বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে শ্রমিকদের কল্যাণে গঠিত তহবিলে কোটি কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। শ্রমিকরা সঙ্কটে রয়েছে বলে বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবেদনে দাবি করলেও শ্রম মন্ত্রণালয় বেকার ও দুঃস্থ শ্রমিক খুঁজে পাচ্ছে না। যে কারণে তহবিলে পড়ে থাকছে কোটি কোটি অলস টাকা। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশি ও বিদেশি দুটি তহবিলের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে জানা গেছে। উভয় তহবিল মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। এই দুই তহবিলের ১০ শতাংশও খরচ হচ্ছে না শ্রমিকের কল্যাণে।
জানা যায়, বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের কল্যাণে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামক একটি বিশেষ তহবিল রয়েছে। প্রত্যেক কম্পানির নিট লাভের শতকরা পাঁচ ভাগের এক-দশমাংশ এ তহবিলে জমা প্রদানের বিধান রয়েছে। এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি এবং বহুজাতিক মিলে ১৭৬টি কম্পানি এ তহবিলে অর্থ প্রদান করছে। তহবিলটিতে জমার পরিমাণ প্রায় ৪৯৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষ পক্ষ পর্যন্ত এ তহবিল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রায় সাড়ে দশ হাজার শ্রমিককে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তহবিলটির ১০ শতাংশও খরচ করেনি শ্রম মন্ত্রণালয়।
এদিকে করোনাকালে ইইউ ও জার্মানি জানায়, বাংলাদেশের রফতানিমুখী উৎপাদনশীল শিল্প খাতের কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের প্রণোদনার জন্য ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো দেবে। প্রতি ইউরো ১০০ টাকা ৪৭ পয়সা হিসাবে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এই টাকা প্রাপ্তি গত মে মাসে নিশ্চিত হলেও শ্রমিকরা আদৌ এই সহায়তা পাবে কিনা, তা নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। কর্মহীন হওয়া শ্রমিকের তালিকা না থাকা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও সংজ্ঞায়ন না হওয়া এবং মালিকপক্ষের মতানৈক্যের কারণে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেরি করে সরকার ও মালিকদের সংগঠনগুলো।
শেষ পর্যন্ত ইইউ ও জার্মানির দেয়া অর্থে গঠিত তহবিলের অর্থ প্রদান শুরু হয়েছে। তবে এই তহবিল থেকে শুরুতে মাত্র ১ হাজার ৭৯৪ জন চাকরি হারানো শ্রমিক তিন মাসে তিন হাজার করে তিন কিস্তিতে পাবেন মোট ৯ হাজার টাকা। তাতে করে প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার এই তহবিল থেকে ব্যয় হবে দুই কোটি টাকারও কম। প্রথম ধাপে খুব কমসংখ্যক শ্রমিক তালিকায় এসেছেন বলে স্বীকার করেছে মন্ত্রণালয়ও। পর্যায়ক্রমে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিককে এই তালিকায় আনা হবে বলে জানিয়েছে তারা। ১০ হাজার শ্রমিককে ৯ হাজার টাকা করে দেয়া হলে খরচ হবে ৯০ কোটি টাকা। যা কিনা এই তহবিলের ১০ শতাংশের চেয়ে অনেক কম।
উভয় তহবিলের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কল্যাণে কাজে লাগছে না এসব তহবিল। অলস পড়ে আছে শ্রমিকের বিপদের দিনের অবলম্বন। সরকার ও মালিকদের ভাষ্য, ইইউ এবং জার্মান সরকার মিলে ১০ লাখ শ্রমিকের জন্য তিন হাজার টাকা করে দিলেও বর্তমানে এত শ্রমিক কর্মহীন নেই। সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) জুলাই মাসের হিসাব অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর ১৫ হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে এসব কারখানায় কর্মরত প্রায় ১০ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিকের বেশির ভাগই বেকার হয়ে পড়েন। ডিআইএফই তখন জানায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রায় ২ হাজার গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে বেশির ভাগই রপ্তানিমুখী। তবে এ তালিকায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক মালিকের বাইরেও বিপুলসংখ্যক কারখানা রয়েছে।
কিন্তু গার্মেন্ট মালিকরা বরাবরই বেকার শ্রমিকদের তালিকা প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সরকারও জোরালো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে প্রকৃতপক্ষে বেকার শ্রমিকের সংখ্যা কত সেটা নির্ধারণ করা যায়নি। আগস্ট মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে করোনা সংকটে সোয়া ৩ লাখ পোশাক শ্রমিক তাদের কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে বলে দাবি করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, বিলস। তবে সেই মাসেই ১০ লাখ বেকার শ্রমিককে সহায়তা দেয়ার প্রশ্নে বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘কর্মহীন এত শ্রমিক নাও থাকতে পারে।’
খবরে প্রকাশ, এই তহবিলের অর্থপ্রদানে গাফিলতি ছাড়াও এ নিয়ে মালিকরা দ্বন্দ্বে জড়ায়। সেই দ্বন্দ্ব সমাধান করে সরকার যে বঞ্চিত শ্রমিকদের প্রণোদনার অর্থ পৌঁছে দেবে, সেটা সঠিকভাবে এখনো সম্পন্ন হচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর আলাপেই এসেছে যে, মালিকদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের চিহ্নিত করতে দেরি হচ্ছে। সরকারের বক্তব্যে এমন স্বীকৃতি মিলছে বটে, তবে সরকার গার্মেন্ট মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে দেখা যায় না। এ অবস্থায় সরকারের ভেতরে কারা শ্রমিকদের পাওনা অর্থ প্রদানে বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের খুঁজে বের করার ওপর তাগিদ দিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।
তহবিল থাকতেও দরিদ্র্যরা অর্থ পাচ্ছে না, এটা সরকারের অদক্ষতা সদিচ্ছার অভাবকেই প্রতিফলিত করে। করোনাকালে দরিদ্র্য পরিবারগুলোর জন্য সরকারের নেওয়া বিশেষ সহায়তা কর্মসূচিও হোঁচট খেয়েছে। ৫০ লাখ পরিবারকে এ সহায়তা দেওয়ার কথা ছিল। দুই দফা তালিকা তৈরির পরও ১৫ লাখ পরিবারের জায়গা খালি রয়েছে। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নেই, বিষয়টা তেমন নয়। শ্রমিকরা গরিব, তাদের এত টাকা প্রয়োজন নেই, সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশের এমন মনোভাবও এর পেছনে ভূমিকা রাখছেন বলে দাবি শ্রম অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ