বিগত চার শতাব্দী ধরে ঢাকা নগরীর অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নানা ধরনের বুনো প্রাণীর অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে, যার মাঝে কিছু প্রাণী মানববিশ্বে ভয়াবহ বিপজ্জনক বলেই পরিচিত।
যদিও কয়েক শত বছরে ক্রমবর্ধমান শহর তাকে ঘিরে থাকা বুনোজগতের অস্তিত্বকে কোণঠাসা করে ফেলেছে ক্রমাগত। বুড়িগঙ্গার তীরে অল্প কয়েকজন মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে স্থাপিত ঢাকা নগরী সতেরো শতকেও বিশাল অরণ্যে পরিপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে শহরের উত্তর প্রান্তে।
শহরকেন্দ্রের উত্তর দিকে মিরপুর, কুর্মিটোলা, পল্টন এবং তেজগাঁও নামের চার দুর্ভেদ্য জঙ্গল ছিল। নদীতীরের দক্ষিণে ছিল কামরাঙ্গীরচর নামের এক বিস্তৃত বাদাবন। সেখানের বাসিন্দারা বাঘ, অজগরসহ অন্যান্য প্রাণীর অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কালের স্রোতে কয়েক শ বছর পরেও স্থানগুলোর নাম অবিকৃতভাবে টিকে আছে, কিন্তু সেগুলো আর মানুষের মনে ভয়াল প্রাণীময় ঘন জঙ্গলের আতঙ্ক ছড়ায় না। চলুন সেই সব প্রাণীদের সম্পর্কে জানা যাক।
স্তন্যপায়ী প্রাণী
বড় বিড়ালেরা
অবিশ্বাস্য শোনালেও সতেরো শতকেও ঢাকার আশপাশের বনাঞ্চলে বেশ কিছু বাঘ এবং অসংখ্য চিতাবাঘ ছিল। যদিও ঢাকার অধিকাংশ বাসিন্দারা বিশাল, লোমশ, ডোরাকাটা নিশাচর, আলসে, মুখচোরা প্রাণীটির দর্শনের চেয়ে রাতের আঁধারে ভেসে আসা বাঘের গর্জনের সাথেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তার চেয়ে হালকা, সরু গড়নের ফোঁটা ফোঁটা দাগওয়ালা চিতাবাঘের সাথেই বরং মানুষের মোলাকাত বেশি হতো, এরা কিনা মাঝে মাঝেই দিনের বেলাতেই গৃহপালিত কুকুর, ছাগল ইত্যাদি শিকার করত। মানুষ সাধারণত বাঘ এবং চিতাবাঘের পার্থক্য করতে পারত না, তাই উভয়ের নামই ছিল বাঘ। বাঘের গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসত অব্যাহতভাবে, ভূতের গল্পের মতো তা মানুষের মনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে যেত।
প্রাচীন নগরীর সব বাসিন্দাই সেই দুই ধরনের গল্প জানতেন। বনের বাঘের চেয়ে গল্পের বাঘই মানুষের মনে বেশি ভীতির উদ্রেক করত। তবে সব গল্পই পুরোপুরি আষাঢ়ে নয়। সেই সময়ে বাঘ কেবলমাত্র সুন্দরবনে আবদ্ধ ছিল না, সারা দেশেই ছড়িয়ে ছিল। মানুষ এবং বাঘের মুখোমুখি হওয়া খুব বিরল কিছু ছিল না। পুলিশের খাতা ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৮৩৭ সাল পর্যন্তও ঢাকায় প্রতিবছর কমপক্ষে একজন মানুষ বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছে।
দ্রুত বেড়ে ওঠা মানববসতি যেন বাঘের ভয়মুক্ত থাকে, সেই জন্য চেষ্টার অন্ত ছিল না, বাঘ শিকারের জন্য শিকারিদেও পুরস্কার দিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। একই সাথে বিক্রম দেখানোর, জনসেবা করার এবং ট্রফি সংগ্রহের সুযোগ হিসেবে গণ্য করা হতো বাঘ শিকার। মুঘল আমলে বেতন দিয়ে শিকারি রাখা হতো। ব্রিটিশ আমলে বাঘ শিকারের জন্য পুরস্কার ঘোষিত ছিল। মাত্র চার শ বছরে বাঘের সংখ্যা কেন এমন অবস্থায় এল, তা নিয়ে খুব বিস্ময় প্রকাশের কিছু নাই। সরকারি হিসাবমতে দেখা গেছে, ১৮০৪ সালে ২৭০টা বাঘের চামড়া শিকারিরা সরকারের কাছে দিয়ে পুরস্কার নিয়ে গিয়েছিল, অথচ মাত্র এক শ বছর পরেই ১৯০৭- ১৯১০ পর্যন্ত মাত্র তেরোটি বাঘের ছাল জমা পড়ে। সব বাঘ অবশ্য শহরের আশপাশে শিকার হয়েছিল, তা নয়, বরং পুরস্কারের লোভে কিছু কিছু অনেক দূর থেকেও আনা হয়েছিল।
সতের-উনিশ শতক পর্যন্ত কেবলমাত্র বিষমাখানো তির দিয়েই স্থানীয় শিকারিরা যে সংখ্যক চতুর বিড়াল শিকার করতে সক্ষম হয়েছিল, তা কেবলমাত্র বিস্ময়ের জোগান দেয়। যেহেতু সরকারি পুরস্কারের তালিকায় চিতাবাঘের নামও ছিল, শিকারিরা একপর্যায়ে আবিস্কার করে যে বাঘ শিকারের চেয়ে চিতাবাঘ মারা অনেক সহজ। ফলে শিকার চলতে থাকে। এমনকি ১৯১০ সালেও ২৬টি চিতাবাঘের ছাল জমা পড়েছিল পুরস্কারের জন্য। কালো পুরুষ চিতাবাঘের ( যা কিনা ব্ল্যাক পান্থার নামে পরিচিত, জিনঘটিত কারণে যে চিতাবাঘ কিছুটা কালচে বা পুরোপুরি কালো হয়) চামড়ার একটা আলাদা খাতির ছিল, যদিও তার জন্য বিশেষ কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না। ১৯১৫ সালেও কামরাঙ্গীরচরে একটি চিতাবাঘ মারা হয়েছিল বলে জানা যায়।
রয়েল বেঙ্গল বাঘের চেয়ে ঢাকার চিতাবাঘেরা শিকারির থাবা এড়িয়ে কয়েক বছর বেশিই টিকে ছিল। মিরপুর এবং কুর্মিটোলার বনে গত শতকের প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত কয়েকটি চিতাবাঘ ছিল বলে জানা গেছে। তবে পরবর্তী সময়ে চিতাবাঘের পরিণতিতে তা কোনোই ভূমিকা রাখতে পারেনি। যেখানে সুন্দরবনে অন্তত কয়েক শ বাঘ এখনো বর্তমান, সেখানে সারা দেশে চিতাবাঘের সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি। এর মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, বাঘ যেমন তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে সুন্দরবন পেয়েছে, চিতাবাঘ মানুষের জন্য অগম্য তেমন কোনো জায়গা খুঁজে পায়নি।
বিড়াল পরিবারের বাকি সদস্যগুলো ভীতিকর ছিল না কখনোই, বরং বলা চলে নীরব পর্যটক ছিল ঢাকার। যে চার ধরনের খুদে বিড়াল ঢাকার বন ও বাদাড়ে থাকত, এরা হচ্ছে মেছো বিড়াল, চিতা বিড়াল, বন বিড়াল, সোনালি বিড়াল। ঢাকায় তাদের থাকার সপক্ষে প্রমাণ-উপাত্ত যথেষ্ট সন্দেহপূর্ণ, মানুষ তাদের যেহেতু প্রায়ই বাঘ বলে সম্বোধন করে ফলে আসল বাঘের সাথে গুলিয়ে যায়। বিশেষ করে একটু বড় আকৃতির মেছো বিড়ালকে ভুল কারণবশত মানুষ বাঘ বলেই মনে করে। আকারে ছোট হবার কারণে নিশাচর এই শিকারি প্রাণীগুলো শহরতলির আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জঙ্গল এবং জলাভূমিতে সহজেই টিকে থাকতে পারে।
বন্য শূকর
গত শতাব্দীর প্রথম দিকে বন্য শূকর (গৃহপালিত শূকরের পূর্বপুরুষ) ছিল শহরের প্রান্তে নানা কারণে যেতে বাধ্য হওয়া মানুষদের কাছে এক বিভীষিকাময় নাম। পল্টন, কুর্মিটোলা এবং মিরপুরের জঙ্গলে ছিল তাদের অভয়ারণ্য। তিরিশ থেকে চল্লিশটি বন্য শূকর দল বেঁধে বন-বাদা দাবড়ে ঘুরত আর রাতের বেলা খামার আর বাগানে হামলা করত। খঞ্জরের মতো ধারালো দাঁতের অধিকারী এক শ কিলোগ্রাম ওজনের পূর্ণ বয়স্ক মদ্দা শুয়োর ছিল এক দর্শনীয় জন্তু। যদিও মানুষ বা গৃহপালিত জানোয়ার বন্য শূকরের আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত ছিল না, তারপরও কোণঠাসা হলে তারা আক্রমণ করে মানুষকে আহত করত। পুলিশের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্তও বন্য শূকরের আক্রমণে মানুষ মারা গেছে।
বাঘের ভয়ে সাধারণত মানুষ বড় দল বেঁধে বনে প্রবেশ করত, কারণ ধারনা ছিল যে কয়েকজন একসাথে থাকলে বাঘ সাধারণত আক্রমণ করে না। কিন্তু বুনো শূকরের মুখোমুখি এই সূত্র নিস্ফল ছিল। কোনো কারণে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছালে এরা যেখানে-সেখানে আক্রমণ করত, তা সেখানে যত মানুষই থাক না কেন। যে কারণে বাঘের চেয়ে মানুষ বন্য শূকরের ভয়েই বেশি আতঙ্কিত ছিল। যদিও বাঘের চেয়ে শূকর শিকার করা অপেক্ষাকৃত সহজই ছিল। অনেক জাতের মানুষ মাংসের জোগানের জন্যও শূকর শিকার করত। আদিবাসী গোত্র, বিশেষ করে শহরের উত্তর প্রান্তের বনের নিকটে বসবাসরত, যাদের মগ বলে অভিহিত করা হতো, তারা এই ব্যাপারে দক্ষ ছিল। যথেচ্ছ শিকারের ফলেই ঢাকার আশপাশ থেকে বন্য শূকরের বিলুপ্তি ঘটে গত শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশকেই।
বুনো মহিষ
সতেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বুনো মহিষ ছিল ঢাকার আরেক পরিচিত প্রাণী। তারা দল বেঁধে শহরের উত্তরের বাদাতে চরে বেড়াত। বেলাই বিল (বর্তমানে গাজীপুরের পুবাইলে অবস্থিত) নামের বিস্তৃত বাদা এবং শ্রীপুরের অসংখ্য নাম না জানা জলা শহরের থেকে উত্তর এবং পূর্ব দিকে নদীর ধারে রাজত্ব করে ছিল। বাঘ এবং বন্য শূকরের মতো মহিষ কোনো সময়ই মানববসতির খুব কাছে আসত না বিধায় তা মানুষের জন্য আতঙ্ক উদ্রেককারী ছিল না।
যদিও বিশালদেহী প্রাণীগুলো দল বেঁধে চরে বেড়াত, এবং অনাহুত মানুষদের প্রতি যে খুব একটা সদয় ছিল, এমন প্রমাণ মেলে না। ১৮৩০ সালেও বুনো মহিষের কবলে পড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। নৌকায় করে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করা বণিকদের নিরাপত্তা মূলত নিহিত ছিল, যাযাবর বুনো মহিষের দল কোথায়, সেটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা এবং সেই এলাকাকে এড়িয়ে চলার মধ্যে।
ব্রিটিশ আমলে বুনো মহিষের পালের খবর রাখত মূলত দেশি-বিদেশি শিকারির দল। বিশালদেহী, ধীরগামী, লুকাতে অক্ষম এই প্রাণীটিকে বন থেকে তাড়িয়ে বাহির করার জন্য ব্যাপক জনবলেরও প্রয়োজন ছিল না। শিকারের চেয়েও কঠিনতর অংশ ছিল এক টনের ওপরে মাংস লোকালয় পর্যন্ত পরিবহন করা। তারপরও যেহেতু সকল ধর্ম ও জাতের মানুষ মহিষের মাংস খায়, তাই কষ্টটুকু সাফল্য হিসেবেই দেখা হতো। মূলত শিকারের কারণেই স্বল্পসংখ্যক বুনো মহিষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় বাদাবন থেকে, উনিশ শতকেই।
হাতি
বুনো হাতি ঢাকার মানুষদের কাছে যেমন ভয়ংকর, তেমনই সমীহের প্রাণী হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও সতেরো শতকেও এশীয় হাতি ঢাকার প্রান্তসীমার কাছের বনের বিচরণ করত না, কিন্তু কাছেরই অপেক্ষাকৃত ঘন বন বিশেষ করে ভাওয়াল, কাপাসিয়া ও কাছিমপুরে এদের দেখা মিলত। পোষা হাতি ভারী মাল টানার কাজে এবং সার্কাসে বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হতো, ফলে নগরবাসীদের কাছে তা ছিল একটি পরিচিত উপকারী প্রাণীর প্রতীক। যদিও এর বিশাল শরীর ও চৌকস শুঁড় কোনো সময়ই লোকমনে কৌতূহল ও ভীতি জাগাতে ব্যর্থ হয়নি। বুনো বা পোষা দুই ধরনের হাতির কাছেই মাহুত ছাড়া কেউ-ই ঘেঁষার সাহস দেখাত না।
ঢাকা থেকে ১০০-২০০ কিলোমিটার উত্তরের কিছু বনে, সিলেটে এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ে উনিশ শতকের বেশ কিছুসংখ্যক হাতি ছিল। সেই সমস্ত এলাকায় স্থানীয় একদল মানুষের কাছে ফাঁদ পেতে হাতি ধরা ছিল একটি লাভজনক ব্যবসা। যে ধরনের ফাঁদ পেতে বুনো হাতি ধরা হতো, তার নাম ছিল খেঁদা। সাধারণত শীতকালেই খেঁদা পাতা হতো, তখন বন কম আদ্র থাকায় সহজেই গভীরে যাওয়া সম্ভব হতো। ঔপনিবেশিক আমলে সরকারি খরচে খেঁদা স্থাপন করা হতো। এই সম্পূর্ণ দেশি উপায় প্রথমবারের মতো বাংলায় ব্যবহার করা হয়েছিল ১৮৬৮ সালে এবং বন বিভাগ তার ব্যবহার শুরু করে ১৯১৫-১৬ সালে। কর্তৃপক্ষ খেঁদার জন্য টেন্ডার আহবান করত এবং প্রতি হাতি ধরার জন্য মাঝে মাঝে ৭৫০ টাকার মতো সম্মানি দিত। (১৯৬৭ সালের চট্টগ্রাম জেলা গ্যাজেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য)।
চট্টগ্রামের এমন একটি ফাঁদে ৮০টি হাতি ধরা পড়ার ঘটনাও জানা যায়, যেখানে পুরো খেঁদাতে হয়তো আটকা ছিল ২০০ প্রাণী। দুঃখজনকভাবে বাচ্চাসহ মা হাতি প্রায়ই ধরা পড়ত এমন ফাঁদে। গত দুই শ বছর নির্বিচারে হাতি ধরা এবং বন ধ্বংসের কারণে বুনো হাতির সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়, আজ অল্প কিছু টিকে আছে কোনোমতে। মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর হাতির পাল ফিরে আসে তাদের চিরচেনা পথ ধরে প্রাচীন বনের পথে, যেখানে গজিয়ে ওঠা কৃষিখেত এবং মানুষের আবাস তখন চাপা পড়ে হাতির পায়ের নিচে।
ঢাকাতে এখন হাতির নামে একটি প্রধান রাস্তা আছে, যাকে আমরা এলিফেন্ট রোড নামে চিনি, যা দিয়ে আজিমপুরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পিলখানার হাতিশালা থেকে হাতি নিয়ে আসা হতো। পিলখানার মাহুতেরা যে এলাকায় থাকতেন, তার নাম টিকে আছে মাহুতটুলী হিসেবেই। সারা দেশে ধৃত হাতিগুলো পিলখানায় এনে সেগুলোতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো অস্ত্র পরিবহনসহ ইংরেজ সামরিক বাহিনীতে নানা কাজের ব্যবহারের জন্য। বেসামরিক কাজে হাতির মূল ব্যবহার ছিল গাছের গুঁড়ি টানা। গত শতকের প্রথমে বাংলায় হাতির অস্তিত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় ইংরেজরা হাতি ধরার কার্যক্রম বাংলা থেকে মিয়ানমারে স্থানান্তর করে।
বিরক্তিকর স্তন্যপায়ী প্রাণী
বানর
বানর হচ্ছে একমাত্র বৃহদাকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী, যা গত চার শ বছর ধরে ঢাকায় যে শুধু বসবাস করছে, তাই-ই না, এমনকি আজকেও এই কংক্রিট অরণ্যে মানুষের গমগমে ভিড়ের মাঝেও তারা টিকে আছে। রেসাস বানর হচ্ছে একমাত্র বানর, যারা পুরান ঢাকার ছাদে এবং শহরের আরেক প্রান্তে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে এখনো টিকে আছে। বানর পরিবারের অন্য যে সদস্য গত শতকেও ঢাকায় বিচরণ করত, তা হচ্ছে মুখপোড়া হনুমান, অবশ্য সমস্ত ‘Langur’কেই বাংলায় হনুমান বলা হয়ে থাকে। সংখ্যায় অনেক বেশি, স্বভাবে সাহসী এবং মন্দিরগুলোতে পালিত হবার কারণে বানরেরা মাঝে মাঝে অসতর্ক মানুষের হাত থেকে খাবার ছিনতাই ও চুরি করার দুঃসাহসও দেখায়। শহরের ভেতরের ও আশপাশের বাগান নষ্ট করার জন্যও তাদের দায়ী করা হয়। যদিও সেটা নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য শোনা যায় না এবং ঢাকা শহরকে বানরমুক্ত করার প্রচেষ্টা কঠোরভাবে কখনোই চালানো হয়নি।
বাগানে হামলার অভিযোগের শিকার বানরেরা এই মহীরুহশূন্য পরিবেশের মন্দিরের প্রাঙ্গণে অথবা সবজিবাজারে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু হনুমানদের জন্য বড় গাছ অত্যাবশ্যকীয়। প্রতিবারই ভূমিতে খাদ্য সংগ্রহের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শেষেই তাদের গাছের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান শহরের বন ছেঁটে একেবারে অদৃশ্য করে ফেলার মত্ততার পাল্লায় হনুমানেরাও চলে যায় ঢাকা ছেড়ে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে হনুমানশূন্য ঢাকায় বানরদের একক করুণ রাজত্ব শুরু হয়।
বৃহত্তর সিলেটের মাধবপুর, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে তাদের দর্শন মেলে। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখনো দেখা যায় ধূসর হনুমান এবং চশমা পরা হনুমানের। সারা দেশে হনুমানদের খুব ক্ষুদ্র এক দল আজও যশোর ও কুষ্টিয়ার কয়েকটি গ্রামে টিকে আছে।
শিয়াল, খেঁকশিয়াল
বিগত চার শতাব্দী ধরে ঢাকা মহানগরীতে এবং এর আশপাশে ‘Canidae’ পরিবারের যে দুটি প্রাণী দেখা যায়, তারা হচ্ছে পাতিশিয়াল ও খেঁকশিয়াল। পাতিশিয়াল মানুষের কাছে সবচেয়ে স্তন্যপায়ী শিকারি প্রাণী বলেই পরিচিত বহু বছর ধরে। যদিও মরাখেকো এবং পোষা মুরগি ও গবাদিপশুর ভক্ষক হিসেবে তার দুর্নামই সর্বজন বিদিত। একই সাথে অতি চতুর বলে পরিচিত হওয়ায় শিয়ালের ধূর্ততার নানা গল্প আমাদের লোকগাথা ও রূপকথায় মেলে।
পাতিশিয়ালেরা নিশাচর এবং আঁধার ঘনিয়ে আসার পরেই বিচরণ শুরু করে, যদিও গোধূলিলগ্নের সাথে সাথেই বিকট চিৎকার এবং সারা রাতে কয়েকবার ডাক দিয়ে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। যেকোনো একটি শিয়াল ডাকার পরপরই দলের বাকিরা সেখানে পাল্লা দিয়ে যোগ দেয়, মনে হয় শুরুর সেই ডাকটি যেন ছিল কোনো প্রলম্বিত দীর্ঘ সুর মূর্ছনার শুরুর আহ্বান মাত্র। যদিও দীর্ঘ ও জোরালো ডাকের মোচ্ছব শিয়ালকে মানবসমাজে আদরণীয় করতে পারেনি কখনোই।
গত কয়েক শতকে ঢাকাতে পাতিশিয়ালের সংখ্যা নিঃশেষ হয়ে গেছে। মানুষ তাদের যতই চালাক বলে অভিহিত করুক, প্রায় কুকুরাকৃতির একটি মাংসাশী প্রাণীর পক্ষে এই বিটুমিন-কংক্রিটের নগরে টিকে থাকার মতো খাদ্য সংস্থান করা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। বরং শহরতলির কোনো প্রান্তরে ইতস্তত বিচ্ছিন্ন শেয়াল দেখলেই মানুষ উল্টো অবাক হয়ে চেয়ে থাকে এককালের বহুল পরিচিত জীবটির দিকে।
পাতিশিয়ালের তুলনায় খেঁকশিয়াল অনেক ছোট, আদরণীয়, নিরিবিলি, লাজুক এক প্রাণী। বড় আকারের জাত ভাইটির মতোই সে-ও মানববসতির আশপাশে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাস করে, পচা-গলা মৃতদেহ খায়, সুযোগ পেলে মুরগি ধরে। যদিও এই কাজটি সে পাতিশিয়ালের তুলনাই খুব কমই করে থাকে। আসলে খেঁকশিয়ালের মূল খাদ্যতালিকায় আছে ছুঁচো, ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর, পোকামাকড়, ফলপাকুড়। উইয়ের ঢিবি থেকে শুরু করে তরমুজের খেত সবই খেঁকশিয়ালের প্রিয় খাবারের জায়গা। বাঙালি জীববিজ্ঞানীদের জন্য গর্বের বিষয় হচ্ছে, এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়েছে বাংলার নামে, ‘Vulpes bengalensis’, যদিও তা প্রিয়দর্শন খুদে প্রাণীটি বুনো পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিশেষ কোনো সহায়ক হয়নি। ঢাকা নগরীর কোথাও খেঁকশিয়াল টিকে নেই এবং সারা দেশেই এর অবস্থা বিপন্ন।
গন্ধগোকুল ও বেজি
গত কয়েক শ বছরে ঢাকার বাসিন্দাদের মাঝে বেশ কয়েক ধরনের ‘Viverridae’ গোত্রের প্রাণী ছিল (ছোট আকৃতির মাংসাশী প্রাণী, যাদের পা খাটো, শু- লম্বা এবং লেজ লোমশ দীর্ঘাকৃতি)। বিশেষ করে গন্ধগোকুল,খাটাশ ও বেজি এই পরিবারের তিন সদস্য ঢাকায় বসবাস করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। ডোরাকাটা শরীর ও রিংওয়ালা লেজের খাটাশকে বরাবরি শহরের অনিষ্টকারী এক প্রাণী হিসেবে ধরা হতো, যাকে রাতের আঁধারে, গোধূলিলগ্নে নিজ আশ্রয় ছেড়ে মানুষের পোষা প্রাণী বিশেষ করে মুরগি ও কবুতর ধরতে দেখা যেত।
কিন্তু মানুষ জানত না যে খাটাশ আসলে অনিষ্টকারী প্রাণীদের জন্য এক দুর্দান্ত জল্লাদ, যে নানা ধরনের ইঁদুর, ছুঁচো ও পোকামাকড় খেয়ে এলাকা সাফ রাখে। লাজুক, নিভৃতচারী, খুদে প্রাণীটি যেকোনো ধ্বংসাবশেষ বা অব্যবহৃত অংশ পেলেই সেখানে আস্তানা গাড়ে এবং সেই আবাসন দুর্গ থেকেই সমস্ত আক্রমণ চালায়। যদিও সেই এলাকার মানুষ এর চলাচলের পথে মামুলি ফাঁসের ফাঁদ অথবা মুরগির কুঠুরির সামনে বড় ইঁদুর মারার ফাঁদ দিয়ে সেই হামলার ইতি টানে।
ঢাকার আরেক ধরনের ‘Civet’ ছিল গন্ধগোকুল, যার ইংরেজি নামের সাথে যতই তাল থাকুক, সে খাটাশের মতোই এক মাংসাশী প্রাণী। জাত ভাইটির মতো তারও মানুষের পোষা মুরগির ওপরে হামলা চালানো ইতিহাসের কারণে ক্ষতিকর, অনিষ্টকারী প্রাণীর তকমা জুটেছে। সাধারণত তালগাছ এদের দিবাকালীন আশ্রয়স্থল এবং বাচ্চা বড় করার নার্সারি হিসেবে ব্যবহার করে। অবস্থাদৃষ্টে কোনো ধ্বংসাবশেষ বা পুরোনো গাছের ফাঁপা গুঁড়ি পেলে তাতেও নিবাস গাড়তে দ্বিধা বোধ করে না।
ঢাকার মানুষেরা অবশ্য খাটাশ ও গন্ধগোকুলের মাঝে তফাৎ করতে পারে না, এদের প্রায় একই রকম আকৃতি, গড়ন ও স্বভাবের কারণে। যদিও চামড়া দেখেই তাদের পার্থক্য বোঝা সম্ভব, গন্ধগোকুলের লোমশ চামড়া গাঢ় ধূসর বর্ণের, মাঝে ফোঁটা ফোঁটা আর লেজে কোনো রিং নেই। তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্য এর বিশেষগ্রন্থি, শত্রুর ওপর নিক্ষেপের জন্য দুর্গন্ধযুক্ত তরল থেকে সঞ্চিত থাকে। এই নাছোড়বান্দা প্রাণীগুলো কয়েক শ বছর বীরদর্পে বিচরণ করে বিড়ালেও আজ গুটিকয়েক হয়তো টিকে আছে গোপন কোনো বাসযোগ্য স্থানে।
খাটাশ এবং গন্ধগোকুলেরা নিশিতে শিকার চালিয়ে যায় কিন্তু তাদের নিকটাত্মীয় বেজি একই কাজ করে দিনভর। তাদের মধ্যে আরেক উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হচ্ছে অন্যরা গাছে চড়তে পটু কিন্তু বেজি আক্রান্ত হলেও গাছ বাইতে পারে না। বহু শতাব্দী ধরে দিবাকালীন দুই পরিচিত শিকারি হচ্ছে নকুল বা ছোট বেজি এবং নেউল বা বড় বেজি, যদিও দুটাকেই মানুষ বেজি বলেই ডাকে এবং তাদের পার্থক্য নিয়ে যে খুব ওয়াকিবহাল, তা-ও নয়।
বেজিরা তাদের ধারালো নখর দিয়ে তৈরি মাটির গর্তে বাস করে এবং যত দিন তাদের খাওয়ার মতো সাপ, ইঁদুর, পোকা থাকে, তত দিন মানববসতির খুব কাছাকাছি টিকে থাকতে পারে। পোষা হাঁসের বাচ্চা আর মুরগির ছানাও তাদের ভোজ্য তালিকায় অংশ নেয় মাঝে মাঝে। নকুল একটু ছোট আকৃতির হয়, দীর্ঘ দেহ, লেজের শেষ প্রান্ত লোম ছাড়া দেখে লাজুক প্রাণীটি চেনা যায়। কোনো এক অজানা কারণে অন্য বেজিটির তুলনায় নকুল অনেক বেশি বিরল শহর এলাকায়। তবে শহরের ক্রমবর্ধমান খাদ্যসংকটের কারণেও হয়তো অপেক্ষাকৃত বিশালদেহী নেউলের কাছে তার পরাজয় মেনে স্থান ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
নেউল সাধারণত বেশ বড় আকারের হয়, সাহসী প্রাণীটির পেছনের পা লোমহীন, লেজের শেষাংশ সাদা লোমে আবৃত থাকে। এটি শহরের অনাকাঙ্খিত বৃশ্চিক, ব্যাঙ, ছুঁচো, ইঁদুর, সাপ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, নেউল নানা বিষধর সাপ এমনকি গোখরাকেও লড়াইয়ে পরাস্ত করতে পারে, যা তাকে মানুষের কাছে কিছুটা হলেও পছন্দনীয় প্রাণীতে পরিণত করেছে। যদিও নেউলের খাদ্যতালিকায় আরও রয়েছে পোষা পাখি, হাঁসের বাচ্চা, অসতর্ক মুরগির ছানা ইত্যাদি। বুনো খাদ্যের জোগান কমে গেলে নেউল মানুষের পালা প্রাণীর ওপরেই বেশি নজর দেওয়া শুরু করে, ফলে অবধারিতভাবেই লড়ুয়ে কোবরা-শিকারি হিসেবে তার জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়ে। মানুষের পাতা ফাঁদ এবং জালের কারণে বেজির সংখ্যা হ্রাস পেলেও খাটাশ ও গন্ধগোকুলের মতো ভয়াবহ হারে নয়। উদ্যমী প্রাণীটি শিকারে দারুণ কুশলতার পরিচয় দিয়ে ঢাকার অনেক স্থানেই ভালোভাবে টিকে আছে।
ইঁদুর
ঢাকা শহরে এখনো একটিও বাড়ি নেই, যেখানে অন্তত এক প্রজাতির ইঁদুরও থাকে না এবং গত চার শ বছরের ইতিহাসেও তাইই ছিল। যদিও চার শতাব্দীতে ঢাকার ভূদৃশ্যে বিপুল সব পরিবর্তন ঘটেছে এবং ইঁদুর বাদে প্রায় সব ধরনের বন্য প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও গত কয়েক শ বছর ধরে ঠিক বর্তমানের মতোই তাদের বিনাশ করার নানা কৌশল কাজে লাগিয়েছে মানুষ, কারণ তারা ক্ষতিকর চঊঝঞ। মনে হয় এই শহরে টিকে থাকার লড়াইয়ে তারাই সবচেয়ে নাছোড়বান্দা ও খাপ খাওয়ে নেওয়ায় পটু প্রাণী। ঢাকার বহুতল অট্টালিকা থেকে শুরু করে পূতিগন্ধময় বস্তি, সবখানেই কয়েক ধরনের ইঁদুরের বিস্তার। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝে ইঁদুর এক বিরল পরিবার, যাদের ক্ষেত্রে সংখ্যা হ্রাস ঘটছে না।
দুই ধরনের ব্যান্ডিকুট ইঁদুর, মেঠো ইঁদুর, ইঁদুর হচ্ছে বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ঢাকার মাঠ, বাগান, পতিত জমি ও বাঁধের বাসিন্দা। ব্যান্ডিকুট ইঁদুরেরা গর্ত খোঁড়া সম্ভব এমন যেকোনো জায়গা বিশেষ করে ধানখেত, সবজিবাগান, বাঁধে বাস করে। তারা ওস্তাদ সাঁতারু, ফলে গর্ত পানিতে ভিজলে বা ভরে গেলে সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না। একধরনের ব্যান্ডিকুট ইঁদুরের বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে বাংলার নামে: ‘Bandicota bengalensis’। তাদের মতোই মেঠো ইঁদুরও মাঠ ও বাগানের গর্তের বাসিন্দা। কিন্তু ইঁদুর মাঠে বাস করলেও যেকোনো ভগ্নস্তূপেও থাকতে পারে। ইঁদুর পরিবারের এই সদস্যরা ঢাকায় অবস্থানের সোনালি দিনগুলো ফেলে এসে তার প্রান্তসীমায় বসবাসরত।
নেংটি ইঁদুর, গেছো ইঁদুর অতীতের মতোই আজও সদর্পে বিচরণ করে ঢাকাতে। ‘গঁৎরফধব’ পরিবারের এই দুই সদস্য আমাদের একান্ত আপনজনের মতোই বাসগৃহে থাকে। তারা আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, আসবাবপত্র ব্যবহার করে, যত্রতত্র বংশবৃদ্ধি করে, ছাদ, প্রাচীর, তাকে ঘুমায়। শত বছরে জীবনযাত্রা ও স্থাপত্যকলার ব্যাপক পরিবর্তন শর্তেও ইঁদুর-মানুষের সম্পর্কের এমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সেই মুঘল আমল, ইংরেজ আমল, পাকিস্তানি আমল অতিবাহিত করেও ইঁদুরেরা মানুষের আশপাশেই বহাল তবিয়তে আছে, আমাদের পূর্বপুরুষদের বিরক্তি ও ঘৃণা তাদের হঠাতে পারেনি ঢাকা থেকে।
সজারু ও খরগোশ
গত কয়েক শ বছর ধরে যে দুই তৃণভোজী প্রাণী রাতের ঢাকার বাগান আর শহরতলির মাঠে অনাহুতভাবে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াত, তারা হচ্ছে সজারু এবং খরগোশ। দুই দলই খাবারের সন্ধানে খুঁজে ফিরত রসাল পাতা, মূল, ডাঁটা, ফুল, ফল, বীজ। মানুষের বাগান তাদের কাছে উৎকৃষ্ট ভোজসভার স্থান, সজারুদের নিয়মিত রাতকালীন আক্রমণের বিরুদ্ধে ফসলের খেত আর সাজানো বাগানে কোনো প্রতিরোধ ছিল না বললেই চলে। এই নিশাচরেরা যেকোনো বেড়া ভেদ করে যেতে পারত, আর কোনো বেড়া অভেদ্য হিসেবে দেখা দিলে স্রেফ সুড়ঙ্গ খুঁড়েই অনুপ্রবেশ করত। ফাঁদ খুঁজে পেতে এবং এড়িয়ে যেতেও এরা যথেষ্টই পটু ছিল। পাহারারত কুকুরেরা এই অনাকাঙ্খিত লুটেরাদের ধরার চেয়ে মালিকদের জাগিয়ে রাখতেই বেশি ব্যস্ত ছিল।
সজারু অসম্ভব দ্রুততার সাথে পেছন ফিরে তার বিষাক্ত কাঁটা উচিয়ে আক্রমণরত কুকুরকে মারাত্মকরূপে আহত করতে পারে, তাই অভিজ্ঞ কুকুরমাত্রই সজারুর কাঁটার ঝমঝম শব্দ পাওয়া মাত্রই স্থাণু হয়ে তাদের এড়িয়ে যেত। বিষাক্ত কাঁটার ফলে অন্যান্য শিকারি প্রাণীর কবল থেকেও তারা নিরাপদ ছিল, কিন্তু মানুষের চাহিদার কারণে বাগান উধাও হয়ে ভবন উঠতে থাকলে মূলত খাদ্যাভাবেই সজারুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ইট-পিচের রাজত্ব বিস্তারের কারণে ঢাকা সজারুশূন্য হয়।
নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য খরগোশদের বিষাক্ত কাঁটা বা কোনো ধারালো অঙ্গই ছিল না। বরং টিকে থাকার লড়াইয়ে তার সম্পদ ছিল সতর্কতা, শারীরিক জোর ও উচ্চমাত্রার প্রজননক্ষমতা। ঘাস ও অন্য ছোট উদ্ভিদখেকো প্রাণীগুলো ঘাসের গর্তে বাস করত। অসংখ্য বাচ্চা পালনের জন্য সেগুলো চমৎকার জায়গা! খরগোশের প্রজনন হতো সারা বছরই, যদিও ঘাস বেড়ে ওঠার সময়ে বাচ্চার সংখ্যা বেড়ে যেত। মানুষ ছাড়াও এই নিরীহ তৃণভোজীদের অনেক শত্রু ছিল। উম্মুক্ত ঘাসপ্রান্তর এমন অসহায় প্রাণীর জন্য এক ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, যেখান দিনে চক্কর দিতে বেজি আর ইগল এবং রাতে প্যাঁচা এবং শিয়াল। যদিও সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয়টি ছিল ঘেসো জমিও উধাও হয়ে যাওয়া। এই নগরে আজ এমন কোনো ময়দান নেই, যেখানে ঘাস বুনোভাবে বাড়তে পারে এবং খরগোশেরা সেখানে বাড়ি বানায়। খরগোশ বর্তমানে বাংলাদেশের এক বিপন্ন প্রাণী।
বাদুড়
বিগত শতাব্দীগুলোতে গোধূলিলগ্নের ঢাকার আকাশ থাকত উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রাজত্ব। আঁধার নেমে এলেই তাদের দেখা যেত ফলের বাগানগুলোতে বা মানুষের আবাস গৃহে ঢুকে দিব্যি উড়ে বেড়াতে, কোথাও একটিবারও ধাক্কা না খেয়েই! তারা হচ্ছে সেই অদ্ভুত দর্শন প্রাণী, যাদের হাতের জায়গায় আছে হাড়, পেশি ও চামড়ার সমন্বয়ে গঠিত ছাতার মতো অঙ্গ, যা তাদের বাতাসে উড়ে বেড়াতে সাহায্য করে, বিজ্ঞানীরা তাদের ‘Chiroptera’ বলে অভিহিত করলেও আমরা তাদের বাদুড় ও চামচিকা বলেই জানি। অতীতে ঢাকায় বেশ কয়েক ধরনের এই উড়ুক্কু জীবেরা থাকত, যারা তিমির ভেদ করে ওড়ার ব্যাপারে যথেষ্ট পারদর্শী ছিল। যদিও এখানে আমরা চার ধরনের উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর কথাই বলব।
অতীত-বর্তমান দুই কালেই ঢাকার সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান বাদুড় ছিল বড় বাদুড় বা চম্পা বাদুড়। একমাত্র এই প্রজাতির বাদুড়ই লোকালয়ের মাঝে উম্মুক্ত গাছের ডালে দিনের বেলা আশ্রয় নেয়। বিশাল দল বেঁধে এরা উল্টো হয়ে সারা দিন ঝুলতে থাকে, দূর থেকে মনে হয় লন্ড্রি থেকে কাপড় রোদে শুকানো হচ্ছে। বিশাল এক জোড়া চোখ দিয়ে এরা নিচের মানুষদের দিকেও নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। নির্ভীক স্বভাব ও বিশালাকৃতির কারণেই এরা মনুষ্যসমাজে সবচেয়ে বেশি পরিচিত বাদুড়। সাঁঝবেলা এরা আশ্রয় ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে ফলগাছের দিকে যাত্রা শুরু করে।
বাদুড় ফলপাকুড় খুবই পছন্দ করে, কাজেই শহরের ফলবাগানগুলোর বেশ ক্ষতিসাধন হয় তাদের দ্বারা। বিশেষ করে ভরা মৌসুমের ফলন্ত গাছগুলো। এই কারণেই শহরের সবচেয়ে ঘৃণ্য বাদুড় হিসেবেই তারা সুপরিচিত ছিল। বাগানের তদারককারীরা অনেক সময়ই লাঠি, জাল, বল্লম নিয়ে সারা রাত টহল দিত বাদুড়ের ফলার রুখতে। তবে বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন সৃষ্টির জন্য ব্যাপক পরিমাণে গাছ উজাড় করে বাসগৃহ নির্মাণ শুরু হলে বাদুড়-মানুষের সেই নৈশযুদ্ধের কথা ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়। আজ ঢাকাতে খুব অল্প সংখ্যায় এই বিশালদেহী ফলখেকো বাদুড়েরা টিকে আছে।
‘Indian Flying Fox’-এর চেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির অন্যান্য উড়ুক্কু নিশাচরদের ভরে রাখত ঢাকার আকাশ, বিশেষ করে ডাইনি বাদুড়, খুদে চামচিকা, বামন চামচিকা। তারা সাধারণত পরিত্যক্ত ভবনের নানা আঁধার কোনায় লুকিয়ে থাকত, রাতে মূলত পোকা ভক্ষণ করতেই বের হতো এবং মানবরাজ্যের জন্য খুব কম সমস্যারই তৈরি করত। এদের মধ্যে ডাইনি বাদুড় ছিল সর্ববৃহদাকৃতির, যাদের খাদ্যতালিকায় ছিল ঝিঁঝি পোকা, ব্যাঙ, মাছ, গিরগিটি, পাখি ইত্যাদি।
চামচিকারা মূলত খুদে পোকা, যেমন গুবরে পোকা, মথ, মশা ইত্যাদি খেয়েই জীবন ধারণ করত। চামচিকা শব্দটি অবশ্য খুব চিকন লোককে অভিহিত করার সময়ও ব্যবহার করা হয়।
পোকামাকড়ের আধিক্যের জন্য চামচিকারা মানুষের আবাস বিশেষ করে আলোজ্বলা রুমেও প্রবেশ করে খাদ্যর অন্বেষণে। অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে যেহেতু পোকারাই উজাড় হয়ে গেছে প্রকৃতি থেকে, তাই পতঙ্গভূক চামচিকারাও নেই হয়ে গেছে আমাদের পরিবেশ থেকে।
আদরণীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী
হরিণ
গত শতাব্দীগুলোতে ঢাকার সমস্ত বুনো প্রাণীই যে এর নাগরিকদের কাছে ভয়ংকর ক্ষতিকর ছিল, তা নয়, বেশ কিছু জন্তু তাদের প্রিয়দের তালিকায়ও ছিল, বিশেষ করে হরিণ ছিল সেই প্রিয় জন্তুদের তালিকার শীর্ষে। ঢাকার ছড়ানো বন, বাদা, ঘাসের প্রান্তরে ছিল চিত্রল হরিণ, মায়া হরিণ, বারশিঙ্গা ও সাম্বার হরিণের বিশাল পাল। মায়া হরিণ হচ্ছে সবচেয়ে দৃঢ় ও ক্ষুদ্রাকৃতির হরিণ, মানুষ তাকে খুব একটা প্রিয়দর্শন মনে করত না এবং জাঁকালো শিঙের অভাবের কারণে শিকারিরাও মায়া হরিণ শিকারের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী ছিল না।
চিত্রল হরিণ ছিল আরেকটু বড় আকৃতির, বর্ণীল, রাজকীয় দর্শন হরিণ, যাদের আছে গাছের ডালের মতো ছড়ানো শিং। দলবদ্ধভাবে এরা চলাচল করে এবং প্রায়ই ফসলের মাঠে খাবারের সন্ধানে নেমে পড়ত। হরিণের প্রাদুর্ভাব থাকলে সেই অঞ্চলের কৃষকেরা কুকুর রেখে হরিণ শিকার করত বা তাড়িয়ে দিত। বারশিঙ্গা ছিল বৃহৎ আকৃতির হরিণ, আর সম্বর একেবারে দানবীয়। যদিও এদের খুব অল্প সংখ্যায় দেখা যেত।
শুধুমাত্র প্রিয়দর্শন ও দৃষ্টির কারণেই নয়, সুস্বাদু মাংস এবং চামড়ার কারণেই ঢাকার নাগরিকদের কাছে হরিণের বিশেষ কদর ছিল। ধনী ব্যক্তিরা তাদের বাড়ি হরিণের শিং, চামড়া ও স্টাফ করা মাথা দিয়ে সাজাতে ভালবাসতেন। হরিণ শিকারের সাথে দেশি-বিদেশি সবাই-ই জড়িত ছিলেন। হরিণ শিকার ছিল অপেক্ষাকৃত সহজতর এবং ঝুঁকিমুক্ত। পাশ্চাত্যের শিকারিরা যখন বন্দুক ব্যবহার করত, দেশিরা ব্যবহার করত জাল এবং ফাঁদ। ডালা শিকারি নামের একদল পেশাদার শিকারি রাতের অন্ধকারে হরিণের চোখে টর্চের আলো ফেলে হতচকিত করে শিকার করত। টর্চের নিচে ধরে রাখা ডালা বা ঝুড়ি, যার আড়ালে তারা আত্মগোপন করত, এখান থেকে তাদের নাম এসেছিল।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই শিকার হরিণের সংখ্যার ওপরে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বিশেষ করে তৃণভূমি, বাদা ও জঙ্গল উজাড় করে ক্রমবর্ধমান শহরের চাপে। ১৯১০-১৯২০-এর মাঝেই ঢাকার শেষ বুনো হরিণগুলো শিকার করা হয় পল্টন, মিরপুর, কুর্মিটোলা ও কাশিমপুরে। বর্তমানে ঢাকার ২০০ কিলোমিটারের মাঝেও কোনো হরিণ বাস করে না। প্রকৃতিতে চিত্রল হরিণ এবং মায়া হরিণ শুধুই সুন্দরবনে থাকে এবং মায়া হরিণ কিছু সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি বনে থাকে, সাম্বার প্রায় বিলুপ্তির মুখোমুখি আর বারশিঙ্গা নাই হয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে।
ভোঁদড়
বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভোঁদড় খুবই আদুরে একটি প্রাণী। আগের শতাব্দীর বাসিন্দাদের কাছে এর ব্যত্যয় ছিল না। ভোঁদড় বিষয়ে অতীত ও বর্তমানের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে তাদের সংখ্যা, তাদের জনপ্রিয়তা নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ভোঁদড়ের দর্শন পাওয়া অতীব দুর্লভ ঘটনা, এমনকি সুন্দরবনের মতো স্থানে যেখানে তাদের আবাস, অথচ প্রাচীন ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে এ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সপ্তদশ শতাব্দীর ঢাকা ছিল অসংখ্য নদী, নালা, জলা, পুকুর, মৌসুমি ডোবার এক বিস্তৃত নেটওয়ার্কে ঘেরা। সেই জলরাজ্যে ছিল ভোঁদড়দের রাজত্ব। জলের অস্তিত্ব থাকলেই বলা চলে সেখানে ভোঁদড় দেখা যেত। তিন ধরনের ভোঁদড় দেখা যেত Oriental Small-clawed Otter, Indian Smooth-coated Otter, Eurasian Otter। এদের মাঝে ইউরেশিয়ান নিশাচর শিকারি হবার কারণে মানুষের কাছে কিছুটা অপরিচিতই ছিল। কিন্তু বাকিদের দেখা দিনের আলোতেই মিলত।
Oriental Small-clawed Otter ছিল এই তিন জাতের মাঝে সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির এবং সংখ্যাতেও বেশি। অগভীর জলের বাসিন্দা এই ভোঁদড়ের খাদ্যতালিকায় ছিল শামুক, কাঁকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি। খাবারের ছিল ব্যাপক প্রাচুর্য এবং সেই খাবারে ভাগ বসানোর মতো প্রাণীর সংখ্যাও ছিল না বললেই চলে। দলবদ্ধভাবে চলাচলরত ভোঁদড়েরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। সামনের দুই পা দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে মাছ ধরার দৃশ্য মানুষের মনে করিয়ে কৌতুককর পটভূমির অবতারণা করে। ভোঁদড়েরা ভূমিতে গর্ত খুঁড়ে তা বিশ্রাম, লুকানো এবং প্রজননের কাজে ব্যবহার করে। সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য যাবতীয় পরিবেশই তাদের ছিল, এবং প্রকৃতিতে তাদের এমন কোনো শত্রু ছিল না, যাদের মাধ্যমে তাদের জনসংখ্যা হ্রাস পেতে পারে।
‘Indian Smooth-coated Otter’ নদী ও হ্রদের গভীর পানিতে বসবাস করে, এরা মূলত মাছখেকো। তারা দলবদ্ধভাবে শিকার করে এবং একসাথে মাছ তাড়িয়ে শিকার করে। জেলেরা ভোঁদড়দের মাছ ধরার দক্ষতা খেয়াল করে পোষা ভোঁদড়দের মাছ তাড়িয়ে জালে নিয়ে ফেলার কৌশল শিখিয়ে তাদের পেশাতে ব্যবহার করে। এখনো নড়াইলের ধীবর সম্প্রদায় এভাবে ভোঁদড়দের পালন করে। তারা এদের ধাইড়া বলে অভিহিত করে, বাংলাতে অবশ্য উদ্বিড়ালও খুবই পরিচিত একটি নাম। জেলেদের ব্যবহৃত সেই ভোঁদড়গুলো অবশ্য বুনো অবস্থা থেকে সংগৃহীত নয়, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ঘরে বড় হওয়া ভোঁদড় সম্প্রদায় যারা মাছ ধরতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে ভোঁদড়দের অস্তিত্ব অবশ্য জেলেদের জন্য হুমকির সম্মুখীন হয়নি, বরং সমস্যা হয়েছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভোঁদড়ের চামড়া রপ্তানিযোগ্য পণ্য বলে গণ্য শুরু হয়। শিকারিরা যেখানেই ভোঁদড় দেখে, সেখানেই শিকার শুরু করে। পোষা ভোঁদড়দের ব্যবহার করে বুনো ভোঁদড়দের বের করত তাদের আস্তানা থেকে। ফ্যাশনেবল পোশাক নির্মাণে ব্যবহারের জন্য চামড়া সরবরাহের তাগিদে আবিস্কার করা হয় নানা কৌশল। হাজার হাজার ভোঁদড় এভাবে হত্যা করে চামড়া চীনে রপ্তানি করা হয়। ফলে জলদি ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সিলেটের মতো ঢাকাও ভোঁদড়শূন্য হয়ে পরে। হরিণের মতো আজ ঢাকার আশপাশের ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ভোঁদড় যায় না। এবং ভোঁদড়ের সমস্ত প্রজাতিই বাংলাদেশে সংকটাপন্ন ও বিলুপ্তির মুখোমুখি।
শুশুক
গাঙেয় শুশুকের সম্পূর্ণ দেহ মানুষ দেখতে না পারলেও মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছে সে অনায়াসে। এরা সারা জীবনই নদীর ঘোলা জলের আড়ালে অতিবাহিত করে। কেবলমাত্র নিশ্বাস নেবার জন্য ওপরে ওঠার সময় এর সিক্ত কালচে দেহের কিছু অংশ দেখা সম্ভব হয় মানুষের পক্ষে। ফলে কেমন এদের নিশ্বাস নেওয়া দেখা সম্ভব হলেও এদের সাঁতার, শিকার, সঙ্গম, বাচ্চার জন্মদান প্রক্রিয়া এবং লালন করা চাক্ষুষ করা সম্ভব হয় না। সারা বিশ্বের মানুষের কাছেই শুশুক এক আদরণীয় প্রাণী। গত চার শ বছরে ঢাকার নদ-নদীতে হাজারো শুশুক দেখা যেত।
এদের কোনো প্রাকৃতিক শত্রু ছিল না এবং ভোঁদড়ের মতো যথেচ্ছ শিকারের সম্মুখীন হয়নি, যার জন্য সকল কৃতিত্ব চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রাপ্ত, যারা শুশুকের চামড়া কদরের সাথে গ্রহণ করেনি। তারপরও শুশুকের জনসংখ্যাও সমপরিমাণে হ্রাস পেয়েছে মূলত শিল্পকারখানার বর্জ্য পানিতে ফেলার জন্য। বিংশ শতাব্দীর শেষ অর্ধে শুশুকের সংখ্যা রাতারাতি হ্রাস পায়, সারা বিশ্বে এদের সংখ্যা বর্তমানে ৫০০০-এরও কম।
সরীসৃপ
ভয়ংকর সরীসৃপ
সাপ
অতীতের ঢাকায় সাপ ছিল বাঘের মতোই, একই সাথে বাস্তবে ও গল্পগাথার প্রাণী। শহরের সর্বত্রই মানুষ সাপ এবং সাপের প্রতি ভয় নিয়ে বাস করত। শুধুমাত্র বন, জঙ্গল, জলা আর প্রান্তরই নয়, প্রতিটি বাড়ি, মন্দির, ফুটপাত, বাগান ও গোরস্থান ছিল সাপের আবাসস্থল। সৌভাগ্যক্রমে তাদের অধিকাংশই বিষধর ছিল না।
কিন্তু পুরাণের সাপেরা এমন ছিল না, তারা ছিল সর্বদাই ভয়ংকর। তারা শুনতে পারত এবং মানুষের সংগীতের বিশেষ ভক্তও ছিল, মানুষকে সম্মোহনে পটু, মানুষের মতো পানাহার এবং বাতাসে উড়তেও পারত। ঢাকার ছিল সাপুড়েদের বিশাল দল, যারা সাপ ধরতে, খেলা দেখাতে এবং কল্পকথার সাপের গল্প বলতে পারঙ্গম ছিল। গল্পের সাপেরা আজও ঢাকায় বহাল তবিয়তে আছে, আসলে বাস্তবে সাপদের চেয়ে তাদের সংখ্যায় এখন অনেক বেশি। বর্তমান ঢাকা মহানগরীতে সাপদের টিকে থাকা খুবই কঠিন একটা কাজ। এখানে আমরা বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে পরিচিত সাপগুলো নিয়ে কথা বলবÑ
গত শতাব্দীর প্রথম দিকেও পল্টন, কুর্মিটোলাসহ ঢাকার অনেক জায়গা অজগরের (Indian Rock Python নিবাস ছিল। আর গোলবাহার অজগর থাকত জঙ্গলে ও বাদায়। মানুষ তাদের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল না, কারণ এরা মূলত বনে, জলাতেই থাকত এবং বুনো পশু শিকার করত। শুরে নাগরিকেরা বরং ধারাজ সাপ, গোখরা, শঙ্খিনী বা কাল কেউটে, যারা মানুষের বেশ কাছাকাছি থাকত, তাদের নিয়েই বেশি জানত।
যাদের সাথে মানুষ এবং গবাদি পশুর প্রতিদিনই মোলাকাত হতো, ফলশ্রুতিতে মানুষ এবং পশু দুইই মারা পড়ত। অনেক মানুষই সাপের কামড়ে মারা যেতেন। সেই যুগে ডাক্তাররাও সাপে কাটা রোগীকে খুব ভালো চিকিৎসা দিতে পারতেন না। বরং ওঝা ও সাপুড়েদের ডেকে তন্ত্রমন্ত্র, পূজা বা ভেষজ ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা চলত। পুলিশ রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও বছরে ১৭ জন মানুষ সাপের কামড়ে মারা যেতেন। এখন এমন মৃত্যু অতি কম এবং শহরের প্রান্তসীমা থেকে অতি দূরে।
কুমির এবং ঘড়িয়াল
সতেরো থেকে উনিশ শতকের ঢাকার নাগরিকেরা কুমিরের চেয়ে কুমিরের আক্রমণের খবর বেশি জানত। শহরের চারপাশের পানি কুমির ও ঘড়িয়াল থাকত এবং কুমিরেরা আসলেই মাঝে মাঝে মানুষের ওপর আক্রমণ চালাত। অধিকাংশ মানুষই অবশ্য কুমির ও ঘড়িয়ালের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না এবং উভয়কেই কুমির বলে সম্বোধন করে। এবং মানুষের কাছে কুমির মানেই নিকটবর্তী নদী-জলার এক নরখাদক প্রাণী।
মিঠা পানির কুমির ঢাকার চারপাশের সমস্ত জলাতেই বাস করত। সাপের মতো তারা লোকালয়ে বাস করত না, কাজেই মানুষের সেধে গিয়ে কুমিরের গ্রাসে পড়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু বাঘের গল্পের মতোই, কুমিরের চেয়ে কুমিরের গল্পই মানুষকে বেশি ভীত করত।
দেশে অন্য অনেক জায়গার মতোই মিঠা পানির কুমির ঢাকার চারপাশের জলাতে বাস করত। রোদ পোহানোর সময় জেলেরা প্রায়ই তাদের দর্শন পেতেন। কাদার মধ্যে এর কাদারঙা শরীর অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ত বিশালত্বের কারণে। তবে কিছুটা ডুবন্ত কুমির চিহ্নিত করা আবার বেশ কঠিন। কুমিরের আক্রমণের ঘটনা খুব একটা বিরল ছিল না, কারণ সুন্দরবনের বাঘের মতোই মিঠাপানির কুমিরও মানুষকে শিকার হিসেবেই দেখত, বিপজ্জনক, কিন্তু সুখাদ্য! ঢাকা জেলার কুমিরের আক্রমণে হতাহতের অনেক ঘটনা ঘটত। ১৮৩৭ সালে পুলিশ রেকর্ড দেখায় যে প্রতিবছরই অন্তত ২ জন মানুষ কুমিরের আক্রমণে মারা যেত। প্রচুর কুমির নিধনের ফলে অধিকাংশ কুমিরই নাই হয়ে যায় প্রকৃতি থেকে, বাকিগুলোও উধাও হয়ে যায় বাসস্থানের অভাবে। আজকে শুধু ঢাকা নয়, সমগ্র বাংলাদেশের কোথাও মিঠাপানির কুমির নেই, একমাত্র খাঁচারগুলো বাদে।
অন্য কুমির, যাকে ঘোট কুমির বলা হতো, এরা ছিল ঘড়িয়াল। দেখতে অনেকটা কুমিরের মতো হলেও তাদের মধ্যে দৃশ্যমান অনেক পার্থক্য ছিল। বিশেষ করে এর লম্বা সরু Snout, যা দিয়ে বড় প্রাণী ধরা সম্ভব ছিল না। এরা ছিল মূলত মাছখেকো এবং নদীর অপেক্ষাকৃত স্থির জলের অংশে অবস্থান করত।
কেবল আত্মরক্ষার জন্যই এরা মানুষকে আক্রমণ করতে বাধ্য হতো, যদিও মানুষের কাছে সেটাই ছিল অগ্রহণযোগ্য অপরাধ। কুমিরের মতো ঘড়িয়ালও সন্ধান পাওয়ামাত্রই নিধন করা হতো। এ ছাড়া পানিদূষণ এবং মাছের অভাবের ফলেও ঘড়িয়ালের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে ঢাকা বা সমগ্র দেশের কোথাও ঘড়িয়ালের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না, শুধুমাত্র ব্যতিক্রমী হিসেবে যমুনায় কয়েকটা ব্যতিক্রমী ঘড়িয়াল বাদে, যারা সেই নদীপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
গুইসাপ
বিগত শতাব্দীগুলোতে ঢাকাতে তিন ধরনের গুইসাপের সন্ধান মিলত, এরা ‘Varanidae’ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এরা ছিল গুইসাপ, সোনাগুই, কালো গুই। তাদের সহজে আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না, ফলে সবগুলোই গুইসাপ নামেই পরিচিত ছিল। বিশ্বখ্যাত কমোডো ড্রাগন এই গুইসাপদের অতি নিকটাত্মীয়। যদিও সেই রকম বৃহদাকৃতির না হলেও মাঝে মাঝেই গুইসাপ আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তাদের মধ্যে ‘Bengal Monitor’ বা গুইসাপের বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়েছে বাংলার নামে Varanus bengalensis।
মানুষের কাছে স্বাগত না হলেও গুইসাপেরা সাধারণত বসতবাড়ির উঠানেই থাকত। এর মোটেও বিষাক্ত বা ভয়ংকর জীব না। যদিও তাদের নোংরা এবং কুৎসিত বলেই মনে করা হয়। গোরখোদক এবং মড়াখেকো হিসেবে তাদের যথেষ্ট দুর্নামও ছিল। কয়েকটা আদিবাসী গোত্রের কাছে গুইসাপ অতি সুস্বাদু খাদ্য বলে গণ্য হতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জলা, পুকুর, ডোবা এবং পরিত্যক্ত জমির আস্তে আস্তে দখল হয়ে যাওয়া ঢাকার গুইসাপেরা উধাও হয়ে যায়। এখন এই বিশাল মহানগরীর কোনো কোনো স্থানে খুবই অল্প সংখ্যায় এরা টিকে আছে নিজের দক্ষতায় এবং বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছায়।
ভক্ষণ উপযুক্ত সরীসৃপ
কচ্ছপ
কচ্ছপ হচ্ছে একমাত্র সরীসৃপ, যা মানুষের খাদ্য হিসেবে ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোতে চার শ বছর ধরে বিক্রি হয়ে আসত। মুসলমানদের কাছে অবশ্য কচ্ছপ হালাল বলে গণ্য নয়, কিন্তু অন্য অধিকাংশ ধর্মের অনুসারীদের কাছে কচ্ছপের মাংস এবং ডিম বিশেষ ধরনের খাবার হিসেবেই বিবেচিত হত। কচ্ছপের মাংস এবং ডিম গরিব জনগণের কাছে আমিষের সস্তা উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কচ্ছপের খোল এবং মাংস থেকে যক্ষ্মা, পাইলস, আগুনে পোড়া, ক্ষুধামান্দ্য, চোখের সমস্যা, সর্দি, ঠান্ডা ইত্যাদি নানা রোগের ওষুধ নির্মাণে ব্যবহৃত হতো।
১৯৪৭ পর্যন্ত তাদের সংখ্যা বেশ ভালোই ছিল। শহরের ভেতরে ও বাইরে কচ্ছপ নিধন সমানে চলত, নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে কচ্ছপ ধরে ঢাকা পাঠানো হতো খাদ্যসামগ্রী হিসেবে। বিশ শতকের শেষার্ধে দূর প্রাচ্যের দেশগুলোতেও কচ্ছপ রপ্তানি করা হতো। এখন পর্যন্ত কচ্ছপ হচ্ছে ঢাকার একমাত্র সরীসৃপ, যা ঢাকাবাসীরা স্রেফ খেয়েই বিলুপ্ত করে দিয়েছে।
বড়শি, জাল এবং বিশেষ ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে কচ্ছপ ধরা হতো। মানুষ হাত দিয়েও অগভীর পানিতে তাদের ধরতে সক্ষম ছিল, অথবা পানির ওপরে নিশ্বাস নেওয়ার সময়, সঙ্গমের সময় বা ডিম পাড়ার সময়ও ধরা হতো। যে কচ্ছপটি মানুষ মূলত খেত, তা হচ্ছে ধুম কাছিম, খালুয়া কাছিম এবং সুন্ধি কাছিম। এই তিন প্রজাতিই আজ শিকার এবং আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে বিলুপ্তির সম্মুখীন। এ ছাড়া সিম কাছিম দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় বিক্রির জন্য আনা হতো। এই দুই প্রজাতিই আজ সারা বিশ্বে সংকটাপন্ন।
সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ