ডাইনোসর বলতে জনপ্রিয় ধারণায় একটি অধুনা অবলুপ্ত, সাধারণত বৃহদাকার মেরুদণ্ডী প্রাণীগোষ্ঠীকে বোঝায়। এরা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের প্রাগৈতিহাসিক অধিবাসী এবং বৈজ্ঞানিকদের অনুমান এই প্রভাবশালী প্রাণীরা প্রায় ১৬ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে। প্রথম ডাইনোসরের বিবর্তন হয়েছিল আনুমানিক ২৩ কোটি বছর পূর্বে। যদিও `ডাইনোসর` কথাটার আক্ষরিক অর্থ ভয়াবহ গিরগিটি, কিন্তু ডাইনোসরেরা প্রকৃতপক্ষে গিরগিটি নয়।
বরং তারা সরীসৃপ শ্রেণীর অন্তর্গত একটা আলাদা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, যাদের শারীর বৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ অনেকাংশে বর্তমান সরীসৃপদের থেকে পৃথক; যেমন, তারা ছিল উষ্ণশোণিত এবং দ্বিপদ গমনে সক্ষম। কোটি কোটি বছর আগের পৃথিবীতে রাজত্ব করে বেড়ানো এ প্রাণীর ফসিল বা জীবাশ্ম বিশ্বের অনেক জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। তবে বাংলাদেশে ডাইনোসরের কোনো ফসিল আবিষ্কার না হলেও সাত কোটি বছর আগের ডাইনোসরের জীবাশ্ম (ফসিল) পেয়েছে বাংলাদেশ।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ৪০ বছর ধরে ফসিলগুলো একজনের বসার ঘরের শোকেসে শোভা পাচ্ছিল। মূল্যবান এই নিদর্শন এবার জাদুঘরের শোকেসের শোভা বাড়াবে। রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে সর্বসাধারণের জন্য শিগগিরই উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে ফসিলগুলো।
বৃক্ষ ও উদ্ভিদ এবং জলজ প্রাণীর ফসিল দেশে সংরক্ষণে আছে। তবে ডাইনোসরের ফসিলের কথা এই প্রথম জানা গেল। চার দশক আগে কানাডা থেকে আটটি ফসিল সঙ্গে করে এনেছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) উপাচার্য হাফিজা খাতুন। গত বছর তিনি জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে চারটি ও বিজ্ঞান জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে চারটি ফসিল হস্তান্তর করেন।
জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য ফসিলগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পরীক্ষাগারে পাঠায়। পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর জাদুঘর কর্তৃপক্ষ হাফিজা খাতুনের দেওয়া নিদর্শনগুলো গ্রহণ করে তাকে একটি ধন্যবাদপত্র দিয়েছে।
ফসিলগুলো কোত্থেকে পেয়েছেন—জানতে চাইলে হাফিজা খাতুন ফিরে যান চার দশক আগে তার তারুণ্যের দিনগুলোয়। ১৯৮৩ সালে তিনি কানাডায় পড়তে যান। ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টায় স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। তখন সেখানে ডাইনোসর নিয়ে খুব হইচই হচ্ছিল। কৌতূহলবশত বিশ্বসেরা ডাইনোসর জাদুঘর কানাডার ড্রামহেলার এলাকার দ্য রয়েল টাইরেল জাদুঘর দেখতে যান। জাদুঘরটিতে ডাইনোসরের ফসিল সংগ্রহ ও প্রদর্শন করা হয়। সেখান থেকে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ডাইনোসর গবেষণা দলের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই গবেষণা দলের মাধ্যমেই তিনি মাঠপর্যায়ে ডাইনোসরের ফসিল সংগ্রহের কাজে যান। তাদের কাছ থেকে আটটি ফসিল সংগ্রহ করেন।
১৯৮৪ সালে দেশে ফেরার সময় ফসিলগুলো সঙ্গে করে দেশে নিয়ে আসেন। মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করার কারণে ফসিলগুলো দেশে আনতে কোনো আইনগত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসতে হয়নি বলে জানিয়েছেন হাফিজা খাতুন। দেশে ফিরে তিনি ফসিলগুলো ঘরের শোকেসে সাজিয়ে রেখেছিলেন। মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীদের ফসিলগুলো দেখাতেন। বাড়িতে বেড়াতে এসে কৌতূহল নিয়ে অনেকে ফসিলগুলো দেখেছেন।
দীর্ঘ ৪০ বছর ফসিলগুলো নিজে যত্ন করে রেখেছিলেন। পরে তার মনে হলো, এগুলো দেশের সম্পদ। তাই জাদুঘরেই দেওয়া উচিত। সেই ভাবনা থেকে গত বছরের এপ্রিলে তিনি ফসিলগুলো দুই জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন।
এদিকে ফসিলগুলো পেয়ে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ উপাচার্য হাফিজা খাতুনকে ধন্যবাদ দেওয়ায় নিজেদের গর্বিত ভাবছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা। উপাচার্যের মাধ্যমে ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি জড়িয়ে রইল বলে মনে করছেন তারা।
কোটি কোটি বছর আগের পৃথিবীতে রাজত্ব করে বেড়ানো এ প্রাণীর ফসিল বা জীবাশ্ম বিশ্বের অনেক জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। তবে বাংলাদেশে ডাইনোসরের কোনো ফসিল আবিষ্কার না হলেও সাত কোটি বছর আগের ডাইনোসরের জীবাশ্ম (ফসিল) পেয়েছে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কানাডায় গবেষকেরা বিশেষ জরিপ চালিয়ে ফসিলগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। আমি তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। এই ফসিল দুর্লভ। ডাইনোসর নিয়ে দেশ-বিদেশের যারা গবেষণা করবেন, ফসিলগুলো তাদের উপকারে আসবে বলে মনে করি।’
বাংলাদেশে কি ডাইনোসর ছিল ?
বাংলাদেশে কি ডাইনোসর ছিল ? বাংলাদেশে কি ডাইনোসরের ফসিল আবিষ্কারের সম্ভাবনা আছে ?
এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশে ডাইনোসর ছিল কিনা তা বলা খুবই মুশকিল এবং ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়ার সম্ভাবনা খুবি ক্ষীণ। কিন্তু কেন? আসুন জেনে নেই এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।
প্রথমত, ডাইনোসর পৃথিবীর বুকে বিচরণ কবে করেছিলো বা এর উৎপত্তি এখনো বেশ আলোচিত ও চলমান গবেষণার বিষয়। কিন্তু গবেষকরা আধুনিক নানান রকম রেডিওম্যাট্রিক ডেটিং প্রক্রিয়ায় কম বেশি মেনে নিয়েছেন যে, আনুমানিক ২৩ কোটি বছর পূর্ব থেকে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর পূর্ব ডাইনোসররা পৃথিবীর বুকে হেটে বেড়াতো। এরপরে কোন একটি বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডাইনোসরদের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগলিক অবস্থানের উৎপত্তি হয়েছে ডাইনোসর বিলুপ্তির অনেক অনেক পরে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ আজ ভৌগলিকভাবে যেখানে অবস্থান করছে তাকে বিজ্ঞানীরা নানান নামে বলে থাকেন – গেঙ্গিস ডেল্টা বা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। ৩০ থেকে ২৫ কোটি বছর পূর্বে আজকের ভারতীয় উপমহাদেশ গন্ডোয়ানা নামের সুপারকন্টিনেন্ট বা মহা-মহাদেশের অংশ ছিলো। ১২ থেকে ১৪ কোটি বছর পূর্বে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট গন্ডোয়ানা মহা-মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শুরু করে এবং উত্তরমুখী হতে থাকে। এই প্রক্রিয়া ৪-৫ কোটি বছর আগে শুরু হয়ে এখনো চলছে।
বাংলাদেশ ডাইনোসরের সময়কালে প্রচুর ভৌগলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, বাংলাদেশের অনেকাংশ পানিতে তলিয়ে ছিলো, ফলে জীবাশ্ম সংরক্ষণের জন্য যেরকম শুষ্ক, অনুর্বর ভূমির প্রয়োজন বাংলাদেশে তা ছিলো না।
আনুমানিক সাড়ে ৪ কোটি বছর আগে ভারতীয় প্লেট, বার্মা ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সাথে সংঘর্ষে সৃষ্টি হয় আজকের হিমালয় পর্বতমালা। এরপর সাড়ে ৪ কোটি বছর থেকে ১ কোটি বছর আগ পর্যন্ত হিমালয় পর্বতমালা ও গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র নদীমালা তৈরির প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
এ পুরো সময় আজকের বাংলাদেশের অনেকখানি সমুদ্রের পানির উচ্চতার তার তম্যের দরুণ তলিয়ে থাকতো অগভীর পানিতে। পরবর্তী এক কোটি বছর হিমালয়ের নদীগুলো পলিমাটি জমিয়ে ব-দ্বীপের সৃষ্টি করে। সহজ কথায় এই ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয় ডাইনোসর বিলুপ্ত হবার অনেক পরে।
তৃতীয়ত, ডাইনোসরের জীবাশ্ম সংরক্ষিত অবস্থায় পৃথিবীর সবখানেই পাওয়া যায় না। আজ পর্যন্ত যত ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে তার বেশিরভাগই মিলেছে উচু, শুষ্ক, অনুর্বর ভূমিতে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেসব জায়গায় অগভীর পানির উৎস যেমন নদী বা নদীর বাক ছিল সেখানে ডাইনোসরদের উপস্থিতি বেশি ছিলো। পরবর্তীতে এই নদীগুলো শুকিয়ে যায় এবং লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তনে সেখানে পাললিক শিলা স্তর জমা পড়ে,মৃত ডাইনোসরদের বা অন্যান্য প্রাণীদের জীবাশ্ম সংরক্ষিত অবস্থায় সেখানেই পাওয়া গিয়েছে।
তাই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ডাইনোসরের সময়কালে প্রচুর ভৌগলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, বাংলাদেশের অনেকাংশ পানিতে তলিয়ে ছিলো, ফলে জীবাশ্ম সংরক্ষণের জন্য যেরকম শুষ্ক, অনুর্বর ভূমির প্রয়োজন বাংলাদেশে তা ছিলো না ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ডাইনোসরের প্রথম জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। এরপর থেকে পর্বতগাত্র বা শিলায় আটকা পড়ে থাকা ডাইনোসরের কঙ্কাল পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ডাইনোসরেরা বর্তমান বিশ্ব সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। ডাইনোসরদের জনপ্রিয়তা সাহিত্য, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে তাদের প্রবেশ নিশ্চিত করেছে। প্রধানত কোনো কোনো অবলুপ্ত ডাইনোসর প্রজাতির বিশাল আয়তন এবং তাদের সম্ভাব্য হিংস্র স্বভাবের দরুন তারা শিশু ও বয়স্ক সবার কাছেই বিশেষ আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই বলে বাংলাদেশে যে জীবাশ্ম পাওয়াই যাবে না তা বলাটা খুবই ভুল। আমাদের ভূমিতে হয়তো ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু কয়েক লক্ষ বছর পুরানো স্তন্যপায়ী প্রাণী বা অন্য সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবাশ্ম আমাদের দেশে পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৬
আপনার মতামত জানানঃ