পাকিস্তানের ভিন্নমত পোষণকারীদের নিরাপত্তা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে। পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হয়রানি, হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতন বেলুচ জনগণকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানে বেলুচ জনগণ বেদনা ও যন্ত্রণার মাঝে জীবন অতিবাহিত করছে বলে অভিযোগ তুলেছে বেলুচের সাধারণ জনগণ।
সম্প্রতি এরকমই এক ভিন্নমত পোষণকারী বেলুচিস্তানের সাকিব করিম যিনি আজারবাইজানে নিহত হন যা কিনা পাকিস্তানের রাজনৈতিক নির্বাসনে থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে তাদের হত্যা করার বিষয়টাকে আরো পরিষ্কার করে তোলে।
সাকিব করিম পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর হিটলিস্টে ছিল অনেকদিন ধরে জানায় পাকিস্তানি পত্রিকা ‘ইসলাম খবর। এই পত্রিকাটি আরো জানায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলোতে থাকা এই নির্বাসিতরা পাক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর লক্ষ্যবস্তু তে পরিণত হয়েছে এবং জীবন শংকায় আছে। বেলুচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট থেকে আজারবাইজান সরকারের প্রতি সাকিব করিমের হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এর দাবী জানানো হয়।
২০২০ সালে কানাডায় বেলুচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট এর নেতা এবং রাজনৈতিক রিফিউজি বানুক করিমা বালুচ এর নিহত লাশ পাওয়া যায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই হত্যাকান্ডের জন্য তদন্ত করার আবেদন জানায়। বানুক করিমা বালুচ, পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এর চালানো দুঃশাসন ও নিপীড়ন এর ঘটনা পুরো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সামির চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কোচ জেলার তুরবাত এলাকা থেকে উধাও হয়ে যান। মোহাম্মদ বখশের ছেলে সামির তুরবাতে গিয়েছিলেন বেড়াতে। এখনও খোঁজ মেলেনি সামিরের।
ইসলামাবাদের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় এমফিলের শিক্ষার্থী হাফিজ বালুচকে তার নিজ এলাকা খুজদার থেকে অজ্ঞাত কয়েকজন তুলে নিয়ে যায়। আজও ফেরেননি হাফিজ।
২৭ ফেব্রুয়ারি একই ধরনের ঘটনা ঘটে। পাঞ্জাব থেকে কোয়েটা যাওয়ার পথে হাওয়া যান বাহওয়ালপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র দিলীপ বালুচ। বেলুচিস্তানের বারখানের বাসিন্দা ছিলেন দিলীপ।
বেলুচ তরুণ শিক্ষার্থীদের এমন হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু না; যা চলছে এখনও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বলছে, পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির লোকেরা এভাবে তরুণদের রাস্তা কিংবা তাদের বাসাবাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং পরে অস্বীকারও করছে। অনেক সময় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে কোনো তথ্যও দিতে চায় না তারা।
পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির লোকেরা এভাবে তরুণদের রাস্তা কিংবা তাদের বাসাবাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং পরে অস্বীকারও করছে। অনেক সময় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে কোনো তথ্যও দিতে চায় না তারা।
ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বেলুচিস্তানে এমন জোরপূর্বক তুলে নিয়ে তরুণদের গায়েব করে ফেলার ঘটনাচিত্র। প্রতিবেদনে এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে বালুচ শিক্ষার্থীদের নিখোঁজ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
২০০০ সাল থেকেই বেলুচিস্তানে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সেনা সহায়তায় পরিচালিত পাকিস্তানের গোয়েন্দাগুলো কিংবা ফ্রন্টিয়ার্স কর্পস নামের আধাসামরিক বাহিনীর হাতে গত দুই দশকে দশ হাজারের বেশি বেলুচ নাগরিক গুম হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় মূলত তরুণরা লক্ষ্য হলেও নারী, শিশু এমনকি বৃদ্ধদের অপহরণের ঘটনাও আছে।
আবার অপহৃতদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কবি, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। তবে অপহরণকারীদের মূল্য লক্ষ্যই থাকে তরুণ শিক্ষার্থীরা।
গত দুই দশকে বেলুচ শিক্ষার্থীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করার মতো, এদের মধ্যে অনেককেই হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া অপহরণের শিকার আরো কয়েকহাজার তরুণ এখনও পাকিস্তানের বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে ধুঁকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিখোঁজদের মধ্যে জাকির মজিদ বেলুচ, জাহিদ বেলুচ, সাব্বির বেলুচের মতো কয়েকজন ছাত্রনেতাও রয়েছেন।
শুধু বেলুস্তিানই নয়, পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বলপূর্বক গুমের ঘটনা গত কয়েক মাসে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে বিএলএ’র ভয়াবহ হামলার পর থেকেই এ ঘটনা বেড়েছে। যেসব ছাত্র নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের অধিকাংশকেই হয় তাদের বাড়ি থেকে নয়ত ছাত্রাবাস থেকে তুলে নিয়ে বিনা বিচারে আটকে রাখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পাকিস্তানের গণ্যমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের শুরু থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত সময়ে বেলুচিস্তান এবং দেশটির বিভিন্ন শহর থেকে অন্তত ৪৮ বেলুচ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন। তবে অধিকার সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ভয়েস অব বেলুচ মিসিং পারসনসের (ভিবিএমপি) দাবি, নিখোঁজদের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, নিখোঁজ অনেক তরুণের পরিবারকে মুখ না খোলার ব্যাপারে হুমকিও দেওয়া হয়।
দেশটির গণ্যমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারিতে ৭টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৮, মার্চে ৮, এপ্রিলে ৬ এবং মে মাসে ১৯ জন অপহরণের শিকার হন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, সম্প্রতি ৩ হাজার বালুচ নাগরিক গুম হয়েছে পাক বাহিনীর হাতে। তদন্ত কমিশন ৭ হাজারটি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা খুঁজে পেয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৫ হাজারটি ২০২১ সালের মধ্যে পরিচালনা করা হয়েছে। পাকিস্তানে জোরপূর্বক গুমের অনুশীলন শুরু হয়েছিল মোশাররফ প্রশাসনের সময় (১৯৯৯-২০০৮), কিন্তু এটি পরবর্তী সরকারের অধীনে অব্যাহত রয়েছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মতে, পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হয়রানি, হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতন বেলুচ জনগণকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানে বেলুচ জনগণ বেদনা ও যন্ত্রণার মাঝে জীবন অতিবাহিত করছে।
স্বাধীনতার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হচ্ছে বেলুচিস্তান। স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র সংগঠন।
সেখানে পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে প্রতিরোধ আন্দোলন। এর মধ্যে অতীতের চেয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে জড়িয়েছেন। আন্দোলনে থাকা বেশিরভাগ সশস্ত্র কিংবা নিরস্ত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক অথবা বর্তমান ছাত্রনেতারা।
পাকিস্তান সরকার বিশ্বাস করে, ছাত্র সংগঠনগুলোই সশস্ত্র সংগঠনগুলোতে সদস্য জোগান দিচ্ছে। তবে তথ্য নেওয়ার জন্য সামান্য সন্দেহ থেকেও ছাত্রদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সরকারের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের আরেকটি উদ্দশ্য হচ্ছে, অন্য ছাত্রদের ভয় ধরানো যাতে তারা স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত থাকে।
বেলুচ রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, এই জনগোষ্ঠীকে মেধাশূন্য করতেই পাকিস্তানের এই অপচেষ্টা। বেলুচদের অগ্রগতি রুখতে খুব হিসাব কষেই পাকিস্তান সরকার এই কাজে নেমেছে বলেও দাবি তাদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৩
আপনার মতামত জানানঃ