রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সহযোগী ও ইউক্রেন আগ্রাসনের পরামর্শক আলেকজান্ডার দুগিনের কন্যা গাড়িবোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় শনিবার (২০ আগস্ট) মস্কোর কাছে একটি জাতীয় সড়কের ওপর তার গাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতেই নিহত হন ৩০ বছর বয়সী দারিয়া দুগিন। খবর বিবিসি, রয়টার্স
রাশিয়ার তদন্ত কমিটি বলছে, দারিয়া দুগিন নিজেই গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। তাদের ধারণা দারিয়া নন, এই হামলার মূল টার্গেটে ছিলেন তার বাবা। দারিয়ার বাবা আলেকজান্ডার দুগিন রাশিয়ার একজন দার্শনিক, যিনি ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’ নামে পরিচিত।
আলেকজান্ডার দুগিন এবং তার কন্যা দারিয়া মস্কোর কাছেই একটি উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে দার্শনিক দুগিন বক্তব্য রাখেন।
এই অনুষ্ঠানটিকে শিল্প-প্রেমীদের জন্য একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান হিসেবে বর্ণনা করা হয়। রুশ কবি আলেকজান্ডার পুশকিন একসময় যে জাখারোভা এস্টেটে থাকতেন সেখানে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়।
তাদের দুজনেরই অনুষ্ঠান শেষে একসঙ্গে একই গাড়িতে করে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু খবরে বলা হচ্ছে দুগিন একেবারে শেষ মূহুর্তে মেয়ের সঙ্গে না ফিরে আলাদা গাড়িতে করে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
টেলিগ্রামে পোস্ট করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, পুড়ে যাওয়া গাড়িটি যেখানে পড়ে আছে, রাশিয়ার জরুরি সার্ভিসের লোকেরা সেখানে এসে পৌঁছালে দুগিন সেদিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন।
পুতিন-ঘনিষ্ঠদের দাবি, হামলার লক্ষ্য দারিয়া ছিলেন না, ছিলেন তার বাবা। ইউক্রেনের ওপর ঘটনার পুরো দায় চাপিয়েছেন তারা। এরইমধ্যে ঘটনার তদন্তে নেমেছে রাশিয়ার পুলিশ।
জানা যায়, দুগিনের মেয়ে দারিয়া দুগিন রাশিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ভাষ্যকার। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে সমর্থন করতেন তিনি। এ বছরের শুরুর দিকে দারিয়া দুগিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য।
ইউক্রেনে রুশ হামলার বিষয়ে অনলাইনে ‘বিভ্রান্তি’ ছড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। গেল মে মাসে তিনি একটি সাক্ষাৎকারে যুদ্ধকে ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়, শনিবার রাতে ওই অনুষ্ঠানের শেষে দারিয়ার গাড়িতে ওঠার কথা ছিল আলেকজান্ডারের। তবে শেষ মুহূর্তে তিনি অন্য গাড়িতে চড়ে চলে গিয়েছিলেন।
‘পুতিন মস্তিষ্ক’ কে এই দুগিন
আলেকজান্ডার দুগিন ক্রেমলিনে আনুষ্ঠানিক কোনো পদে না থাকলেও রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি ‘পুতিনের রাসপুতিন’ নামে পরিচিত।
তার পশ্চিমা-বিরোধী ও উগ্র-জাতীয়তাবাদী দর্শন রাশিয়ায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিণত হয়েছে যা প্রেসিডেন্ট পুতিনের সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্র নীতি তৈরিতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের ব্যাপারেও দুগিনের দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অনেকে মনে করেন ক্রিমিয়ার মতো ইউক্রেনে হামলার পেছনেও ‘পুতিনের মস্তিষ্ক’ নামে পরিচিত আলেকজান্ডার দুগিনই দায়ী। তার মেয়ে দারিয়া দুগিনও মস্কোর এসব হামলার সমর্থক ছিলেন।
অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অনলাইনে ‘বিভ্রান্তি’ ছড়ানোর অভিযোগে যুক্তরাজ্য কর্তৃক দারিয়া দুগিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।
আলেকজান্ডার দুগিন ক্রেমলিনে আনুষ্ঠানিক কোনো পদে না থাকলেও রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি ‘পুতিনের রাসপুতিন’ নামে পরিচিত।
মে মাসে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন যেখানে তিনি এই যুদ্ধকে ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ বলে উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমা দেশগুলো যে তার ও তার পিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেজন্য তিনি তার গর্বের কথাও প্রকাশ করেছিলেন।
রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে আলেকজান্ডার দুগিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
বিশ্ব রাজনীতির বিষয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার ওপর দুগিনের লেখার গভীর প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ তৈরিতে তিনি একজন প্রধান বুদ্ধিজীবী হিসেবেও বিবেচিত। ক্রেমলিনের অনেক কর্মকর্তাই তার এই আদর্শ অনুসরণ করেন।
রাশিয়া যেন বিশ্বমঞ্চে নিজেকে আরো আক্রমণাত্মকভাবে জাহির করে সেজন্য আলেকজান্ডার দুগিন কয়েক বছর ধরেই মস্কোর প্রতি আহবান জানিয়ে আসছেন।
এদিকে অধিকৃত দনেস্ক অঞ্চলের রুশ নেতা ডেনিস পুশিলিন বিস্ফোরণের জন্য ইউক্রেন সরকারের সন্ত্রাসীদের দায়ী করে বলেছেন, সন্ত্রাসীরা আলেকজান্ডার দুগিনকে নিষ্ক্রিদ্ধয় করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তারা তার মেয়েকে উড়িয়ে দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে এক পোস্টে তিনি লেখেন, দারিয়া একজন সত্যিকারের রাশিয়ান মেয়ে। আলেকজান্ডারের শেষ মুহূর্তে গাড়ি পরিবর্তনের বিষয়টি ইঙ্গিত করছে তিনি কোনোভাবে হামলার আশঙ্কা করছিলেন এবং হয়তো নিজের অজান্তেই তা থেকে সরে গিয়েছিলেন।
দারিয়া হত্যা কী বার্তা দেয়
দারিয়া হত্যার ঘটনা একটি নতুন সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেছেন, তার দেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রুশ হামলা জোরদার হতে পারে।
রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ও স্বঘোষিত দোনেৎস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রধান ব্যক্তিত্ব ডেনিস পুশিলিন তাৎক্ষণিকভাবে দারিয়া হত্যার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছেন। তিনি অবশ্য তার দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ দেননি।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, এ ঘটনা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিরোধের ফলাফল হতে পারে।
জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক ইউক্রেনীয় টেলিভিশনে গতকাল রোববার বলেন, ‘এর সঙ্গে আমাদের অবশ্যই কোনো যোগসূত্র নেই।’
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এ ঘটনা নিয়ে কথাবার্তা বা গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনাটি নিয়ে বিশ্লেষকেরা নানা কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অসন্তুষ্ট, এটা এমন অভ্যন্তরীণ পক্ষের কাজ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নিকোলাস টেনজার গতকাল টুইট করে বলেন, হামলাটির উৎস স্পষ্টতই অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক নয়।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দাবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম বি শিফ বলেছেন, তিনি আশা করেন, এ হামলার পেছনে ইউক্রেনের হাত নেই। তিনি তেমনটা দেখতে চান না।
কিছু বিশ্লেষক রুশ ভূখণ্ডের কেন্দ্রস্থলে পুতিনের এক ঘনিষ্ঠ মিত্রের মেয়ের ওপর হামলার যে প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে, সে দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার কারাবন্দী বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির ঘনিষ্ঠ মিত্র লিওনিড ভলকভের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, হামলার ঘটনাটি এমন একটি জায়গায় ঘটেছে, যেটি পুতিনবাদের কেন্দ্রস্থল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৭
আপনার মতামত জানানঃ