জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর কোথায় নেই? পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ছাপিয়ে পরিবেশ দূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তন চলে গেছে পৃথিবীর দুই মেরু অ্যান্টার্কটিকা আর আর্কটিকে। পৃথিবীর উত্তরের মেরু অঞ্চল আর্কটিকের তাপমাত্রা বাড়ছে, গলছে বরফ।
চারদিকে বরফ গলে যাওয়ার নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যা দেখে চিন্তিত পরিবেশবিদরা।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী বৃদ্ধি পেলে কয়েক শতাব্দীতে বিশ্বের বৃহত্তম বরফ স্তরটি গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ‘কয়েক মিটার’ বৃদ্ধি পেতে পারে। বুধবার (১০ আগস্ট) প্রকাশিত এক বৃটিশ সমীক্ষায় এ কথা বলা হয়।
ডারহাম ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, যদি বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বেশি থাকে তাহলে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা আইস শিট গলে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় অর্ধ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। তাদের এই গবেষণা রিপোর্ট বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচারে প্রকাশিত হয়েছে।
যদি এর বাইরে নির্গমন আরও বেশি হতে থাকে তবে ইএআইএস গলে ২৩০০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় এক থেকে তিন মিটার এবং ২৫০০ সালের মধ্যে দুই থেকে পাঁচ মিটার হতে পারে।
তবে যদি নির্গমন নাটকীয়ভাবে হ্রাস করা যায়, তাহলে মূল্যায়ন অনুসারে ইএআইএস গলন কমে যাওয়ায় ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় দুই সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেতে পারে।
এটি গ্রিনল্যান্ড এবং পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা থেকে অনুমিত বরফ গলনের ক্ষতির চেয়ে অনেক কম হবে।
গবেষণা রিপোর্টের প্রধান লেখক ডারহাম ইউনিভার্সিটির ভূগোল বিভাগের ক্রিস স্টোকস বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্লেষণ থেকে একটি মূল উপসংহার হল যে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা বরফের শীটটির ভাগ্য আমাদের হাতেই রয়ে গেছে।’
‘এই বরফের শীটটি এই গ্রহে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়। এতে সমুদ্র পৃষ্ঠের ৫২ মিটার উচ্চতার সমতুল্য জলরাশি রয়েছে এবং এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা এই ঘুমন্ত দৈত্যটিকে জাগ্রত না করে ঘুমন্ত রাখতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেটা অনুসরণ করলে আমরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে পারি এমনকি পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা বরফের শীট গলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারি এবং বৈশ্বিক সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব সীমিত করতে পারি।’
এই বরফের শীটটি এই গ্রহে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়। এতে সমুদ্র পৃষ্ঠের ৫২ মিটার উচ্চতার সমতুল্য জলরাশি রয়েছে এবং এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা এই ঘুমন্ত দৈত্যটিকে জাগ্রত না করে ঘুমন্ত রাখতে পারি।’
এই গবেষণা দলে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তারা ২১০০, ২৩০০ এবং ২৫০০ সাল নাগাদ বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা এবং বরফের শীটে তাপমাত্রার প্রভাবের মডেল কম্পিউটার সিমুলেশন করেন।
তারা প্রমাণ পেয়েছেন যে ‘তিন মিলিয়ন বছর আগে, যখন তাপমাত্রা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল। তখন ইএআইএস-এর কিছু অংশ ‘ধ্বসে পড়ে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা কয়েক মিটার বৃদ্ধি পায়।’
বরফের দেশ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ মেরুর মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। তবে ওই অঞ্চলটির সেই শীতলতা দিন দিন কমছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বাড়ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা। ইতোমধ্যেই অ্যান্টার্কটিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অ্যান্টার্কটিকার বরফের রাজ্য ছোট হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ৪৩ বছর আগে যখন থেকে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই বরফ রাজ্যের সীমা বোঝার চেষ্টা শুরু হয়, তখন থেকে এ যাবৎকালে অ্যান্টার্কটিকায় সবচেয়ে কম বরফের তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে, অ্যান্টার্কটিকায় বরফ রাজ্যের বিস্তৃতি এখন ২০ লাখ বর্গকিলোমিটারের নিচে নেমে এসেছে। এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী অ্যান্টার্কটিকায় ১৯ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে বরফ।
২০১৭ সালের চেয়ে যা ১ লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার কম; যা গোটা বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটা সেন্টার (এনএসআইডিসি) এ তথ্য দিয়েছে।
অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত বিজ্ঞানিরা। তারা বলছেন, এখানে গত ৫০ বছরে তাপমাত্রা গড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বেড়েছে। একারণে গলছে বরফ। অস্বাভাবিক হারে অ্যান্টার্কটিকায় বরফ গলতে শুরু করায় বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও।
এত দ্রুতগতিতে বরফ গলে যাওয়ায় বেড়ে যাবে বিভিন্ন সমুদ্রের পানি। সমুদ্রের উপকূলে বসতি স্থাপনকারী অনেক অঞ্চল সমুদ্রের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। এতে বড় ধরণের হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববাসী।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে জানালেন, তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে উপকূলীয় দেশগুলোর বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে বিপন্ন হতে পারে মানুষ ও পরিবেশ। তবে, গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন যে, দ্রুত বরফ গলার এমন ঘটনা প্রথমবারের মতো ঘটেনি। প্রায় এক লাখ ২৯ বছর আগে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিলো।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।
তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা স্বভাবিক রাখতে বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনদস্যুদের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত বনাঞ্চল নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবেশ ও উষ্ণতা স্বভাবিক রেখে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১১
আপনার মতামত জানানঃ