মা-বাবাসহ বিমল শীলের পরিবারের ১১ সদস্যকে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সেটা ১৯ বছর আগের কথা। স্বজন হত্যার বিচারের জন্য এতটা বছর আদালতে ঘুরছেন বেঁচে যাওয়া একমাত্র সদস্য বিমল। কিন্তু মামলার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ তিনি। সেই সঙ্গে আছেন সংশয়েও। বিমল গণমাধ্যমকে বলছিলেন, ‘বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছি।’
আজ শুক্রবার চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ১৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় সংখ্যালঘু পরিবারের ১১ জনকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাচক্রে সেদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ওই পরিবারের এক সদস্য বেঁচে যান। বিমল শীল সেই একজন।
তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। ৫৭ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। ৩৮ আসামির ৩৭ জনই জামিনে। বছরের পর বছর শুধু মামলার তারিখ পড়ছে। কিন্তু সাক্ষীরা হাজির হচ্ছেন না। সর্বশেষ ২০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য থাকলেও সাক্ষী হাজির না হওয়ায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। মামলার খোঁজ নিতে নিতে ক্লান্ত বাদী বিমল শীল। আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ রয়েছে।
ঘটনার দিন রাতে বাঁশখালীতে পুড়িয়ে মারা হয় বিমল শীলের বাবা তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), মা বকুল শীল (৬০), ভাই অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২) এবং অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল।
বিমল শীলের চাচাতো বোন বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), এনি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা তাঁর খালু দেবেন্দ্র শীল (৭২)। পল্লিচিকিৎসক বিমল শীল সেদিন লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার পর থেকে তিনি বাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে থাকছেন। খালি পড়ে আছে ভিটেমাটি। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ফুল দেওয়া হয়।
বিমল শীল বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে গেলে মনে হয় নিহত স্বজনেরা জিজ্ঞেস করছেন আসামিদের শাস্তি কবে হবে। কিন্তু শ্মশানের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের কিছুই বলতে পারিনি। তাঁদের যে কবে বলতে পারব, আসামিদের শাস্তি হয়েছে, জানি না।’
আলোচিত মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিষ্পত্তি করা উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ১৯ বছরেও শাস্তি না হওয়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে। যার কারণে এসব ঘটনা বাড়বে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পর পরই ওই সময় এলাকাবাসীর মুখে মুখে চাউড় হয় এবং বাদীপক্ষের অভিযোগ ওঠে, মূল হত্যাকারী কালীপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান চৌধুরী। কিন্তু ওই সময় তার চাচাতো ভাই জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বাঁশখালীর এমপি এবং তৎকালীন সরকারের বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
এ কারণে বাদী বিমল শীল এজাহারে আমিনুর রহমান চৌধুরীকে আসামি দিলেও পুলিশ চার্জশিট থেকে আমিনুর রহমান চৌধুরীর নাম বাদ দেন। এভাবে বাদীর চার্জশিটে নারাজি এবং পুলিশের মূলহোতাকে বাদ দিয়ে ৩য় বার পর্যন্ত চার্জশিট প্রদানের ঘটনা ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে অধিকতর তদন্তে সিআইডি সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আমিনুর রহমান চৌধুরীসহ ৩৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়। এর কিছুদিন পর আদালত চার্জশিট গ্রহণ করলে আমিনুর রহমান চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। তিনি জামিনে এসে হাইকোর্টে রিট করে মামলা স্থগিত করে দেন। এভাবে অন্তত ৩ বছর মামলার গতিপ্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে যায়।
পরে বাদীপক্ষ হাইকোর্টে নানাভাবে শুনানীতে অংশ নিলে হাইকোর্ট ২০১৮ সালে ২৩ জুন আসামি আমিনুর রহমান চৌধুরীর রিটাদেশ বাতিল করে চট্টগ্রাম জজ আদালতকে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দেন। এই আদেশও যাতে দ্রুত কার্যকর না হয় সেজন্য বাদী ও সাক্ষীকে আসামিরা জামিনে ও পলাতক থেকে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমাকি দিচ্ছেন।
আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার ২৫ মাস পর পুলিশের দেওয়া প্রথম অভিযোগপত্রে বাঁশখালীর বিএনপি নেতা আমিনুর রহমানের নাম বাদ দেওয়া হয়। বাদী নারাজি দিলে আদালত পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর পুলিশ আবারও আমিনুরকে বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এবারও বাদী নারাজি দেন।
সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আমিনুরসহ ৩৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তবে আমিনুরের দাবি, রাজনীতি করার কারণে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁর নাম জড়ানো হয়। এর মধ্যে এক আসামির নাম রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
গত দেড় বছরে একজন সাক্ষীকেও হাজির করা যায়নি কেন জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছি। এরপর মামলার বাদীকে নিজে ডেকে এনে কথা বলেছি। আগে কি হয়েছে, জানি না। আগামী ধার্য দিনে সাক্ষীকে হাজির করতে এসপি ও ওসির সঙ্গে নিজে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করব’। কবে নাগাদ এই মামলা নিষ্পত্তি হতে পারে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে অবশ্যই শেষ করা হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ