করোনার কারণে দেশের অনেক শিল্পকারখানা লম্বা সময় বন্ধ রাখতে হয়েছে। তাতে রপ্তানি কমে গেছে। কোনো কোনো কারখানা মজুরি কমিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, অনেক কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া সেসব শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়েছে ইইউ ও জার্মানি। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পের কর্মহীন ও দুস্থ শ্রমিকদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মান সরকার ১১৩ মিলিয়ন ইউরো (১১৭৫ কোটি টাকা) প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজের আওতায় সরকার ১০ লাখ শ্রমিককে মাসে ৩ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিবে। কিন্তু সমস্যাটা বেঁধেছে, এই সহায়তা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত বেকার শ্রমিক খুঁজে পাচ্ছে না শ্রম মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি।
কর্মহীন হওয়া শ্রমিকের তালিকা না থাকা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও সজ্ঞায়ন না হওয়া এবং মালিকপক্ষের মতানৈক্যের কারণে এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এখনও পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ১৫ ডিসেম্বর কমিটির বৈঠকে প্রণোদনার যোগ্য হিসেবে ৭ হাজার ৩৯০ জন শ্রমিকের তালিকা করেছে। আজ রবিবার বৈঠকে তালিকা চূড়ান্ত হবে। প্রথম কিস্তি ২৪ ডিসেম্বর শ্রমিকের ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হবে। এ ছাড়া বণ্টনের পর অবশিষ্ট যে টাকা থাকবে, সেটাও শ্রমিকের কল্যাণে ব্যয়ের জন্য প্রস্তাব দেবে কমিটি।
তবে এই তালিকার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না খোদ শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় দেশ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘করোনায় অনেক মানুষের চাকরি গেছে। কিন্তু মালিকদের গড়িমসির কারণে তালিকায় তাদের নাম দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরশু বৃহস্পতিবার শ্রম অধিদপ্তরের ডিজি মিজানুর রহমান আমাকে ৭ হাজার শ্রমিকের কথা বলেছেন। কিন্তু এটা তো বিশ্বাসযোগ্য না। এখন নাকি এই তালিকা ১০ হাজার জনে পৌঁছেছে।
তিনি বলেন, আমি কারখানার মালিকদের কাছে হাজিরা খাতা চাইছিলাম। কিন্তু তারা সেটা দেননি। আমিও তাদের ছাড় দেব না। আমার কাছে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে। এক লাখের বেশি চাকরি হারানোর তথ্য আমার কাছে আছে। আমি এদের প্রত্যেককে ধরব।’
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের বলব, আপনারা যারা চাকরি হারিয়েছেন কারও কাছে যেতে হবে না। সোজা আমার কাছে চলে আসেন। কোনো অনুমতিও লাগবে না। আপনাদের এই টাকা আমি দিয়ে দেব। প্রণোদনার প্রতিটি টাকাই আমরা শ্রমিককে দেব। যেসব মালিক ছাঁটাই শ্রমিকের সঠিক তালিকা দেননি, তাদেরও আমি দেখে নেব।’
তালিকার বিষয়ে কমিটির সদস্য ও পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘কমিটি গঠনের পর আমরা কয়েকটি বৈঠক করেছি। বিকেএমইএ, পোশাক কারখানা মালিকদের আরেক সংগঠন বিজিএমইএ, টেক্সটাইল কারখানা মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন এলএফএমইএবি থেকে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের তালিকা সংগ্রহ করেছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ৭ হাজার ৩৯০ জন শ্রমিক এখনো বেকার আছে বলে আমরা নিশ্চিত হই। পুরো তালিকা করা হয়েছে কারখানার মালিকদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। যদি কেউ তালিকার বাইরে থেকে থাকেন আমাদের কাছে এলেই হবে। আমরা তাকে টাকা দেব।’
চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে সব দেশেই কর্মসংস্থান ও আর্থিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পেও কর্মীদের বেতন-ভাতা, উৎপাদন ও রপ্তানি প্রক্রিয়া নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
মালিকপক্ষের হিসাবে, গত মার্চ বাংলাদেশে ভাইরাসের প্রদুর্ভাবের শুরুর দিকেই প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছিল। অবশ্য এর মধ্যে কিছু কাজ পরে ফিরে আসে।
এই সঙ্কটে কারখানা বন্ধ হওয়ায় এপ্রিল, মে ও জুন মাসে পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ‘কয়েক লাখ’ চাকরিচ্যুত হন বলে শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্য।
অফিসে (ফরমাল সেক্টর) চাকরি করেন এমন ১৩ ভাগ মানুষ করোনায় এপর্যন্ত কাজ হারিয়েছেন। চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই এমন মানুষের সংখ্যা আরো বেশি। আর ২৫ ভাগ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে। গত জুন মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে, যা সেই সময় গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছিল।
গত জুন মাসে প্রকাশিত গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের হিসেবে করোনার মধ্যে এখন পর্যন্ত এক লাখ ১০ হাজার পোশাক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তখন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার জানিয়েছিলেন, ‘‘এখনো শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। প্রতিদিনই শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন। আগে যাদের চাকরির বয়স এক বছরের কম তাদের ছাঁটাই করা হয়েছে। এখন যাদের চাকরির বয়স বেশি, বেতন বেশি তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে।”
বিআইডিএস-এর জরিপ
অনলাইনে গত ৫ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ২৯ হাজার ৯০৯ জনের ওপর একটি জরিপ চালায় বিআইডিএস। জরিপে অংশ নেয়া ১৩ শতাংশ মানুষ, যারা ফরমাল সেক্টরে কাজ করতেন, তারা চাকরি হারিয়েছেন বলে জানান। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস এমন নাগরিকদের ওপর এই জরিপ করা হয়। জরিপে অংশ নেয়া পুরুষ ও নারীর অনুপাত ৬৭:৩৩।
সে সময় ১৩ ভাগ মানুষ যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা প্রতিমাসে নিয়মিত বেতন পেতেন। তারা দিনমজুর বা অনানুষ্ঠানিক কোনো কাজের সাথে জড়িত নন। আর আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি আছে কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না এরকম কর্মজীবীর সংখ্যা অনেক। ২৫ ভাগের বেতন ৫০ থেকে ৩৫ ভাগ কমানো হয়েছে।
যারা ফরমাল সেক্টরে চাকরি করেন তাদের বড় একটি অংশ এখন বিপাকে আছেন। তাদের আয় কমে গেছে অথবা একটি অংশের আয় নেই। দরিদ্রদের জন্য সরকার কিছুটা হলেও খাদ্য বা অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের কোনো কর্মসূচি নেই
এসডব্লিউ/কেএইচ/নসদ/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ