গত ৫০ বছরে পৃথিবীতে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমপক্ষে ৬৯ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। আজ বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ গোষ্ঠী ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) এর একটি প্রতিবেদনে এমনটা দাবি করা হয়েছে। খবর আল-জাজিরার
জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন (জেডএসএল) ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশনের (ডব্লিউডব্লিউএফ) ‘লিভিং প্লানেট অ্যাসেসমেন্ট’ নামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে,মানুষের বন পরিষ্কার করা এবং বায়ু, স্থল ও সমুদ্রকে দূষিত করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যে হারে বন্যপ্রজাতির সংখ্যার আকার পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে ১৯৭০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বন্যপ্রাণী কমেছে ৬৯ শতাংশ।
‘দ্য লিভিং প্লানেট রিপোর্ট’ নামে প্রতিবেদনটি প্রতি দুই বছরে একবার প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে বিশ্বে বন্যপ্রাণীর প্রকৃত অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়।
অনুসন্ধানগুলো জুওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন(জেডএসএল) থেকে প্রাপ্ত ডেটার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ব থেকে ৫,২৩০ প্রজাতির প্রায় ৩২,০০০ বন্যপ্রাণী সংখ্যার ওপর জরিপটি করা হয়।
জুওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন-এর সংরক্ষণ ও নীতির পরিচালক অ্যান্ড্রু টেরি বলেন, সূচকে আমরা কীভাবে জীবনের ভিত্তিকে কেটে ফেলেছি এবং পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হতে চলেছে তা তুলে ধরেছে।”
তিনি বলেন,”জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি রোধ করা এবং অত্যাবশ্যক বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা জলবায়ু, পরিবেশগত এবং জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলা করার জন্য বিশ্বব্যাপী এজেন্ডাগুলোর শীর্ষে থাকতে হবে।”
প্রতিবেদনটি এসেছে বিশ্ব নেতাদের দীর্ঘ বিলম্বিত জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্যের শীর্ষ সম্মেলনের জন্য আহ্বান করার দুই মাস আগে। যা COP15 নামে পরিচিত। এটি চীনের কোভিডের অব্যাহত বিধিনিষেধের ফলে কানাডায় স্থানান্তরিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির মধ্যে যোগসূত্র উল্লেখ করে প্রতিবেদনের লেখকরা বলেছেন, আলোচনাটি প্রকৃতি রক্ষার একটি “শেষ সুযোগ”।
ডব্লিউডব্লিউএফ এর ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টর জেনারেল মার্কো ল্যাম্বার্টিনি রিপোর্টের মুখপাত্রে বলেছেন, “বার্তাটি পরিষ্কার এবং লাল বাত্তি জ্বলছে।”
প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল, যেমন ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ১৯৭০ সাল থেকে বন্যপ্রাণী সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে। যেখানে আপেক্ষিকভাবে গড়ে ৯৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আফ্রিকায় গড়ে প্রায় ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যেখানে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তা ৫৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বড় পতন দেখা গেছে মিঠা পানির প্রাণীগুলোতে। যা গড়ে ৮৩ শতাংশ কমেছে।
জরিপ বলেছে, বাসস্থানের ক্ষতি এবং অভিবাসন রুটের বাধা পরিযায়ী মাছের জন্য হুমকি।
সূচকে দেখা গেছে, আমাজন পিঙ্ক রিভার ডলফিন বা বোটো এবং মহাসাগরীয় হাঙ্গরের সংখ্যাসহ বন্যপ্রাণী গত ৫০ বছরে খাড়া পতনের শিকার।
কিন্তু এটিও দেখায় যে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা সাইপ্রাসের লগারহেড কচ্ছপ এবং রুয়ান্ডা, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো এবং উগান্ডার উত্তর সীমান্তে ভিরুঙ্গা পর্বতমালায় গরিলাদের মতো প্রজাতিকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করেছে৷
বিশ্বজুড়ে আদিবাসী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকার, শাসন এবং সংরক্ষণ নেতৃত্বকে স্বীকৃত এবং সম্মান করা প্রয়োজন।
আরও পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে, প্রতিবেদনে জোর দেওয়া হয়েছে যে, বিশ্বজুড়ে আদিবাসী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকার, শাসন এবং সংরক্ষণ নেতৃত্বকে স্বীকৃত এবং সম্মান করা প্রয়োজন।
ল্যাম্বার্টিনি আরও বলেছেন, যদি আমরা প্রকৃতির ক্ষতি রোধ করতে বা এ ক্ষতির বিপরীতে কিছু করতে চাই এবং মানুষ ও প্রকৃতির জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই রূপান্তরমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন দেখতে হবে। বিশ্বনেতাদের অবশ্যই COP15-এ এগিয়ে আসতে হবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বিবরণীতে বন্যপ্রাণীদের অপরিহার্য মূল্য এবং বিভিন্ন অবদানের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এতে পরিবেশগত, জিনতাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিষয়ক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক এবং নান্দনিক বিষয়ের সঙ্গে যুগসই উন্নয়ন এবং মানবকল্যাণের দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি গণসচেতনতা গড়ে তোলা এবং সিআইটিইএস-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করে বলা হয় আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য যাতে বন্য প্রজাতিদের টিকে থাকতে হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতিসংঘ ২০২১-এর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ২০২১-৩০ সময়কে প্রতিবেশ সংরক্ষণ দশক ঘোষণা করেছে। যার পুরো সময়টাই বিশ্বের দেশগুলোকে টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে।তবে বাংলাদেশ প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা আদৌ অর্জিত হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কার কারণ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে নানাভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এমনকি সংবিধান এর-১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’তথাপি সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোর আন্তযোগাযোগ ও সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে নানাভাবে বনের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর স্বার্থ তো অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনায় উপেক্ষিত থাকে। কখনো কোথাও বন্যপ্রাণী মারা পড়লে বা এ-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটলে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সরব থাকে।
তারা বলেন, ব্রিটিশ উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশের বন ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও পরিচালন কৌশলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততখানি হয়নি। সেটি না হয়ে বন ব্যবস্থাপনার সাবেকি কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বনের সহব্যবস্থাপনাসহ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার নতুন কাঠামো, বিশেষত বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটগুলোর কার্যক্রম নড়বড়ে হয়ে ঝুলে আছে।
বন্যপ্রাণী বা প্রতিবেশ রক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন, এসব কাজে মানুষকে বিরত রাখার সুযোগ নেই, বন আইনকে জনবান্ধব করতে হবে, জনগণের অংশগ্রহণের উপযোগী করতে হবে, বন ও প্রতিবেশের দায়িত্ব শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়, এই বোধ সবার মধ্যে জাগ্রত করা দরকার। নইলে লোকে প্রতিবেশ ধ্বংস করে এলাকার বনবিড়াল ও বাগডাশ ধরে-মেরে বন অধিদপ্তরকে খবর দেবে।
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য, বৈশ্বিক উন্নয়ন অভীষ্টের ১৫তম সূচক বন আচ্ছাদন তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাহাড়ি বনের গুরুত্ব অপরিসীম। একইভাবে হাওর, নদী ও সমুদ্রসহ সব জলজ প্রতিবেশকে দূষণমুক্ত রাখাও প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য সমানভাবে জরুরি। এই মুহূর্তে তাই প্রয়োজন বন, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি রাষ্ট্রের ঘোষিত প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়নে আইন, পরিকল্পনা ও নীতির প্রয়োগে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণের ঐকমত্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২২৯
আপনার মতামত জানানঃ