সুমিত রায়
সম্প্রতি সমস্ত ভুল কারণে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে পাকিস্তান। সম্প্রতি দেশটির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত ইমরান খান গত এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে বিরোধী দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সিআইএ’র সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে সারা দেশে তাণ্ডব চালাচ্ছেন। দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেখানে ব্যাপক খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে বর্তমান প্রশাসন আইএমএফের সাথে মরিয়া হয়ে আলোচনায় বাধ্য হয়েছে। আর সর্বোপরি, এখন দেশটি রেকর্ডকৃত ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বর্ষার বন্যায় ভুগছে, যার ফলে হাজার হাজার মৃত্যু এবং হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্ষতি হয়েছে। পাকিস্তানের এই তিনটি সংকটের দিকে নজর দেয়া যাক।
বন্যা দিয়েই শুরু করা যাক। পাকিস্তানে বর্ষাকাল নিয়মিত, এটি সাধারণত জুনের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে এই বছরে যে মাত্রায় বৃষ্টিপাত দেখা যাচ্ছে তা অভূতপূর্ব। দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশ সিন্ধুর মতো কিছু প্রদেশে গত ৩০ বছরের বার্ষিক গড়ের প্রায় ছয়গুণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। সিন্ধুতে সাধারণত বর্ষা মৌসুমের প্রথম দুই মাসে প্রায় ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। তবে এই মৌসুমে সেখানে প্রায় ৭০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের আরেক প্রদেশ বেলুচিস্তান যা সাধারণত বর্ষাকে এড়িয়েই চলে, সেখানেও বৃষ্টি হয়েছে তার বার্ষিক গড়ের পাঁচগুণ। বলাই বাহুল্য, এই বন্যা প্রচুর ক্ষতি করেছে। রাজধানী এবং আরও কিছু জনবহুল পূর্ব অঞ্চলগুলো বন্যার হাত থেকে বেঁচে গেলেও পাকিস্তানে বসবাসকারী কয়েক মিলিয়ন মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ জলের নিচে রয়েছে এবং সরকার ১৬০টি জেলার মধ্যে ৭২টি জেলাকে দুর্যোগ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তুলা ও চালের মতো ফসল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যেগুলো দিয়ে দেশের বেশিরভাগ রপ্তানি হয়। আরও খারাপ যেটা তা হলো, এই বন্যা পাকিস্তানের প্রাক-বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যা দেশের রাজনৈতিক সংকটকেও আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি গত কয়েক বছরে খুব একটা ভাল করতে পারেনি। মাথাপিছু জিডিপি এখনও তার ২০১৮ এর উচ্চতার নিচে রয়েছে, অত্যধিক ঋণের সংমিশ্রণ সামরিক বাজেটকে স্ফীত করেছে, এবং সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেশটিকে একটি মুদ্রা সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানি রুপি গত এক বছরে ডলারের তুলনায় তার মূল্যের প্রায় ২৫ শতাংশ হারিয়েছে এবং এখন এটি ২০১৭ সালে যা করেছে তার প্রায় অর্ধেকে লেনদেন করছে। অ্যাজ এক্সপেক্টেড, মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়েছে এবং এখন ১৫ বছরের সর্বোচ্চ ২৫% পর্যন্ত রয়েছে। প্রাথমিক অনুমানগুলো ইঙ্গিত দেয় যে বন্যার ফলে পাকিস্তানের অবকাঠামোর ১০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে এবং ফসলের ওপর প্রভাব বৈদেশিক মুদ্রার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উৎসকে কেটে ফেলবে। কাপড় যা প্রায়শই তুলো দিয়ে তৈরি করা হয় তা পাকিস্তানের রপ্তানির ৪০% এরও বেশি, চাল এবং অন্যান্য খাদ্য উৎসগুলো আরও ১০% যোগ করে। এদিকে বন্যা ইতিমধ্যে এই বছর পাকিস্তানের ফসলের ক্ষতি করেছে, এবং যে জলাবদ্ধতা ঘটেছে তার ফলে পরবর্তী রোপণ মৌসুম শুরু হতে বিলম্ব হতে পারে। কম রপ্তানি মানে দেশে কম বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, যা বর্তমান মুদ্রা সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এর জবাবে আইএমএফ পাকিস্তানকে নতুন করে ১.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে এই শর্তে যে, পাকিস্তান সরকার ব্যয় কমিয়ে আনবে। যদিও আইএমএফ স্বীকার করেছে যে বন্যার জন্য স্বল্পমেয়াদে আরও কিছু আর্থিক ঘাটতির প্রয়োজন হবে, তবুও তারা জ্বালানী ও বিদ্যুতের ভর্তুকি হ্রাস সহ কিছু রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর জোর দিয়েছে এবং এটি পাকিস্তানের প্রাক-বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
গত কয়েক মাস ধরে শাবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন বর্তমান পিএমএলএন পার্টি এবং ক্ষমতাচ্যুত ইমরানের মধ্যে বিরোধের জেরে পাকিস্তানের রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছে। ইমরান খানের আইএমএফ-এর উপর হঠাৎ ঘুরে যাবার পর এবং এপ্রুভাল রেটিংয়ের একটি তীব্র পতন দেখে, পাকিস্তানি সংসদ ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং এপ্রিলে শাবাজ শরিফ তার স্থলাভিষিক্ত হন। তারপর থেকে ইমরান খান দেশ জুড়ে ভ্রমণ করেছেন, র্যালি করে বিশাল জনসংখ্যাকে টেনেছেন, এবং অপোজিশনকে সিআইএ এর সাথে ষড়যন্ত্রকারী বলে অভিযোগ করেছেন। জুলাই মাসে তার পিটিআই দল দেশের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের উপ-নির্বাচনে ২০ টি আসনের মধ্যে ১৫ টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু গত মাসে তাকে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অধীনে অভিযুক্ত করা হয়। কর্তৃপক্ষ তার এক সহযোগীকে নির্যাতন করেছে, তিনি এই দাবি করলে পাকিস্তানি পুলিশ যুক্তি দেয় যে এটি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের হুমকি দেবার সমান। এরপর ইমরান খানকে এক্সটেন্ডেড বেইল দেয়া হয়েছে, তবে উত্তেজনা এখনও ভালই চলছে, আর সাম্প্রতিক এই আইএমএফ চুক্তিটি কেবল সেই উত্তেজনার আগুনে ইন্ধনই যোগাবে। পাকিস্তানের ঋণের প্রয়োজন ছিল ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানি জনগণ আইএমএফের প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী নয়, কেননা তারা আইএমএফ তার ঋণের সাথে প্রায়শই যেসব কৃচ্ছ্রসাধনের শর্তগুলো দিয়ে দেয় তা তাদের পছন্দ নয়। আইএমএফের নির্দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর জন্য সরকার ইতিমধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েছে, এবং গত সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে পড়ায় সরকার আর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সাহস করেনি, কিন্তু করতে চেয়েছিল ঠিকই।
যাইহোক, ইমরান খান তার পূর্বসূরীদের দ্বারা সম্মত পূর্ববর্তী আইএমএফ প্রোগ্রামটি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতেছিলেন এবং পরিবর্তে কর পরিহারের উপর ক্র্যাক ডাউন করে, মানে মানুষকে কর প্রদানে বাধ্য করার মাধ্যমে পাকিস্তানের বাজেটের ভারসাম্য বজায় রাখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। যদিও ইমরান খানকে শেষ পর্যন্ত আইএমএফের দ্বারস্থ হতেই হয়, তিনি তা অনিচ্ছাকৃতভাবেই করেছিলেন এবং নিয়মিতভাবে তাদের ঋণ দেওয়ার শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তো এবারে আইএমএফের কাছ থেকে নেয়া এই নতুন ঋণ ইমরান খানকে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করার জন্য আরও বেশি রসদ জোগাবে, তিনি আরও ভালভাবে অপোজিশনের সমালোচনা করতে পারবেন, আর জনগণের সমর্থনও লাভ করবেন। আর লোন নেয়ার ব্যাপারটি ইতিমধ্যে শরিফের দলের অভ্যন্তরেও বিতর্কিত প্রমাণিত হয়েছে।
সব মিলে যেটা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, হ্যা, আইএমএফের এই নতুন ঋণ সম্ভবত পাকিস্তানের এই বন্যার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলার জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু তবুও এটা পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিতর্কের আরেকটি বিষয় যোগ করবে। সব মিলিয়ে এটা খুবই খারাপ খবর। পাকিস্তানকে এখন কেবল তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ বন্যার সাথেই নয়, সেই সাথে মন্দ থেকে মন্দতর হওয়া তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সাথেও লড়তে হবে। আর এরপর কী হবে?
২০২৩ সালের অক্টোবরের আগে কোনও এক সময় একটি নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, এবং ধীরে ধীরে এটাই প্রকট হচ্ছে যে এই নির্বাচনে ইমরান খানই জিতবেন। আবার বলছি, ইমরান খানের দল সর্বশেষ উপ-নির্বাচনে ভালো ফল করেছে এবং বন্যার পর পাকিস্তানের পুনর্গঠনের জন্য আইএমএফের কাছ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন হবে, যার জন্য শরিফকে কিছু অজনপ্রিয় ব্যয় হ্রাস করতে হবে, আর তাতে শরীফের দল জনপ্রিয়তা হারাবেই। জুন মাসের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে ইমরান খানের পিটিআই পার্টি তার বিরোধী দলের চেয়ে ছয় পয়েন্ট এগিয়ে আছে, যা আগে ছিল সমান সমান। তাই এটা মনে করা যুক্তিসংগত যে গত কয়েক মাস ধরে এই ব্যবধান আরও প্রশস্ত হয়েছে। তাই ইমরান খান যদি জেলের বাইরে থাকতে পারেন, তাহলে সম্ভবত চলতি বছরের মধ্যেই তিনি ফের ক্ষমতায় ফিরে আসবেন।
আপনার মতামত জানানঃ