কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে, তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চীন সরকার নিজ উদ্যোগ ও খরচে দুই বছর ধরে তিস্তার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে একটি প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, তিস্তা নদীর ভূপ্রাকৃতিক গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হবে। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ২৭টি প্রকল্পের চুক্তি হয়েছিল। তার মধ্যে তিস্তা প্রকল্পও ছিল। প্রকল্পটি শুরুর পরপরই নানা জটে পড়ে। এখনও এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আশায় উত্তরের মানুষ।
সম্প্রতি, তিস্তা ব্যারেজ এলাকা পরিদর্শন করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সহ তিন সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের দল। গতকাল রোববার (৯ অক্টোবর) দুপুরে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ এলাকা ও সেচ প্রকল্প পরিদর্শন করে তারা পুরো এলাকা ঘুরে দেখেন।
এ সময় লি জিমিং উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমার আসলেই স্থানীয় জনগণের চাহিদা এবং কিসে তাদের ভালো হয় সেটা জানা দরকার। সেটাই আমার বা চীনের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে বিআরআই (চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) একটি বড় প্রকল্প। আমাদের সব অংশীদারদের কাছ থেকে সব ধরনের অংশগ্রহণ দরকার। তিস্তা একটি বৃহৎ নদী, এটি খনন করতে পারলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন হবে। এটি বাংলাদেশে আমার প্রথম কাজ। যদিও এ প্রকল্প বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের, এরপরও এটি করবো।
নদীটি খননের সম্ভবতা যাচাই করতেই তাদের দুইদিনের এই সফর জানিয়ে রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, “আমাদের প্রকৌশলীরা বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর পরিকল্পনা করবো কবে থেকে কাজটি শুরু করা যায়। তবে আশা করছি শিগগির তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করতে পারবো। এটি শুধু এ অঞ্চলের মানুষের জন্য সুসংবাদ নয়, পুরো বাংলাদেশিদের জন্যেও গর্বের বিষয়।”
শুষ্ক মৌসুমে পানি সঙ্কট দূর করা, তীর ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণে তিস্তা নদী ঘিরে সরকারের নেওয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
তিনি বলেন, “তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। এখানকার মানুষ, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশ, লোকজনের চিন্তা-ভাবনা, মানসিকতা তিস্তা মহাপরিকল্পনার পক্ষেই। তাই আমরা এই মহাপরিকল্পনাটির পুরো বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করব।”
এ বিষয়ে হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম আসনের সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী মোতাহার হোসেন বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূত এখানে আসছেন। উনার সাথে আলোচনায় দেখলাম, উনারা খুব পজিটিভ এই ব্যারেজের কাজ করতে।
আমিও ব্যক্তিগতভাবে (এটা) মনে করি। আমি ১১/১২ বার চীন গিয়েছি। ৫ বার আমি ওদের হোয়াং হো নদী দেখতে গিয়েছিলাম। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়েছে যে, তারাই পারবে, আর কেউ পারবে না।
তিস্তা প্রকল্পে কী রয়েছে?
প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে ১০০০ মিটারে সীমাবদ্ধ করা হবে। নদীর গভীরতা বাড়ানো হবে ১০ মিটার।
নদী শাসনের মাধ্যমে তিস্তা নদীকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হবে, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি বহনক্ষমতা বাড়ানো হবে, নদীর দুই পাড়ে বিদ্যমান বাঁধের মেরামত করা হবে, নদীর দুই পাড়ে মোট ১০২ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে, ৫০টি গ্রয়েন স্থাপন করা হবে, ড্রেজিংয়ের মাটি ভরাট করে নদীর দুই পাড়ে ১৭০ বর্গকিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবিত তিস্তা নদীর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, ৯৮৩ মিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি প্রাপ্যতা বৃদ্ধি, জমি উদ্ধার, নৌ-চলাচল বৃদ্ধিসহ তিস্তাপাড়ে কৃষি অঞ্চল, শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রকল্প, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হবে এবং তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা হবে।
চিলমারী বন্দর থেকে ডালিয়ায় তিস্তা বাঁধ অংশে তিনটি নৌ-টার্মিনাল তৈরি করা হবে। নদীর দুই পাড়ে হাইওয়ে তৈরি করা হবে, যার মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হবে।
ভারতের বাধা কেন?
তিস্তা প্রকল্প পরিকল্পনার শুরু থেকেই শোনা যাচ্ছিল, এতে ভারতের প্রবল আপত্তি রয়েছে। সেই বিবেচনায় সেটি অনুমোদনের জন্য একনেকে উত্থাপন করা হচ্ছে না। ভারত তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনাদের উপস্থিতি চায় না।
তাদের দাবি, শিলিগুঁড়ি করিডরের ‘চিকেন নেকে’র কাছে তিস্তা প্রকল্পে বিপুল সংখ্যক চীনা নাগরিকের উপস্থিতি মেনে নেয়ার মতো নয়। অর্থাৎ চীনা প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের হুমকি হিসেবে দেখছে ভারত।
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশের একটি নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে কাজ করবেন প্রকৌশলীরা। তারা তো চীনা সেনা বা গোয়েন্দা নন। আর তিস্তা নদী বাংলাদেশ অংশ থেকে ‘চিকেন নেক’ অনেক দূরে।
তিস্তার দক্ষিণ-পূর্বদিকের ভাটি থেকে প্রকল্পের কাজ যত এগোবে, ভারত সীমান্ত থেকে দূরত্ব বাড়তে থাকবে। তবে এ প্রকল্পে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বাগড়া রয়েছে, তা স্পষ্ট।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, তিস্তা যেহেতু একটি অভিন্ন নদী, এ ব্যাপারে ভারতের মতেরও গুরুত্ব রয়েছে। অর্থাৎ তিস্তা নদী উন্নয়ন যদি বাংলাদেশ করতে চায়, তাহলে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে করতে হবে। একইভাবে অভিন্ন নদীতে যদি ভারতও কিছু করতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করেই করা উচিত।
কড়া নজর রাখবে ভারত
মোতাহার হোসেন বলেন, চীন দিয়েছে আট হাজার চারশো কোটি টাকা। আর ভারত দিয়েছে দুই হাজার চারশো কোটি টাকা। আমাদের ফাইনান্সাররা (বিশ্বব্যাংক, এডিবি) বললো, এটা কিভাবে সম্ভব! দুই হাজার কোটি আর আট হাজার কোটি!
সম্প্রতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত গিয়েছিলেন। সেখানে নানা ইস্যুতে আলোচনা-অগ্রগতি হলেও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বরাবরের মতো এবারও অধরাই থেকে যায়। ভারতের সংবাদ মাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনালকে (এএনআই) দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা চুক্তি এখন ভারতের ওপরই নির্ভর করছে।
উল্লেখ্য, চার দিনের ভারত সফরের আগে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তার পানির জন্য বাংলাদেশে চাষাবাদে সমস্যা হয়। একই কারণে আরও নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তা সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু ভারতের ভেতরেই এ নিয়ে সমস্যা আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে আমরা…আপনি জানেন, আমরা ভাটির দেশ। তাই ভারত থেকে পানি আসছে। তাই ভারতের আরও উদারতা দেখাতে হবে। কারণ, এতে উভয় দেশই লাভবান হবে। তাই মাঝে মাঝে এই পানির প্রয়োজনে আমাদের জনগণকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশেষ করে তিস্তার কারণে। এর কারণে চাষাবাদে সমস্যা হয়। আরও অনেক সমস্যা তৈরি হয়। তাই আমার মনে হয়, এ সমস্যার সমাধান করা উচিত। আমরা দেখেছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) এ সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু সমস্যাটা আপনাদের (ভারতের) দেশের ভেতরে। তাই আমার মনে হয়, এর সমাধান হওয়া উচিত।’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে ভারতীয় পক্ষ কাজ করছে।
তবে সম্ভাব্য দ্রুততম সময় আসলে কতটা দ্রুত, সেটা দ্রুততম সময়ে মনে হয় না বলা সম্ভব। এদিকে, গত কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে, তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, চীন সরকার নিজ উদ্যোগ ও খরচে দুই বছর ধরে তিস্তার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে একটি প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দেয়।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, তিস্তা নদীর ভূপ্রাকৃতিক গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হবে। তাছাড়া, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সে সময় দুই দেশের মধ্যে যে ২৭টি প্রকল্পের চুক্তি হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে তিস্তা প্রকল্পও ছিল। সবমিলিয়ে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের আগ্রহ এবং কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপে ভারত যে কড়া নজর রাখবে তা বলাইবাহুল্য।
তিস্তা প্রকল্পে চীনের স্বার্থ কী?
বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার (২০০৭-০৯) পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ হতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে তাদের যা যা করা দরকার, তাই করছে। চীন এখন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ বা অন্যান্য মাধ্যমে প্রভাব বাড়াতে চেষ্টা করছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে তিস্তা প্রকল্পে চীন এগিয়ে আসছে। চীন বাংলাদেশকে যে অর্থ দিচ্ছে, তা বাণিজ্যিক সুদের হার মিলিয়ে ফেরত দিতে হবে।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদুল আলম বলেন, চীনের রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি দেখতে গেলে সেটা আমাদের জন্য আপাতদৃষ্টিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে না। চীন আসলে তার বিআরআইর আওতায় বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কর্মকৌশলের বিপরীতে নিজেদের বলয়কে শক্তিশালী করতে চাইছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ভারতের পছন্দ না হলেও তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, চীনের পক্ষ থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ওপর কোনো শর্তারোপের বিষয়ও নেই, শুধু তাদের ঋণে এটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এটিকে এই মুহূর্তে আমরা বাংলাদেশ সরকারের ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির একটি চমৎকার ও সফল উদাহরণ বলতে পারি।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ