মানুষের মতো প্রাণীকে একবারে মুখের মধ্যে পুরে ফেলা তাদের পক্ষে নিতান্তই জলভাত। ডাইনোসর কথা বলছি। প্রাগৈতিহাসিক এই দৈত্যরা আজকের পৃথিবীতে হাজির থাকলে, মানুষের জীবন কেমন হত, তাদের সঙ্গে আমাদের সংঘাতেই পরিণতিই বা কেমন হত— স্পিলবার্গের সৌজন্যে সেই কাল্পনিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সেলুলয়েড স্ক্রিনে সাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের সকলেরই।
কিন্তু যদি বলা হয়, সুদূর অতীতে সত্যিই একদিন মানুষের পূর্বপুরুষ ও ডাইনোসর সহাবস্থান করত এই পৃথিবীর বুকেই?
হ্যাঁ, সম্প্রতি এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে এনেছেন গবেষকরা। আর এই গবেষণা থেকে জানা যায়, ডাইনোসরদের সঙ্গে নাকি এক মাটিতে বাস করত বনমানুষরা। বিশালায়তন ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়ার আগে এমনটাই নাকি ছিল পৃথিবীর পরিবেশ। সম্প্রতি বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা কারেন্ট বায়োলজিতে এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাতেই গবেষকরা দাবি করেছেন এমনটা।
প্রসঙ্গত, বিশালাকার ডাইনোসর আদতে স্তন্যপায়ী গোত্রের প্রাণী। ৬ কোটি বছর আগে এই প্রজাতি বিশাল উল্কাপাতের ফলে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে তার আগে দিব্যি মানুষের সঙ্গেই নাকি বসবাস করত বিভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসর।
অবশ্য আজকের পরিণত মানুষ অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্স নয়, বরং আমাদের ‘প্রাইমেট’ গোত্রীয় পূর্বপুরুষরা সাক্ষাৎ পেয়েছিল ডাইনোসরদের। দৈত্যাকার ডাইনোসরদের অবলুপ্ত হওয়ার আগে স্বল্প সময়ের জন্য একইসঙ্গে এই পৃথিবীর বুকে সহাবস্থান করত তারা।
গবেষকদের এই দাবির নেপথ্যে রয়েছে ক্রিটেসিয়াস যুগের প্ল্যাসেন্টা গোত্রের স্তন্যপায়ীদের কিছু জীবাশ্ম। ক্রিটেসিয়াস কী? প্ল্যাসেন্টা গোত্রের অর্থই-বা কী? মূলত আজ থেকে ১৪.৫-৬.৬ কোটি বছর আগের সময়কালটিকেই ক্রিটেসিয়াস যুগ বলে চিহ্নিত করেন গবেষকরা। মূলত এই সময়েই পৃথিবীর বুকে রাজত্ব ছিল ডাইনোসরদের।
এই যুগের শেষ লগ্নে পৃথিবীতে আগমন ঘটে প্ল্যাসেন্টা গোত্রের প্রাণীদের। এই গোত্রের মধ্যে যেমন কুকুর, বাদুড়, বানর, শূকর রয়েছে, তেমনই রয়েছে মানুষও।
তবে দু-একটি নয়, প্রায় সহস্রাধিক জীবাশ্মের বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন গবেষকরা। যার মধ্যে রয়েছে কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, বাদুড় এবং বনমানুষের জীবাশ্ম। সেগুলির আনুমানিক বয়স প্রায় ৬.৬-৭ কোটি বছর। সম্প্রতি প্লাসেন্টা স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্ম পরীক্ষা করে এমনটাই জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এই পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে অবশ্য অনেকগুলি ফলাফল পান বিজ্ঞানীরা।
তবে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত। তাদের কথায়, ক্রেটাসিয়াস পর্বের শেষ হয় ওই বিশাল উল্কাপাতের ফলেই। তখনই স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে একটি বড়রকমের বৈচিত্র তৈরি হয়। আর তার থেকে সৃষ্টি এই বিশ্বের, যেমনটা আমরা চোখে দেখছি। তবে এই ধ্বংসলীলার মধ্যেও নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল আকারে তুলনামূলকভাবে ছোটো প্ল্যাসেন্টা গোত্রের স্তন্যপায়ীরা।
এমনকি তারাই পরবর্তীতে পৃথিবীতে প্রাণের ধারা বজায় রাখে। পরবর্তী সময়ে কালের নিয়মে তাঁরা বিবর্তনের পথেও এগিয়েছে। তবে শুধু বনমানুষ নয়, আকারে ছোট অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, বাদুড়ের জীবাশ্ম পরীক্ষা করেই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বিজ্ঞানীরা।
অবশ্য পৃথিবীর সঙ্গে গ্রহাণুর সংঘর্ষে পরিবেশ এবং পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল সম্পূর্ণভাবে। ফলে, একাধিক বিবর্তন এবং অভিযোজনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তৎকালীন যুগের প্ল্যাসেন্টাদের। ফলস্বরূপ স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে বড়োসড়ো বৈচিত্র তৈরি হয়। বদল আসে আকার, আয়তন, স্বভাব এবং জীবনধারণের পদ্ধতিতে। সেই বিবর্তনের ধারা মেনেই পরবর্তীতে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় আধুনিক মানুষ। যদিও সেটা মাত্র লাখ দুয়েক বছর আগে।
ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গবেষক এমিলি কার্লিসল সংবাদমাধ্যমকে জানান, সব মিলিয়ে হাজারটি জীবাশ্মের নমুনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তার থেকেই জানা গিয়েছে, কীভাবে কোন স্তন্যপায়ী প্রজাতির উৎপত্তি হয়েছে। অন্যদিকে কোন প্রজাতি কখন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে তারও একটি ধারণা এই জীবাশ্ম গুলি পাওয়া গিয়েছে।
তবে গবেষকদের অনেকেরই অভিমত, ডাইনোসরের মতো বড়ো খাদক পৃথিবী থেকে মুছে যাওয়ার কারণেই বিবর্তনের পথ আজকের দিনে এসে পৌঁছে দিতে পেরেছে মানব সভ্যতাকে। সে যাই হোক না কেন, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা যেন সন্ধান দিল এক নতুন দিগন্তের। আগামীতে প্রাচীন বিশ্বের একাধিক অজানা রহস্যের সমাধান খুঁজে দিতে পারে এই বিশেষ গবেষণাটি, অভিমত জীববিজ্ঞানীদের।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ