
পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তান প্রদেশে চীনা নাগরিকদের বহনকারী একটি গাড়িবহরে আত্মঘাতী হামলা হয়েছে। হামলায় চীনের এক নাগরিক এবং স্থানীয় দুই শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। শনিবার পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনা দূতাবাসের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জানা যায়, শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ৭টার দিকে গওয়াদর বন্দরের ইস্ট বে সড়কে এ হামলার ঘটনা ঘটে। বহরে মোট চারটি গাড়ি ছিল। গাড়িবহরের সুরক্ষায় চীনা নাগরিকদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও ছিলেন।
সম্প্রতিই পাকিস্তানে চীনা নাগরিকদের উপর হামলা আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে। চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরাতেই এই সিরিজ হামলা চালানো হচ্ছে বলে দেশটির বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এমনকি অনেকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও আঙুল তুলছে।
হামলা নিয়ে যা বলছে সংশ্লিষ্টরা
গওয়াদর পাকিস্তানের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানে অবস্থিত, প্রদেশটিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী সক্রিয়। তাদেরই একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এ হামলার দায় স্বীকার৯ করে নিয়েছে। “বিএলএ চীনা প্রকৌশলীদের গাড়িবহর লক্ষ্য করে এই হামলা চালিয়েছে,” বিবৃতিতে বলেছে গোষ্ঠীটি।
চীনা দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে এ ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলার তীব্র নিন্দা ও হামলায় উভয় দেশের আহতদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি এবং নিহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছে চীনা দূতাবাস।
সূত্র মতে, হামলায় আহত কয়েকজনকে উদ্ধার করে গওয়ারদারের একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হামলার এই ঘটনা তদন্ত এবং হোতাদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তি দিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীন।
খাইবার পখতুনখোয়া প্রদেশে চলতি মাসে বাসে হামলায় নয় চীনা কর্মীসহ ১৩ জন নিহত হন। চলতি বছরের এপ্রিলে বেলুচিস্তানের রাজধানী কুয়েটায় সফররত চীনের রাষ্ট্রদূতকে লক্ষ্য করে একটি অভিজাত হোটেলে হামলা চালায় বন্দুকধারীরা। রাষ্ট্রদূত বেঁচে গেলেও প্রাণ যায় চার জনের।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তানি তালিবান জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) ওই হামলার সঙ্গে জড়িত। তবে টিটিপি বলেছে, তারা ওই হামলার সঙ্গে জড়িত নয়।
এদিকে, বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানায়, সাগরপাড়ের রাস্তায় জেলেদের একটি পাড়া থেকে এক কিশোর গাড়িবহরের দিকে দৌড়ে যায়। সে সময় এলাকাটিতে সাদা পোশাকে অবস্থান করছিলেন পাকিস্তানী সেনারাও।
তারা দৌড়ে গিয়ে ছেলেটিকে আটকালে গাড়িবহর থেকে ১৫-২০ মিটার দূরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ চালায় সে। হামলায় স্থানীয় দুই শিশু নিহত, দুই শিশুসহ তিন জন স্থানীয় ও এক জন চীনা নাগরিক আহত হয়েছে।
প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে গদরের হাসপাতাল থেকে ফিরে গেছেন ওই চীনা নাগরিক। আহত দুই শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃ অবস্থানে যেতে পাকিস্তান ও চীনের লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা এটি।’ দোষীদের বিচারের আওতায় আনারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
কেন এবং কারা হামলা চালাচ্ছে?
চীনা নাগরিক, স্থাপনা বা কোম্পানিতে হামলার সিংহভাগ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে বালোচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। তবে কোয়েটার হোটেলে এপ্রিল মাসে হামলার দায় স্বীকার করে তেহরিকে তালিবান অব পাকিস্তান বা টিটিপি, যারা পাকিস্তানী তালিবান নামে পরিচিত।
উল্লেখ্য, গ্যাসসহ নানা খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ বেলুচিস্তান পাকিস্তানের অন্যতম দরিদ্র অঞ্চল। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে। অঞ্চলটিতে সক্রিয় আছে সশস্ত্র বেশ কিছু সংগঠন।
বিশেষ করে সম্প্রতি সাড়ে ছয় হাজার কোটি ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) মাধ্যমে অঞ্চলটিতে চীনের বিনিয়োগ ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষোভ আরও দানা বাঁধে। প্রকল্পের আওতায় আরব সাগর তীরবর্তী গদর বন্দরের উন্নয়নেও কাজ করছে চীনারা। এশিয়া ও ইউরোপকে সড়ক, রেল ও নৌপথে যুক্ত করতে বেইজিংয়ের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ এটি।
এসব প্রকল্পে অঢেল বিনিয়োগ সত্ত্বেও বেলুচিস্তানের মানুষ কোনোভাবে উপকৃত হচ্ছেন না বলে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। সিপিইসির নানান প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ মানুষই ভিন্ন অঞ্চল বা দেশের বাসিন্দা।
২০১৯ সালে সিপিইসির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে আরেকটি বিলাসবহুল হোটেলে হামলা চালিয়ে আটজনকে হত্যা করে বন্দুকধারীরা। আরব সাগরে চীনের সহজ প্রবেশ নিশ্চিতে বেলুচিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে নির্মিত গভীর সমুদ্রবন্দরের শহর গদরে হয় ওই হামলা।
গত বছরের জুনে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আংশিক মালিকানার অন্তর্ভুক্ত পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জেও হামলা চালায় বেলুচ স্বাধীনতাকামীরা।
এ ছাড়া স্বাধীনতার দাবিতে বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নামে আরও একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীও দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে অঞ্চলটিতে। আছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের তৎপরতাও।
তবে বালোচিস্তান রাজ্য এবং বালোচ জনগোষ্ঠীর সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের এবং বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরোধ বহুদিনের। আয়তনে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজ্য হলেও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে সবচেয়ে অনগ্রসর বালোচিস্তানে ১৯৭০ সাল থেকেই সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদের সূচনা হয়।
১৯৭৩ সালে কঠোর এক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সেই বিদ্রোহ দমনের চেষ্টার পর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা সেখানে আরও জোরদার হয়েছে।
বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মনে করে যে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) অংশ হিসাবে যেসব প্রকল্প হচ্ছে তাতে তাদের কোনো ফায়দা নেই, বরঞ্চ তাতে পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়ছে। বিএলএ-র অনেক নেতা প্রকাশ্যে সিপেক-কে প্রতিরোধের কথা বলেছেন।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা!
পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. হাসান আসকারি রিজভী বলেন, পাকিস্তানে সন্ত্রাস ১০ বছর আগের তুলনায় কমলেও এখনও তা চলে যায়নি, এবং বিএলএ বা টিটিপি ছাড়াও ছোটোখাটো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও বিচ্ছিন্নভাবে এসব হামলার পেছনে রয়েছে।
“এদের মূল লক্ষ্য পাকিস্তানের সরকারকে বিব্রত করা। কখনও তারা নিজেদের এজেন্ডা মতো কাজ করে, আবার কখনও বাইরের উস্কানিতে কাজ করে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা মহলের দৃঢ় বিশ্বাস যে অনেক হামলার পরিকল্পনা এবং নির্দেশ আসে দেশের বাইরে থেকে।”
তিনি বলেন, দুটো দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বি আর আই) বিরুদ্ধে কথা বলছে। পাকিস্তানের সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে বলা হয় বালোচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অন্যতম মদদ দাতা ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’।
আফগানিস্তানে কান্দাহারের ভারতীয় কনস্যুলেট থেকে বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে (বিএলএ) সাহায্য সহযোগিতার অনেক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন করা হয় বলে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের বিশ্বাস।
এর পক্ষে তারা মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রমাণও হাজির করেন। যেমন, পাকিস্তানের কারাগারে ২০১৭ সাল থেকে আটক রয়েছেন এমন একজন ভারতীয় এক নাগরিক সম্পর্কে পাকিস্তানের দাবি যে তিনি ভারতীয় একজন গুপ্তচর, যাকে বালোচিস্তান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মি রিজভী অবশ্য বলেন, বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বহুদিন ধরেই আফগানিস্তান থেকে তৎপরতা চালিয়েছে যেটা তার মতে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ