গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক দেশি-বিদেশি নানা প্রাণী ও পাখির বৈচিত্র্যময় সম্ভারে মুগ্ধ আগত দর্শনার্থীরা।
বিভিন্ন সময় এখানে প্রাণীর মৃত্যু ঘটলেও সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে সম্প্রতি। এই সময়ে অন্তত কয়েকটি বড় আকারের জেব্রা মারা গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে মৃত প্রাণীদের মধ্যে আফ্রিকান প্রাণীর সংখ্যাই বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকায় প্রাণীগুলো যে পরিবেশে থাকে, তা নিশ্চিত করতে পারছে না পার্ক কর্তৃপক্ষ। এ কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
দেশে দুটি সাফারি পার্ক রয়েছে। একটি কক্সবাজারের ডুলাহাজারায়, অপরটি গাজীপুরের শ্রীপুরে। শ্রীপুরের পার্কটিতে গত আড়াই মাসে ১১টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও একটি সিংহীর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছে ১টি লেমুর। এই ১৪টি প্রাণীর সব কটিই আফ্রিকান।
সাম্প্রতিক সময়ই যে কেবল পার্কটিতে আফ্রিকান প্রাণী বেশি মারা যাচ্ছে, তা নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রকল্পের ওপর ২০১৬ সালের জুনে দেওয়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) দেওয়া একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে এই পার্কে অন্তত ৫৬টি প্রাণীর মৃত্যু হয়।
৫৬টি প্রাণীর মধ্যে ৩২টিই ছিল আফ্রিকান। এর মধ্যে সাতটি জেব্রা, দুটি আফ্রিকান সিংহ, তিনটি আফ্রিকান সাদা সিংহ, দুটি কমন ইল্যান্ড, একটি জিরাফ, সাতটি অরিক্স, চারটি ব্ল্যাক ওয়াইল্ডবিস্ট, একটি ব্লু ওয়াইল্ডবিস্ট, তিনটি ব্লেসবক ও দুটি আলপাকা। বাকিগুলো এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সাইবেরিয়াসহ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের এবং এগুলোর অধিকাংশই পাখিজাতীয় প্রাণী। আইএমইডির প্রতিবেদনে এই মৃত্যুর হারকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ নিয়ে সাফারি পার্কে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কী কারণে এই কদিনে এতগুলো জেব্রা মারা গেল তা নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা’। এটা কোনো ভাইরাস নাকি ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ তা নিয়ে পার্কে দফায় দফায় বিশেষজ্ঞদের বৈঠক হয়েছে। এখনো কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি বলেও পার্ক সূত্র জানিয়েছে।
মৃত প্রাণীর মরদেহের নমুনা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল বিচ্ছিন্নভাবে এসেছে।
সূত্র জানায়, অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু হলেও একই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। তবে জেব্রার এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে নমুনা পরীক্ষা করে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
শ্রীপুরের পার্কটিতে গত আড়াই মাসে ১১টি জেব্রা, ১টি বাঘ ও একটি সিংহীর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছে ১টি লেমুর। এই ১৪টি প্রাণীর সব কটিই আফ্রিকান।
সম্প্রতি জেব্রার সংখ্যা দিন দিন বাড়ার কারণে এখান থেকে জাতীয় চিড়িয়াখানায় কিছু জেব্রা পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন মৃত্যু পার্ক সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। চিন্তায় পড়ে গেছেন বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী জানান, সাফারি পার্কে জেব্রাকে ঘাস সরবরাহ করে মাহবুব এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। চারণভূমির ঘাস খাওয়ানোর পাশাপাশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘাস এনে জেব্রাসহ অন্য প্রাণীদের খাওয়ানো হচ্ছে। এসব ঘাসেও বিষক্রিয়া হতে পারে বলে অনেকেই সন্দেহ করছেন।
এ ব্যাপারে সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (এসিএফ) তবিবুর রহমান বলেন, ঘাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক সিরাজুল ইসলামকে নিয়ে মানিকগঞ্জে গিয়েছি। চেষ্টা করছি বের করতে আসলে কেন জেব্রার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
ঘাসে কোনো বিষক্রিয়া হচ্ছে কিনা তাও ভাবছি। ঘাস উৎপাদন করা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সাফারি পার্কের চারণভূমির ঘাস ও মাটি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে পরীক্ষাগারে। কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে নয়টি জেব্রার পাকস্থলীর বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষা করে নাইট্রো ফসফরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাছাড়াও বিভিন্ন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলেছে।
আফ্রিকার সাভানা প্রান্তরে লতাগুল্মজাতীয় প্রচুর ঘাস জন্মে। জেব্রা, জিরাফ, কমন ইল্যান্ডসহ আফ্রিকার তৃণভোজী প্রাণীগুলো সেসব খেয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু গাজীপুরের সাফারি পার্কে তৃণভোজী এসব প্রাণী রাখা হয়েছে শালবনে। শালগাছ উঁচু হওয়ায় তা জিরাফ ছাড়া অন্য প্রাণীর নাগালের বাইরে। শালগাছের বাইরেও কিছু লতাপাতা জন্মায়, তবে সেসবের সঙ্গে আফ্রিকার প্রাণীগুলো অপরিচিত ও অপর্যাপ্ত। এ পার্কের পরিকল্পনায় তৃণভূমি তৈরির কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
পার্কে তৃণভোজী প্রাণী জেব্রা, জিরাফ, কমন ইল্যান্ড যে জায়গায় রাখা হয়েছে, সেখানে শালগাছ ছাড়াও বিভিন্ন লতাপাতা জন্মায়। এসব লতাপাতা বা খাবারের সঙ্গে পরিচিত নয় আফ্রিকান প্রাণীগুলো।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রাণীর জন্য যেটা খাবার, আফ্রিকার প্রাণীর জন্য সেটা বিষ হতে পারে। শালবাগানে ছেড়ে দিলে ওই গাছের পাতায়, কাণ্ডে ও বোঁটায় যেসব উপাদান আছে, সেগুলো আফ্রিকান প্রাণীগুলো খেতে পারবে কি না, তা জানতে হবে। যে গাছে প্রাণীর ক্ষতি হবে, সেই গাছ সরাতে হবে। তারপর সেখানে এগুলোকে ছাড়তে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি প্রাণী যেসব খাবার খায়, তাদের সেই খাবারই দিতে হবে। সেসব খাবার দেশে উৎপাদন করতে হবে, অথবা বিদেশ থেকে আনতে হবে। তারা যে খাবার যতটা খায়, সে অনুযায়ী দিতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তাৎক্ষণিক সংকট বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানো এবং মহৎ ভাবনা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ হিসেবে নিজেদের এই দক্ষতা নিয়ে আমরা গর্বিত। অন্য প্রাণীরা ব্যস্ত থাকে খাবারের অন্বেষণে, নীড়ের খোঁজে অথবা নীড় তৈরির কাজে। সেখানে মানুষ বোঝে সময়ের গুরুত্ব। এই মহাজগতে নিজ অবস্থান খুঁজে নিতে চাই আমরা। অথবা ডাইনোসরের মতো বৃহৎ প্রাণীর অবলুপ্তি কেন ঘটল, সেই প্রশ্ন নিয়ে বিব্রত থাকি। কোনো কোনো সময় আমরাও বাস্তবতা বুঝতে পারি না বা সে চেষ্টা করি না। আমাদের তেমনই ঘাটতি বা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে বিশ্ব থেকে বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হতে চলেছে, যার দায় অনেকাংশেই আমাদের।
তারা বলেন, জনসংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে আমাদের খাদ্যগ্রহণ। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এর কারণেই বর্ণহীন হয়ে পড়ছে শৈবাল। আবাস হারাচ্ছে তারা। পরিবেশের জরুরি অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে দায়িত্বপূর্ণ পরিকল্পনা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তবে বন্য জীবনের ক্ষেত্রেও বিশেষ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বনভূমি কেটে পরিষ্কার করে গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করা হচ্ছে। কীটনাশক ও সারের ব্যবহারে দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি ও মাটি। একই সঙ্গে সমুদ্র ও আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলায় ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিক। রাষ্ট্রপ্রধানদের উচিত ব্যক্তিগতভাবে এসব ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৬
আপনার মতামত জানানঃ