বেলুচিস্তান কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্ট (সিটিডি) এর বিরুদ্ধে একটি “ভুয়া এনকাউন্টারে” তিন নিখোঁজ ব্যক্তিকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। খবর ডনের।
গতকাল এ অভিযোগ আনেন ভয়েস ফর বেলুচ মিসিং পার্সনস (ভিবিএমপি) চেয়ারম্যান নাসরুল্লাহ বেলুচ।
সিটিডি-এর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তারা তথ্য পেয়েছে যে নিষিদ্ধ বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি গ্রুপের কিছু “সন্ত্রাসী” খারানের উপকণ্ঠে উপস্থিত ছিল এবং একটি বড় সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পরিকল্পনা করার লক্ষ্যে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ রয়েছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরবর্তীতে সম্ভাব্য আস্তানাটি সনাক্ত করতে নিজস্ব কর্মীদের একটি দল এবং একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছিল।
গোয়েন্দা দলগুলো আস্তানাটি সনাক্ত করে এবং আশফাক আহমেদ ওরফে জামিলের নেতৃত্বে সাত “সন্ত্রাসী” এর উপস্থিতি নির্ধারণ করে। যৌথ দল তখন একটি অভিযানের পরিকল্পনা করে এবং নির্বিচারে গুলি চালানো হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার জন্য অপারেশন দল পাল্টা জবাব দেয় এবং এক ঘন্টা ধরে গুলি বিনিময় চলতে থাকে। এই সময় জামিল এবং অন্য দুইজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
সিটিডি বলেছে, তাদেরর দল পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসীদের তাড়া করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুর্বল দৃশ্যমানতা এবং পাহাড়ী ল্যান্ডস্কেপের কারণে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
এতে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে চার সন্ত্রাসীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং তাদের পরিচয় হল সালাল আহমেদ, শুকরাল্লাহ, ওয়াসিম সাজ্জাদ এবং ফরিদ।
ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে বলেও এতে বলা হয়েছে।
তবে রাইটস গ্রুপের চেয়ারম্যান নাসরুল্লাহ ডনের কাছে দাবি করেছেন, এ হত্যাকাণ্ড একটি অপারেশনের ফলাফল নয় বরং একটি মঞ্চস্থ এনকাউন্টার ছিল।
তিনি বলেন, সিটিডি দ্বারা নিহত চার ব্যক্তির মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে একজন তাবিশ ওয়াসিম বেলুচ।
তিনি বলেন, তাবিশ বেলুচ ছাত্র সংগঠন-পাজ্জার নেতা ছিলেন যাকে ৯ জুন, ২০২১-এ খুজদার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তার ব্যাপারে এমনকি নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে ফেডারেল মন্ত্রিসভার উপকমিটির সাথে প্রাদেশিক এবং ফেডারেল সরকারগুলোতেও পাঠানো হয়েছিল।
নাসরুল্লাহ বলেন, তাবিশের পরিবার তার লাশ শনাক্ত করেছে এবং বাকি দুজন ফরিদ এবং সালাল, যাদেরকে যথাক্রমে ২৮ সেপ্টেম্বর এবং ৬ অক্টোবর কোয়েটা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল।
ভিবিএমপি চেয়ারম্যান বলেন, এ দুই নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয়টি ভিবিএমপির প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও উত্থাপিত হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছিল।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের এনকাউন্টারে হত্যা করা সংবিধানের পরিপন্থী এবং মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, যা আমরা কঠোরভাবে নিন্দা জানাই। এই নৃশংস প্রথা বন্ধ করা হোক।
তিনি জানান যে আইন অনুসারে কোনও রাষ্ট্রীয় অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হলে ভিবিএমপির কোনও সমস্যা নেই। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের এনকাউন্টারে হত্যা করা সংবিধানের পরিপন্থী এবং মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, যা আমরা কঠোরভাবে নিন্দা জানাই। এই নৃশংস প্রথা বন্ধ করা হোক।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ আফরাসিয়াব খট্টক বলেন, এ ঘটনার একটি “বিশ্বাসযোগ্য” বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যুদ্ধের সময়ও বন্দীদের হত্যা করা যুদ্ধাপরাধ। বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই।
পাকিস্তানের ভিন্নমত পোষণকারীদের নিরাপত্তা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে। পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হয়রানি, হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতন বেলুচ জনগণকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানে বেলুচ জনগণ বেদনা ও যন্ত্রণার মাঝে জীবন অতিবাহিত করছে বলে অভিযোগ তুলেছে বেলুচের সাধারণ জনগণ।
বেলুচ তরুণ শিক্ষার্থীদের এমন হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু না; যা চলছে এখনও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বলছে, পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির লোকেরা এভাবে তরুণদের রাস্তা কিংবা তাদের বাসাবাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং পরে অস্বীকারও করছে। অনেক সময় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে কোনো তথ্যও দিতে চায় না তারা।
২০০০ সাল থেকেই বেলুচিস্তানে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সেনা সহায়তায় পরিচালিত পাকিস্তানের গোয়েন্দাগুলো কিংবা ফ্রন্টিয়ার্স কর্পস নামের আধাসামরিক বাহিনীর হাতে গত দুই দশকে দশ হাজারের বেশি বেলুচ নাগরিক গুম হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় মূলত তরুণরা লক্ষ্য হলেও নারী, শিশু এমনকি বৃদ্ধদের অপহরণের ঘটনাও আছে।
আবার অপহৃতদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কবি, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। তবে অপহরণকারীদের মূল্য লক্ষ্যই থাকে তরুণ শিক্ষার্থীরা।
গত দুই দশকে বেলুচ শিক্ষার্থীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করার মতো, এদের মধ্যে অনেককেই হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া অপহরণের শিকার আরো কয়েকহাজার তরুণ এখনও পাকিস্তানের বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে ধুঁকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হচ্ছে বেলুচিস্তান। স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র সংগঠন।
সেখানে পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে প্রতিরোধ আন্দোলন। এর মধ্যে অতীতের চেয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে জড়িয়েছেন। আন্দোলনে থাকা বেশিরভাগ সশস্ত্র কিংবা নিরস্ত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক অথবা বর্তমান ছাত্রনেতারা।
পাকিস্তান সরকার বিশ্বাস করে, ছাত্র সংগঠনগুলোই সশস্ত্র সংগঠনগুলোতে সদস্য জোগান দিচ্ছে। তবে তথ্য নেওয়ার জন্য সামান্য সন্দেহ থেকেও ছাত্রদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সরকারের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের আরেকটি উদ্দশ্য হচ্ছে, অন্য ছাত্রদের ভয় ধরানো যাতে তারা স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত থাকে।
বেলুচ রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, এই জনগোষ্ঠীকে মেধাশূন্য করতেই পাকিস্তানের এই অপচেষ্টা। বেলুচদের অগ্রগতি রুখতে খুব হিসাব কষেই পাকিস্তান সরকার এই কাজে নেমেছে বলেও দাবি তাদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৪৪
আপনার মতামত জানানঃ