পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে সরকার ও আওয়ামী লীগে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। দলের বেশির ভাগ নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা মনে করছেন, মোমেনের বক্তব্য কূটনৈতিকভাবে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
দেশের ভেতরেও সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। এ অবস্থায় মোমেনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে দলের ভেতর থেকে চাপ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকেই মনে করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নেতাদের এই মনোভাবের কথা গত শুক্রবার দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, তাকে নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে তিনি তার ধারেকাছেও নেই।
আজ সোমবার(২২ আগস্ট) সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে বের হয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, নির্বাচন নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। স্থিতিশীলতা নিয়ে কথা বলেছেন।
সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে- ভারতে গিয়ে এমন কথা বলিনি। এটা একটা ডাঁহা মিথ্যা কথা। নির্বাচন নিয়েও কোনো কথা বলিনি।”
গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে মোমেন বলেছিলেন, “আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে … শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা অনুরোধ করেছি।”
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না- ভারতে গিয়ে এমন বক্তব্য দেওয়ায় মোমেনের বিরুদ্ধে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে সেদিন চট্টগ্রামে কালো পতাকা মিছিল হচ্ছিল মোমেনের বিরুদ্ধে।
তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নিজের ভারত সফরে দেওয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় মোমেনের মুখে ওই কথা শোনা গিয়েছিল।
“শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে- ভারতে গিয়ে এমন কথা বলিনি। এটা একটা ডাঁহা মিথ্যা কথা। নির্বাচন নিয়েও কোনো কথা বলিনি।”
সরকারকে ক্ষমতায় ‘টিকিয়ে’ রাখতে ভারতকে অনুরোধ করে মোমেন রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন সমালোচনায় পড়েছেন, তেমনি তার পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিসও পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তাতে মোমেনের বিরুদ্ধে ‘শপথ ভঙ্গ এবং সংবিধান লঙ্ঘনের’ অভিযোগ আনা হয়।
সেদিন তিনি কি বলেছিলেন তা এই ভিডিওতে আছে
তা নিয়ে সোমবার মোমেন বলেন, “আমাকে যে অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তার ধারের কাছেও আমি নেই।”
রাজনীতিতে যুক্ত হয়েই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হওয়া মোমেন সম্প্রতি দেশকে ‘বেহেশতের’ সঙ্গে তুলনা করেও সমালোচনায় পড়েছিলেন।
এরপর দল থেকে সতর্ক করে দেওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, এখন থেকে সাবধান হয়ে কথা বলবেন তিনি।
তবে তারপরই ভারত নিয়ে বক্তব্যের জন্য এখন চাপে রয়েছেন মোমেন।
তার এই বক্তব্যের দায় দলও নিতে চাইছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মোমেন ওই বক্তব্য তার নিজস্ব।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সেটি তার ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। এটি আমাদের সরকারের বক্তব্য না, দলেরও না। এই ধরনের অনুরোধ আওয়ামী লীগ করে না। শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকেও কাউকে এমন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
গত শনিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, মোমেন দলের কেউ নন।
আওয়ামী লীগ ও মন্ত্রিসভা সূত্র বলছে, বাইরে মোমেনের বক্তব্যকে দলের নয় দাবি করলেও ভেতরে-ভেতরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীদের অনেকের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানোর জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অনেক নেতা-মন্ত্রী অনুরোধ করেছেন। মোমেনের বক্তব্যের কারণে যে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেই বার্তা ব্যক্তিগতভাবেও কেউ কেউ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দিয়েছেন।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য প্রত্যাহার না করে জানান, তার বক্তব্য ভিন্নভাবে গণমাধ্যমে এসেছে।
তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, তোমাদের সরকারের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কারণে আমাদের এখানে সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। আমি দিল্লিতে মিটিং করার সময় বলেছি, তোমাদের একজন মুখ্যমন্ত্রী এসব কথা আমাকে বলেছে। তখন আমি বলেছি, দুই দেশেরই উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন আর সেই স্থিতিশীলতার জন্য শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে।
অন্যদিকে বিএনপি লুফে নিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য। দলটির নেতারা এর তীব্র সমালোচনা করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপস্থিত নেতাদের মনোভাব হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য বন্ধুপ্রতিম দেশটিকে বিব্রত করবে। প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতারা লাগাতার বলে আসছেন যে জনগণই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় রেখেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ভারতনির্ভরতা’বিষয়ক বক্তব্য সরকারি দলের এত দিনে বক্তব্যকে উল্টে দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৮
আপনার মতামত জানানঃ