ভারতে কয়েক বছর ধরেই সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা–মামলার ঘটনা বাড়ছে, এমন অভিযোগ করে আসছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের মতে, ভারতে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় ভারতে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত এসেছে।
সাংবাদিক স্বামী সরকারি সিদ্ধান্ত ও নীতির সমালোচনা করে প্রতিবেদন লেখেন, সেই ‘অপরাধে’ দীর্ঘ ১২ বছরের কর্মক্ষেত্র থেকে বরখাস্ত হলেন স্ত্রী। সম্প্রতি কাশ্মীরে এই ঘটনা ঘটেছে সাংবাদিক পিরজাদা আশিকের স্ত্রী মাশরত ইউসুফের সঙ্গে।
২০১১ সাল থেকে শ্রীনগর পৌরসভায় মিডিয়া অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন মাশরত। এই প্রথম এত দীর্ঘকালের কোনো সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হলো।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট উপত্যকা থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল করে সেটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ৩৭০ ধারা বাতিল করার অর্থ বিশেষ মর্যাদা আর থাকছে না জম্মু-কাশ্মীরের। তারপর থেকেই উপত্যকার প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতা সুলভ আচরণের টানা সমালোচনা করেছেন আশিক। বহুবার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।
তবে এই পরিণতি শুধু আশিকের নয়, ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পর থেকেই উপত্যকার সাংবাদিকদের উপরে নেমে এসেছে ভারত সরকারের কোপ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাদের ভয় দেখানো ও হেনস্তা করার অভিযোগের সংখ্যা।
৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পর থেকেই উপত্যকার সাংবাদিকদের উপরে নেমে এসেছে ভারত সরকারের কোপ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাদের ভয় দেখানো ও হেনস্তা করার অভিযোগের সংখ্যা।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত দু’বছরে ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদ ও ব্যাকগ্রাউন্ড চেকিংয়ের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে পুলিশ। না বলে হানা দেওয়া হয়েছে একাধিক সাংবাদিকের বাড়িতে ও কর্মক্ষেত্রে। নিজের প্রতিবেদন বা সমাজমাধ্যমের পোস্ট অক্ষরে অক্ষরে অর্থ ও ভাবার্থ বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন পুলিশকে, রয়েছেন এমন সাংবাদিকেরাও। কেন্দ্রের এমন শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবে ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত উপত্যকার সাংবাদিক মহল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশবিরোধী’ কাজকর্মের ছিটেফোঁটা ‘প্রমাণ’ পেলেই কর্মচারীদের ছাঁটাই করছে জম্মু ও কাশ্মীর সরকার। এখনও পর্যন্ত মোট ৩০ জনের চাকরি গিয়েছে।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ২০২০ সালের ৩০ জুলাই তৈরি করা হয়েছে একটি বিশেষ কমিটি। গত আগস্ট মাসেই একটি জঙ্গিচক্র দমনের ঘটনায় বরখাস্ত হয়েছেন উপত্যকার উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক আধিকারিক আসবা-উল-অরজামন্দ খান। তিনি জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য বিট্টা কারাটের স্ত্রী। পাশাপাশি চাকরি গিয়েছে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক ও এক বিজ্ঞানীর। একই সঙ্গে চাকরি গিয়েছে আইটি জেকেইডিআইয়ের ম্যানেজার সৈয়দ আবদুল মুইদের। তার বাবা সৈয়দ সালাউদ্দিন হিজবুলের প্রধান হওয়ায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ বলে যে গর্ব ভারত করতো, তা আজ মোদির ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু সূচকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান নিচে নেমে গিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবেই। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতে বিপন্ন হয়েছে গণতন্ত্র। প্রতিবাদ করলেই সরকারের রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিনা কারণে ইউএপিএ’র ধারা দিয়ে মানুষকে হেনস্থা করা হচ্ছে।
মোদির শাসনকালে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতই স্বৈরাচারী, এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ। কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ায় এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ হওয়ায় ভারতের এই অবনতি হয়েছে। মোদির বিভিন্ন নীতিসমূহ ভারতে মুসলিম-বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিয়েছে, এবং তা ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত তাদের সাম্প্রতিক র্যাংকিংয়ে ভারতকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২ নম্বরে স্থান দিয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার-এর তরফে মোদির বিষয়ে বলা হয়, ‘২০০১ সালে মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এই রাজ্যকে খবর এবং তথ্য নিয়ন্ত্রণ করার ল্যাব হিসেবে ব্যবহার করে। এরপর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তা দেশে প্রয়োগ করেন তিনি।’
আরও বলা হয়, ‘তার সবথেকে বড় অস্ত্র হল গণমাধ্যমে নিজের এমন ভাষণ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া যাতে জাতীয়তাবাদী মনোভাব ছড়িয়ে যায়। খবর ছড়িয়ে দিয়ে বড় বড় শিল্পপতিদের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব করেন, যাদের হাতে সংবামাধ্যম রয়েছে।’
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দ্রুত কমছে। সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রাখার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে সরকার ও কর্তৃপক্ষ ক্রমশ অগ্রাহ্য করছে। কেউ তাদের সমালোচনা করলেই হেনস্তা করা হচ্ছে। দেশদ্রোহের নামে সাংবাদিকদের জেলে পোরা হচ্ছে, অসংখ্য মামলার জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য এটা বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪১
আপনার মতামত জানানঃ