২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক বাংলাদেশ। শুরুতে এর সিম পেতে মারামারির ঘটনাও ঘটে। পরের ইতিহাস খুবই করুণ। যাত্রার ১৭-১৮ বছরেও ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি টেলিটক। মাঝের দুই বছর বাদে এ দীর্ঘ সময়ের পুরোটাই লোকসানের বৃত্তে আটকে থেকেছে প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রাহক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, সেবার মান বৃদ্ধিসহ নানা ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি টেলিটক। এখনো টেলিটকের ব্যবসার মূল ভিত্তি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। আবার গ্রাহকদের উন্নতমানের পণ্য ও টেলিকম সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদেরও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
গ্রাহকসেবার প্রতিযোগিতায় যখন তিন বেসরকারি অপারেটর এগিয়ে যাচ্ছে তখন সরকারি সব সুবিধা নিয়েও ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। নামমাত্র সেবা দিতেই ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নেটওয়ার্কের অবস্থাও বেহাল। এ অবস্থায় সম্প্রতি টেলিটকের মাধ্যমে ফাইভ-জি সেবা দেওয়া থেকে সরে এসেছে সরকার। সবমিলিয়ে টেলিটকের অবস্থা এখন নিভু নিভু।
জানা যায়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ১০০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল ৮৩ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য টেলিটককে চিঠি দিয়েছে।
এছাড়া বিটিসিএল, হুয়াওয়ে, সামিট, টাওয়ার কোম্পানি, ই-ডটকো এবং কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও দেনা রয়েছে টেলিটকের। বদলি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, এই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই টেলিটকের। টিকে থাকতে হলে প্রতিষ্ঠানটিকে অন্য কোম্পানির সঙ্গে একীভূত (মার্জার) হতে হবে। এছাড়া টেলিটকের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দেখা যায়, সহজে টেলিটকের সিম পাওয়া যায় না। রিচার্জ পয়েন্টও অনেক কম। নেটওয়ার্কের অবস্থাও ভালো নয়। এসব কারণে গ্রাহক টেলিটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
পাওনা পরিশোধে এরই মধ্যে টেলিটককে চিঠি দিয়েছে বিটিসিএল। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. রফিকুল মতিন বলেন, আমরা টেলিটকের কাছে ৮৩ কোটি টাকা পাবো। তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে টেলিটকের কাছে তরঙ্গ বাবদ পাওনা টাকার প্রথম কিস্তির ১০০ কোটি টাকা চেয়েছে বিটিআরসি। বিটিআরসির অর্থ হিসাব বিভাগ থেকে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে গত ১ আগস্ট একটি চিঠি পাঠানো হয়।
এই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই টেলিটকের। টিকে থাকতে হলে প্রতিষ্ঠানটিকে অন্য কোম্পানির সঙ্গে একীভূত (মার্জার) হতে হবে। এছাড়া টেলিটকের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠি মোতাবেক ২ হাজার ৬শ মেগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গ বরাদ্দ ফি-২০২২ এর প্রথম কিস্তির ১০ শতাংশ বাবদ অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর্তনপূর্বক ৯৩ লাখ ৩৯ হাজার ৭০১ টাকা এবং মূসক বাবদ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ৭৭ কোটি ৫ লাখ ৩ হাজার ৩০৮ টাকাসহ মোট ১০০ কোটি ৭৫ লাখ ৪৩ হাজার ৯ টাকা অনতিবিলম্বে ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য বিলম্ব ফিসহ পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
উল্লেখ্য, বিটিআরসির আয়োজনে গত ৩১ মার্চ রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল তরঙ্গ নিলামে টেলিটক, গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক অংশ নেয়। ৫জিসহ অন্যান্য সেবার মান উন্নয়নে দুই ব্যান্ডে ১০ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকার তরঙ্গ (স্পেকট্রাম) কিনেছে দেশের চার অপারেটর।
নিলামে টেলিটক ২ হাজার ৩০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকায় ৩টি ব্লকে ৩০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনেছে। বাংলালিংক ২ হাজার ৩০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৪টি ব্লকে ৪০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনেছে ২ হাজার ২৪১ কোটি টাকায়। আর রবি ২ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৬টি ব্লকে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকায় কিনেছে ৬০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। গ্রামীণফোন ২ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৬টি ব্লকে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকায় কিনেছে ৬০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ।
বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, তরঙ্গ বরাদ্দের জন্য গ্রামীণফোন ও রবি প্রথম কিস্তি পরিশোধ করেছে। বাংলালিংক প্রথম কিস্তির জন্য ১৫ শতাংশসহ পরিশোধের শর্তে এক বছর সময় নিয়েছে। তবে টেলিটক (এখনো পরিশোধ করেনি। এজন্য টেলিটককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বিটিআরসি পরিচালিত বিভিন্ন সময়ের অভিযানে উদ্ধার করা অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিমের মধ্যে টেলিটকের ৩২ হাজার ৮৪৫টি সিম জব্দ করেছিল। বিটিআরসি এ সময় ১৬ হাজার ৩৯০টি, গ্রামীণফোনের ২ হাজার ৩৫৬টি এবং বাংলালিংকের ৭৫৩টি সিম জব্দ করে। উদ্ধার করা অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিম নিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের আবেদন, শুনানি শেষে টেলিটককে ৫ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল বিটিআরসি।
এ ছাড়া রবিকে ২ কোটি, গ্রামীণফোনকে ৫০ লাখ এবং বাংলালিংককে ১৫ লাখ টাকা প্রশাসনিক জরিমানা করেছিল কমিশন। কিন্তু গত ১৪ জুলাই বিটিআরসি থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রবি, গ্রামীণফোন লিমিটেড এবং বাংলালিংক থেকে ভ্যাটসহ যথাক্রমে ২ কোটি ১০ লাখ, ৫২ লাখ ৫০ হাজার এবং ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আদায় করেছে সংস্থাটি। কিন্তু জরিমানার এক টাকাও এখনও পরিশোধ করেনি টেলিটক। তবে বিষয়টিকে আর্থিক অসক্ষমতা হিসেবে দেখছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, টেলিটককে জরিমানা শোধ করার জন্য আমরা বলেছি। আমরা প্রত্যাশা করি, তারা জরিমানা পরিশোধ করবে।
তিনি বলেন, আমরা যেটুকু বুঝি অন্য অপারেটরদের চেয়ে টেলিটকের আর্থিক সক্ষমতা কম। সে কারণে হয়তো তাদের বিলম্ব হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কোনো ছাড় নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে এটি কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে না।
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, আমি শুনেছি টেলিটক সময় চেয়েছে তবে কতদিনের সময় চেয়েছে এ বিষয়ে বলতে পারব না। আর তরঙ্গ বাবদ প্রথম কিস্তির ১০০ কোটি টাকা চেয়ে তাদেরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে মোট পাওনা কত সেটি বলতে পারব না।
রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক নানাভাবে সরকারের দিক থেকে সুবিধা পেলেও ডিজিটাল দুর্নীতিতে মজে আছে সেই শুরু থেকেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৭ বছরে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটক এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনেছে। আর গত চার বছরেই টেলিটক লোকসান করেছে ৯৯৩ কোটি টাকা।
কেনাকাটা থেকে শুরু করে নিয়োগ, পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেওয়া, পুরনো পদ্ধতির এসব লুটপাট তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি কমিশন ও বিটিএস স্থাপনে বাড়ি ভাড়ার অনিয়ম। কাগজে-কলমে কেনা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে নেই; স্ক্র্যাচ কার্ড এবং ক্যাশ কার্ডের হিসাবে এমন কোটি কোটি গরমিলের প্রমাণ মিলেছে। নির্দিষ্ট কিছু সিমের মাধ্যমে বৈধ কায়দায় অবৈধ আয়ের সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি টেলিটক লোকসানে যাবে, যাচ্ছেও। যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে তা পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এটার কোনো দরকারই নেই। সরকারের উচিত প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেয়া। সরকারের সঙ্গে কোনো কোম্পানি জয়েন্ট ভেঞ্চারে থেকেও প্রতিষ্ঠানটি চালাতে পারে। নিম্ন আয়ের দেশ ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশে এমন লোকসানি টেলিকম প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারি চাকরি ও পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে অনেকেই বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটির সেবা নিচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এভাবে টেলিকম প্রতিষ্ঠান টেকসই হয় না।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জেলা শহরগুলোতে টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও গ্রামাঞ্চলে এর কোনো নেটওয়ার্ক নেই। গ্রামের সব মানুষই অন্য কোম্পানির সিম ব্যবহার করেন। টেলিটকের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হলে এর ব্যবহার বাড়বে। ফলে এতে ভর্তুকি না দিয়ে বরং সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবে।
তারা বলেন, টেলিটক বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো তাদের মার্কেটিং দুর্বলতা। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই টেলিটকের আজ এই অবস্থা। টেলিটককে টিকে থাকতে হলে এখন প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু সরকার এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। তাই টেলিটককে টিকে থাকতে হলে এখন এয়ারটেল-রবির মতো মার্জার করে ব্যবসা করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ