একটি খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে চলে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। বলা যায়, এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে নষ্ট হচ্ছে দেশটির খ্যাতি। প্রাক-কোভিড সময়কালেও বাংলাদেশ ৭ থেকে ৮ শতাংশ জিডিপি অর্জনসহ সফল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রশংসিত হয়েছিল। জিডিপি বেড়ে দাঁড়ায় ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। এবং মাথাপিছু জিডিপি ভারতকেও ছাড়িয়ে যায়।
কিন্তু চলমান কোভিড মহামারি এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের যুগপৎ আঘাতের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। সেই ক্ষতি সামলাতে বাংলাদেশ এখন লড়ছে। দেশটির এই অর্থনৈতিক সংকটে বাহ্যিক কারণগুলো ছাড়াও, অভ্যন্তরীণ কারণগুলোও ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ এখন আর্থিক সহায়তা পাবার বহুপাক্ষিক ক্ষেত্র অনুসন্ধান করছে। বাংলাদেশসহ ভারতের তিনটি প্রতিবেশী দেশ গভীর অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে।
অর্থনীতিকে পতনের হাত থেকে বাঁচাতে শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে আর্থিক সহায়তা অর্থাৎ বেইলআউট চেয়েছে। আইএমএফ-এর কাছে এই বেইলআউট চাওয়ার তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ থেকে বেইলআউট পেতে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চাইছে বাংলাদেশ।
আগামী তিন বছরে বাংলাদেশকে বেইলআউট প্যাকেজ দিয়ে সাহায্য করার জন্য আইএমএফ-এর তৎপরতা দেশটির অর্থনৈতিক সংকটের স্পষ্ট স্বীকৃতি। দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে এমনটাই বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত।
তাপস কুমার দত্তের অনুবাদকৃত এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের দরজায়ও কড়া নেড়েছে এক বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য। এছাড়াও অন্যান্য বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান ও জাপানের মতো দাতা দেশগুলোর কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশকে জ্বালানি ও খাদ্য আমদানি করতে হয়। আমদানি করা সারের ওপর বাংলাদেশের কৃষি নির্ভরশীল, যার খরচ বেড়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য। কারণ এই উভয় দেশই সার রপ্তানিকারক। কোষাগারে ভর্তুকির বোঝা কমাতে সম্প্রতি জ্বালানির দাম ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে অন্যান্য কঠোরতামূলক ব্যবস্হার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের রেশনিং (লোডশেডিং), সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কমানো, সরকারি যানবাহন ক্রয় সীমিত করা এবং অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল জিনিসপত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। এদিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি দেশটির মূল্যস্ফীতির আগুনকে আরোপ উসকে দেবে, যা গত মাসের (জুলাই) থেকে ৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
এই বছরের আগস্টে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সর্বশেষ ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে—যা দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সরকার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে অনুরোধ জানিয়েছে যে, তার হাত-পা বাঁধা এবং যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এর জন্য অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
যে কোনো ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আইএমএফের প্রত্যাশিত শর্তাবলি পূরণের অংশ হিসেবে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধীরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারকে আক্রমণ করছে, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকার নিন্দার শিকার হচ্ছে। হতাশাগ্রস্ত বিরোধীরা সরকারকে আক্রমণ করার জন্য অর্থনৈতিক সংকটকে একটি নতুন খুঁটি হিসেবে খুঁজে পেয়েছে।
তেল এবং খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের দিকে ধাবিত হয়েছে, কারণ আমদানি ব্যয় বেড়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট শিগগিরই শেষ হবে না। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারেও প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক শিল্প। এদিকে উন্নত এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে মন্দার কারণে ভোক্তা চাহিদা কমে গেছে ফলে তৈরি পোশাক শিল্পখাতে বিদেশি অর্ডার কমে গেছে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্সও হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৪.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। সেটি এখন ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান দ্রুতগতিতে নেমে যাচ্ছে, খোলা বাজারে প্রতি ডলার ১১২ টাকায় উঠে গেছে। এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে। যদিও রপ্তানি ৫২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, কিন্তু আমদানিও বেড়েছে—যার ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে।
বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের রয়েছে দুর্বল রেকর্ড। এই বিষয়টিও দেশটির অর্থনৈতিক চাপের কারণগুলিকে আরও জটিল করে তোলে। আমদানির অতিরিক্ত চালান এবং রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের কারণে আনুমানিক ৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি নাগরিকরা সুইস ব্যাংকে প্রায় ৯১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লুকিয়ে রেখেছেন। ঋণ পরিষেবা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর ক্রমবর্ধমান সৃষ্টি করছে। বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ৯০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ জমা হয়েছে।
চীন, জাপান ও রাশিয়ার কাছে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া রয়েছে। কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্প স্থগিত করা হচ্ছে। দেশটির অর্থমন্ত্রী সতর্ক করেছেন যে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের ঋণের আর্থিক সম্ভাব্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক বেশি যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন।
সকল বিষয়ে কঠোর কৃচ্ছ্বসাধনের জন্য জনগণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। এবং এসব দুর্ভোগ ও সমস্যার মূলে সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অভিযোগের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ না করার জন্য এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির জন্য সমালোচকরা সরকার এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে। যেখানে বাংলাদেশ পদ্মা নদীর উপর সেতুর উদ্বোধন উদযাপন করেছে এবং দাবি করেছে যে এটি স্ব-অর্থায়নে তৈরি, কিন্তু এর পাশাপাশি বাজেট সহায়তার জন্য প্রধান উন্নয়ন অংশীদার এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ধার করা হচ্ছে।
আসলে অর্থনৈতিক চিত্র ততটা সুন্দর ছিল না, যতটা সরকার ঘোষণা করেছিল। অবকাঠামো প্রকল্পের স্ফীত ব্যয়, অ-পারফর্মিং অ্যাসেট এবং ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংকিং খাতে একটি সংকট সৃষ্টি করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো দম্ভপূর্ণ প্রকল্প এবং ঢাকা মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্প এবং আরও কয়েকটি প্রকল্প দেশের অর্থের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, কারণ অতিরিক্ত মূল্য এবং দুর্নীতির কারণে ব্যয় বেড়েছে।
উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি চীনের বিআরআই ঋণ-ফাঁদ নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের মতো ভৌতসম্পদ দখলে চীনের ভূমিকা সম্পর্কে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। শ্রীলঙ্কায় এটা ঘটেছিল আর্থিকভাবে টেকসই-অযোগ্য অন্তঃসারশূন্য প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক দুর্দশায় শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক জনবিক্ষোভ ঘটে, যা দেশটির প্রেসিডেন্টকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে। ঘটনাটি পুরো অঞ্চল একটা শক তরঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী, ভুটান ব্যতীত সবাই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে এবং শ্রীলঙ্কার ঘটনা এই সমস্ত দেশের জন্য একটি বড় শিক্ষা।
ভারতের প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক সংকট ভারতের বিরুদ্ধে ‘চীনা কার্ড’ খেলার বিপদকেই তুলে ধরেছে। চীন এই খেলাটি পুরোপুরি বোঝে এবং তার ‘চেকবুক কূটনীতি’র সাহায্যে এই দেশগুলোকে সফলভাবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যেতে প্রলুব্ধ করেছে। চীন তার ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী বিআরআই প্রকল্পে অন্যদের জড়িয়েছে এবং ঋণ-ফাঁদ কূটনীতির মাধ্যমে ভারতের প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। একইসঙ্গে প্রকল্পটি ভারত মহাসাগর অঞ্চলে কৌশলগত উপস্থিতি বৃদ্ধিসহ ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে চীন তার দাপট বৃদ্ধির ছক হিসেবে সাজিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ