আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, যেভাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ হিসাব করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। তারা যেভাবে হিসাব করতে বলেছে, সে অনুযায়ী দেশে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে।
আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে গত ৯ই নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশে এখন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে যা, থাকবে, সেটাই নেট রিজার্ভ। সেই হিসাবে দেশে নেট রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার।
এরই মধ্যে, একদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঢাকা শহরে থাকার মতো বাসা পাচ্ছেন না, অন্যদিকে সারি সারি সরকারি ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। জনগণের অর্থ অপচয়ের একটি প্রকৃষ্ট নমুনাই বটে।
কয়েশ কোটি টাকার অপচয়
সূত্র মতে, সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের আবাসনের সুবিধার্থে রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের কাঠের কারখানা এলাকায় পাঁচটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এসব ভবনের অধিকাংশ ফ্ল্যাট দুই বছর ধরে খালি।
কর্মকর্তারা যেতে আগ্রহী না হওয়ায় একই সেকশনের শিয়ালবাড়ী এলাকার ছয়টি ভবন গত জুন থেকে ফাঁকা পড়ে আছে। খালি এসব ফ্ল্যাটে কর্মকর্তাদের ওঠার জন্য সরকারের আবাসন পরিদপ্তর থেকে বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও সাড়া পাচ্ছে না।
এ ছাড়া নোয়াখালীর মাইজদী শহরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নয়টি আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ গত জুনে শেষ হলেও সেখানে ওঠার আগ্রহ দেখাননি কেউ। মাইজদীতে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ৬৫০ বর্গফুট থেকে ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে ১৪ তলা করে ৬টি ভবন তৈরি করা হয়েছে; যা খালি পড়ে আছে। এসব ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ৮৫২ কোটি, ২৯০ কোটি, ২১৯ কোটি ও ৪০২ কোটি টাকা।
এসব ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার দায়িত্ব আবাসন পরিদপ্তরের। তাদের মতামতের ভিত্তিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ভবন নির্মাণ করে থাকে। কিন্তু উল্লিখিত ভবন নির্মাণের বিষয়ে তাদের মতামত নেওয়া কিংবা সম্ভাব্যতা যাচাই কোনোটাই হয়নি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা খামখেয়ালিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কথায় বলে, ‘ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না।’ কিন্তু গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের করার আগে তো ভাবেইনি, করার পরও ভাবছে না। তাদের খামখেয়ালিতে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হলো। একদিকে মিরপুরে নির্মিত শত শত ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে, অন্যদিকে বিসিএস প্রশাসন, পুলিশ, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পছন্দের ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন নিয়ে আবাসন পরিদপ্তরে ভিড় জমাচ্ছেন। তাঁরা মূলত মতিঝিল, ইস্কাটন ও আজিমপুর এলাকায় ফ্ল্যাট পেতে আগ্রহী।
এসব স্থানে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে অনেকে মন্ত্রী, সচিবদের কাছেও ধরনা দিচ্ছেন। অথচ যাতায়াতের সমস্যার কারণে কেউ মিরপুরে যেতে রাজি নন। সরকারি কর্মকর্তারা সেখানেই থাকতে আগ্রহী হবেন, যেখানে যাতায়াতের সুবিধা আছে। আর নারায়ণগঞ্জ ও মাইজদীর সরকারি ফ্ল্যাটে সরকারি কর্মকর্তাদের যেই ভাড়া দিতে হবে, তার চেয়ে কম ভাড়ায় তারা বেসরকারি আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন।
যেকোনো ভবন নির্মাণের আগে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করার বিধান আছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা তারও প্রয়োজন বোধ করেননি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের খামখেয়ালি ও অপরিণামদর্শিতার কারণে সরকারের যে কোটি কোটি টাকা অপচয় হলো, তার কৈফিয়ত কী।
শত শত কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত এসব ভবন খালি রাখা যাবে না। খালি ফ্ল্যাটগুলোতে শর্ত শিথিল করে হলেও নিম্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাদ্দ দেওয়া হোক। ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রক্রিয়ার পুরো বিষয়টি তদন্ত করা হোক। যাদের জন্য এ অপচয়, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। জনগণের করের অর্থ নিয়ে এ রকম অপচয় বরদাশত করা যায় না।
প্রধানমন্ত্রীর কৃচ্ছসাধনের পরামর্শ
বিশ্ববাজারে খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। দাম বাড়ছে দেশেও। আর এই প্রেক্ষাপটে দেশের সবাইকে ‘কৃচ্ছসাধন ও সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ১৭ মে সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ পরামর্শ দেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে প্রকল্প অনুমোদনে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করার নির্দেশনা দিয়ে এখনই জরুরি নয় এমন প্রকল্প কিছুটা ধীরগতিতে বাস্তবায়ন করার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, ‘আমরা এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বাজেট দিতে যাচ্ছি। ভালোই বাজেট মোটামুটি আমরা মনে করি। আজকে সেটা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অনুমোদন দেব।’
‘এখানেও আমি এইটুকু অনুরোধ করব প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়, এখানে মন্ত্রীরা আছেন, সচিবরা আছেন, পরিকল্পনা কমিশনে যারা আছেন, তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো আমরা আপনাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্প অনুমোদন করে দেব, আমরা নেব এটা ঠিক। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আপনাদের অগ্রাধিকারটা ঠিক করতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোনটা আমার এক্ষুণি প্রয়োজন সেগুলো আমরা করব, আর যেগুলো এক্ষুণি প্রয়োজন নেই সেগুলো একটু ধীরগতিতে করব। যেন আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপটা না আসে।’
‘যেখানে সারা বিশ্বব্যাপী এই মন্দা এবং বিশ্বব্যাপী একটা দুর্ভিক্ষ অবস্থার দিকে যাচ্ছে সেখানে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সেজন্য টাকা খরচের ক্ষেত্রে বা সব ক্ষেত্রেই আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। অহেতুক আমাদের সম্পদ যেন আমরা ব্যয় না করি। সেগুলো আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। আমরা যদি খুব ভালোভাবেই হিসাব করে চলতে পারি তাহলে আমাদের দেশে কোন সমস্যা হবে না।’
রিজার্ভ চিবিয়ে খাওয়া
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকেই জানতে চায়, রিজার্ভের টাকা গেলো কোথায়৷ তাদের বলতে চাই, এটা কেউ চিবিয়ে খায়নি৷ রিজার্ভের টাকা গেছে পায়রা বন্দরে, খাদ্য আমদানিতে৷ মানুষের কাজেই এটা লাগাচ্ছি৷
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের টাকা থেকে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ফান্ড করে তা মানুষের কাজে লাগানো হয়৷ গত ২৭ অক্টোবর পায়রা বন্দরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী৷
প্রায় ১১ হাজার ৭২ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং, আটটি জাহাজের উদ্বোধন, প্রথম টার্মিনাল এবং ছয় লেনের সংযোগ সড়ক ও একটি সেতু নির্মাণ৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করেছি৷ বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড এটা দিয়ে পায়রা বন্দরের কাজটা আমরা শুরু করলাম৷ ভবিষ্যতে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নে এই ফান্ড কাজে লাগাতে পারবো৷ তিনি বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না৷ ঠিকই আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই৷
রিজার্ভের পুনরুদ্ধার কি সম্ভব?
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান মাধ্যম রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স। কিন্তু গত অক্টোবর মাসে এই দুই প্রধান খাতেই আয় কমেছে।
অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা দেড় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সেই সঙ্গে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় ৭.৮৫ শতাংশ কমে চার দশমিক ৩৫ বিলিয়ন হয়েছে। ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে (জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি রয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার বা প্রায় তিন দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময় যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার তুলনায় ৩৬১ কোটি ডলারের পণ্য বেশি আমদানি হয়েছে।
কিন্তু সার্বিক বাণিজ্যের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময় বাংলাদেশ রপ্তানি আয় রেমিট্যান্স মিলিয়ে আয় করেছে করেছে এক হাজার ১৮০ কোটি ডলার, কিন্তু আমদানি ব্যয়, বিদেশে চলে যাওয়া অর্থ মিলে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার।
অর্থাৎ সার্বিক ঘাটতি বেড়েই চলেছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছর শুরু হয়েছিল ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার পেমেন্ট অব ব্যালেন্সের বিশাল ঘাটতি নিয়ে। যদিও বৈদেশিক ঋণ, আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি আসলে, আমদানি ব্যয় কমলে এই ঘাটতি কিছুটা পূর্ণ হয়ে থাকে।
কিন্তু যেভাবে বাংলাদেশের ঘাটতি বেড়ে চলেছে, তাতে সেটি সহসা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ