে থাকতে হলে ডিজিটাইজেশনের গুরুত্ব বিশাল। মতিউর রহমান বলেন, ‘ভবিষ্যতে কখনই সংবাদপত্রের পাঠক, সংবাদপত্রের আয় আগের যায়গায় আর পৌঁছাবে না। অন্যদিকে যা বললাম, বাংলাদেশে এবং সারা বিশ্বজুড়ে অনলাইনে সংবাদ পাঠক বেড়ে চলেছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে তাই আমরা দেখছি, শুধু সংবাদ না আমরা দেখি অনলাইনে ডিজিটালে পাঠক অনেক বেশি ছবি দেখছে, ভিডিও দেখা অনেক বেড়ে গেছে। এভাবেই সারা বিশ্বজুড়ে এ সকল মাধ্যমে সংবাদ পাঠের মানুষ অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। আবার অন্যদিকে যেমন পাঠক বাড়ছে অনলাইন ডিজিটালে সেভাবে বিজ্ঞাপনের অন্যান্য ভাবে আয়ের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পারছি; অনলাইনে, ডিজিটালে। সারা বিশ্বে সংবাদপত্র সে পথেই যাচ্ছে। ইউরোপ বা আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশগুলির সংবাদপত্র এই পথেই নতুন পথের সম্ভাবনা তারা দেখতে পাচ্ছে। কোভিডকালে এটা আরো বেশি করে প্রমাণিত।
নিউইয়র্ক টাইমসের অভিজ্ঞতা একসময় আমরা শুনতাম, এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল। কিন্তু তারা সাহস করে ডিজিটালের পথে যাত্রা শুরু করে বিগত এক দশকের মধ্যে তাদের আয় বেড়ে গেছে। অনলাইনে তাদের পাঠক বেড়ে গেছে এবং সাবস্ক্রিপশন মাধ্যমে সংবাদপত্র বিক্রি করে যা আয় হত, তারচেয়ে বেশি আয় হত তাদের অনলাইনে। আমাদের বাংলাদেশেও এসব অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আমাদেরকে চলতে হবে। আমরা প্রথম আলোতে এই পথের যাত্রা শুরু করেছি এবং কিছু সফলতাও পাচ্ছি। এই ডিজিটাল অনলাইনে যে নতুন আয়ের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং আগামী বছর গুলোতে আমরা এটা বলতে পারি যে, ছাপা পত্রিকা থেকে আয়ের পাশাপাশি আমাদের অনলাইন, ডিজিটালে আয়ের সম্ভাবনা বাড়ছে তার বাস্তবতা আমরা দেখতে পাচ্ছি।…
আমাদের প্রথম প্রধান লক্ষ্য ডিজিটাল প্রথম আলো। এবং সেখান আমাদের সকল উদ্যোগ চেষ্টা এবং ব্যয় আমরা করতে চাই। সে লক্ষে আমরা বিগত ৩ মাস ধরে আমাদের ছাপা এবং আমাদের অনলাইন একত্রিত করে ইন্ট্রিগ্রেটেড নিউজ রুম করে ফেলেছি। যেখান থেকে এক সঙ্গে আমাদের সাংবাদিকরা আমাদের প্রিন্ট, আমাদের অনলাইন, আমাদের সোশাল মিডিয়াতে সকলেই মিলিতভাবে, সকলেই এই ধারাতে কাজ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের সংবাদপত্র ছাপা কাগজকে অব্যাহতভাবে শক্তিশালী করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, সেখান থেকে আয় বৃদ্ধির চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। যেটা নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, তারা ২০২৫ সাল পর্যন্ত ছাপা নিউইয়র্ক টাইমস থেকে তাদের আয়ের পথের অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবে।’
সংবাদপত্রের বিকাশের সংকট
বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রচার মাধ্যমের একটি গৌরবময় অতীত রয়েছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেছে সংবাদপত্র। স্বাধীনতার পর এর দশকের সরকার আমলে এবং বিভিন্ন সরকার আমলে চাপ ভয় ভীতি নানা আক্রমণ মামলা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সত্যেও এখনো স্বাধীন সংবাদপত্র দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন, সংবাদপত্র প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা অন্যান্য বিষয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছে। আমরাও চেষ্টা করছি। যদিও বিগত তিন দশকে দলীয় রাজনীতি ও ব্যবসায়ীক স্বার্থে অনেক কাগজ, অনেক সংবাদপত্র, অনেক টেলিভিশন, অনেক রেডিও, অনেক অনলাইন কাজ করছে। রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত সংবাদপত্র সাংবাদিক সমাজের বিভক্তি একটা সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে সমস্যা তৈরি করে চলেছে। এসব সত্ত্বেও আমাদের চেষ্টা থাকবে এবং আছে। সংবাদপত্রের অনলাইনে সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে, দেশের সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক বিকাশে অধিকতর একটা ভূমিকা পালন করে যাওয়া এবং সে ভূমিকা পালন করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।’
মতিউর রহমান তার অভিজ্ঞতার সার সংকলন করে বলেন, ‘বিগত ৫০ বছর ধরে সাপ্তাহিক একতা থেকে প্রথম আলো পর্যন্ত এবং প্রথম আলোর ২২ বছরের অভিজ্ঞতায় যে কথাগুলো আমরা দেখতে পাই সেগুলো হল; বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাকে সত্যিকারের সফলতা পেতে হলে পত্রিকাকে হতে হবে দল নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন। বিশেষ করে আমাদের দেশের মত বিভক্তির সমাজে এটাই সত্য এবং বাস্তব। সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ হল এখানে সঠিক তথ্যনির্ভর সাংবাদিকতা করে নিজেদের আয় দিয়ে সংবাদপত্রকে পরিচালনা করতে হবে। একইসঙ্গে আদর্শ-লক্ষ্য থাকতে হবে সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চেতনা, যা হবে সবসময় গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতা এবং মানবিকতার স্বপক্ষে।
সংবাদপত্রকে হতে হবে আধুনিক, সত্য প্রকাশে সাহসী, একইসঙ্গে অনুসন্ধানী বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন এবং ব্যাখ্যা প্রকাশ করতে হবে। একইসঙ্গে দেশ মানুষের ইতিবাচক সফলতার কাহিনীগুলো আমাদেরকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। এতে করে মানুষ আরো উৎসাহিত অনুপ্রাণিত বোধ করবে।’
শ্রুতি লিখন : মহিন রাসেল
ছবি : প্রথম আলো ও রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট
এসডাব্লিউ/এসএন/এমআর/২১১০
আপনার মতামত জানানঃ