প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করেছেন। শেখ হাসিনা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইসহ দুই দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত সব সমস্যার শিগগিরই সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতি দেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আমি আবার বলছি যে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নিকটতম প্রতিবেশী ভারত। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে পরিচিত।’
গত এক দশকে উভয় দেশ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারপ্রধান বলেন, দুই দেশ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চেতনায় অনেক অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করেছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইসহ সব অমীমাংসিত ইস্যু দ্রুত সমাধানের আশা করছেন তারা। তবে আশার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
৪১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদী তিস্তার বাংলাদেশে রয়েছে শুধু ১২১ কিলোমিটার। যদিও এখানেই বসবাস করছে নদী অববাহিকার ৭১ শতাংশ বাসিন্দা। নদীটির উজানে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এতে নদীর জলপ্রবাহও এখন দিনে দিনে শীর্ণ হয়ে আসছে। পানিপ্রবাহ কমতে থাকায় বাংলাদেশ অংশের বাসিন্দারাই এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উজানে দেয়া বাঁধগুলোর কারণে শুষ্ক মৌসুমে মারাত্মক খরা মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাদের। আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধগুলো খুলে দেয়ার কারণে মারাত্মক বন্যারও শিকার হচ্ছে তারা।
বর্তমানে ভারতে তিস্তার ওপর বিদ্যমান ও নির্মাণাধীন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সংখ্যা ২০। প্রস্তাব ও পরিকল্পনা রয়েছে এর চেয়েও বেশিসংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নের। হাতেগোনা কয়েকটি বাদ দিয়ে এসব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অধিকাংশেরই অবস্থান নদীটির সিকিম অংশে। এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস এটলাসের তথ্য অনুযায়ী, তিস্তার শুধু সিকিম অংশেই ২৮টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে ভারত সরকারের। প্রকল্পগুলোর জন্য বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের আগেই শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে তিস্তা নদী। আবার সেখানেও আরো কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে ভারত সরকারের।
তিস্তায় উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ ভারতের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ ও রফতানির মাধ্যমে সিকিমের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা সাজিয়েছে রাজ্যটির আঞ্চলিক সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একের পর এক প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে সেখানে। নদী অববাহিকার মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের বাস সিকিম অংশে। রাজ্যটির জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর প্রকৃত সুবিধাভোগী হিসেবে মূলত তাদের কথাই বলছে সিকিমের রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছে নদী অববাহিকার ১৭ শতাংশ বাসিন্দা।
বাংলাদেশের অধিকারে রয়েছে তিস্তা অববাহিকার মাত্র ১৭ শতাংশ এলাকা, যার পুরোটাই রংপুর বিভাগে অবস্থিত। যদিও অববাহিকার মোট বাসিন্দার ৭১ শতাংশেরই বসবাস এখানে। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজানে ভারত অংশে বিশেষ করে সিকিমে নদী অববাহিকার বাসিন্দা অনেক কম। যদিও এ কম মানুষ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেই এখন নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করে একের পর এক অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে অববাহিকার উজান ও ভাটির বাসিন্দাদের মধ্যে জীবনমানের দিক থেকে বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
এসব অবকাঠামোর কারণে রংপুর বিভাগের তিস্তা-তীরবর্তী বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকাও এখন হুমকিতে। শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ না থাকায় দীর্ঘায়িত খরায় মারাত্মক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে কৃষিনির্ভর এলাকাটির বাসিন্দারা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মত্স্য আহরণ কার্যক্রমও। আবার বর্ষা মৌসুমে নদীর ভারতীয় অংশে অবস্থিত বাঁধগুলোর ফটক খুলে দিয়ে পানির অতিরিক্ত প্রবাহ ছেড়ে দেয়া হয় ভাটির দিকে। এতে প্রতি বছরই মারাত্মক বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে দেশের তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলটি। বিষয়টি এখন দেশের দরিদ্রতম বিভাগ রংপুরের বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বৃষ্টি ও পাহাড়ি বরফ গলা জলনির্ভর নদী তিস্তায় পানিপ্রবাহ সারা বছর সমান থাকে না। নদীটির মোট পানিপ্রবাহের ৯০ শতাংশই হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসে। বাকি ১০ শতাংশ প্রবাহিত হয় বছরের অন্য আট মাসে। জলপ্রবাহ কমে গিয়ে এ সময়ে শীর্ণ হয়ে ওঠে তিস্তা। এমনকি খরা মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে পানির গড় প্রবাহ সেকেন্ডে ১৪ ঘনমিটারে নেমে আসার নজিরও রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আতিক রহমান বলেন, বাঁধগুলোর কারণে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তিস্তা অববাহিকার কৃষকদের অনেক বড় সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় তিস্তার পানির সমবণ্টন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে অন্তত এ অববাহিকার মানুষ ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে বণ্টন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার ফিজিওগ্রাফি, হাইড্রোগ্রাফি ও হিউম্যানোগ্রাফিকে বিবেচনায় নিতে হবে।
সিকিমে একের পর এক বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে আপত্তি রয়েছে খোদ ভারতেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও এ নিয়ে বেশ কয়েকবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এমনকি সিকিমেও এসব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে স্থানীয় লেপচা বাসিন্দারা। আবার ১০ বছরেরও বেশি সময় আগে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিস্তার পানি বণ্টন-সংক্রান্ত চুক্তির খসড়া হলেও তা আটকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে।
পাকিস্তান আমলে ভারতের সঙ্গে পূর্ব বাংলার আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে আলোচনা ছিল শুধু গঙ্গার (পদ্মা) পানি বণ্টনকেন্দ্রিক। তিস্তা নিয়ে প্রথম আলোচনা হয় ষাটের দশকে। ওই সময় তিস্তার পূর্ব বাংলা অংশে একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, যার বিরোধিতা করছিল ভারত। নিজ দেশের সীমানায় সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অন্য কোনো আন্তঃসীমান্ত নদীতে এ ধরনের বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রাখার অনুরোধ জানায় দেশটি। তবে দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরবঙ্গের বাস্তবতা বিবেচনায় এ বাঁধ নির্মাণের পথ থেকে সরে আসা যায়নি। যদিও স্বাধীনতার পরেও ১৯৯০ সালের আগে এ বাঁধের (ডালিয়া) নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।
তিস্তা নিয়ে আলোচনায় প্রথম উল্লেখযোগ্য মাত্রার অগ্রগতি দেখা যায় আশির দশকে। ১৯৮৩ সালে দুই দেশ নদীটির পানি বণ্টন নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ২৫তম বৈঠকে এক অ্যাডহক চুক্তিতে সই করে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, তিস্তার মোট প্রবাহের বাংলাদেশ ও ভারতের অধিকার থাকবে যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৯ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ থাকবে অবণ্টিত, যার ব্যবহার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে। এর পরের ১৪ বছর এ অ্যাডহক চুক্তিকে আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে পরিণত করার বিষয়ে কোনো ধরনেরই অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এরপর ১৯৯৭ সালে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে গঠিত যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালে প্রথম তিস্তা চুক্তির খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাদেশ। এরপর দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজমান থাকে। এরই মধ্যে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে পানিসম্পদ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে বেইজিংয়ে একটি বৈঠক বসে। দুই দেশের মধ্যে সে সময় ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সম্পর্কে একটি সমঝোতাও সই হয়। দৃশ্যপটে চীনের আকস্মিক আবির্ভাবে শঙ্কিত হয়ে ওঠে নয়াদিল্লি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আরো দুটি জেআরসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যেই ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশের হিস্যা ও নদীর প্রতিবেশ সুরক্ষা বাবদ গজলডোবা বাঁধে প্রাপ্ত পানির ২৫ শতাংশ ছাড়তে পারবে কলকাতা। এর পর থেকেই তিস্তা সংকট আরো প্রকট হয়ে ওঠে।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ওই চুক্তি অনুযায়ী, মোট পানিপ্রবাহের সাড়ে ৪২ শতাংশ ভারতের এবং সাড়ে ৩৭ শতাংশ বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত রাখা হয়। ২০১১ সালে তত্কালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে চুক্তিটি সই হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির বিষয়টি এক ধরনের অচলাবস্থার মধ্যেই রয়েছে।
নদীবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন আইন অনুযায়ী নদীর পানিতে সবার সমান অধিকার রয়েছে। পানি একক কারো নয়। আমরা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু তা কাজে আসছে না। সর্বশেষ তিস্তা চুক্তি হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। এরপর অনেক বৈঠক হয়েছে, কিন্তু ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। এটা আসলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ দরকষাকষির টেবিলে নিতে হবে। তিস্তার বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে সমাধান হবে।
দুই দেশের ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীর মধ্যে তিস্তা চতুর্থ বৃহত্তম। ভারতে সিকিমের সো লামো হ্রদে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নদীটির। নীলফামারীর ডিমলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা হয়ে আবার কুড়িগ্রামের চিলমারির কাছাকাছি এসে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে নদীটি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ