মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর বিচার এবং দলটি নিষিদ্ধ করার কথা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা জোরালো প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা এখন নীরব।৭ বছর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু দীর্ঘ ৭ বছরেও এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন না হওয়ায় ঝুলে আছে বিচারপ্রক্রিয়া।
তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) নেতাকর্মীদের নিয়ে তৈরি আলবদরের নেতৃত্বে জাতিকে মেধাশূন্য করতে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । দীর্ঘদিন পরে হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় কয়েক নেতার বিচারের রায় ও তা কার্যকর হয়েছে। অনেকের বিচারকাজ চলছে। কিন্তু আইন সংশোধন না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাকারী এবং গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের নির্দেশক জামায়াত, তাদের সহযোগী ‘আলবদর’, ‘আলশামসের’ মতো সংগঠনের বিচার শুরুর উদ্যোগ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। কারণ ২০১৩ সালে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে সংশোধনী আনার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি।
পরের বছর ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্তও করে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই। এই অবস্থায় ২০১৪ সালে আইন মন্ত্রণালয় অপরাধী সংগঠনেরও শাস্তির বিধান রেখে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। প্রস্তাবিত ওই সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালস আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘ব্যক্তি’ শব্দটির পর ‘অথবা সংগঠন’ সন্নিবেশ করা হচ্ছে। আরেকটি ধারায় ‘দায়’ শব্দটির পরিবর্তে ‘অথবা সাংগঠনিক দায়’ এবং অপর ধারায় ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ পরিবর্তে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া সংগঠন হিসেবে দোষী প্রমাণিত হলে ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এরপর নিষিদ্ধ হতে পারে এমন আশঙ্কায় জামায়াতও নতুন নামে আত্মপ্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু নিষিদ্ধ না হওয়ায় তাদের সে পথে যেতে হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটি এখনো রাজনীতিতেও সক্রিয়।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ এখনো রয়েছে। আইনের খসড়া সংশোধনী মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলেই বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যাবে না। বিচার হবে এটুকু বলতে পারি। আমরা চেষ্টা করব।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত সংবাদ মাধ্যম দেশ রুপান্তরকে বলেন, ‘তদন্তের পর জামায়াতের বিচার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংকেত না পাওয়ায় এটি মামলা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়নি। একপর্যায়ে আমাদের বলা হলো ধীরে চলো। এরপরই মূলত প্রক্রিয়াটি থমকে যায়। এরপর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আইনে কিছু পরিবর্তন ও সংশোধনী আনতে চান বলে জানান। কিন্তু এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, এখানে রাজনৈতিক কৌশল অথবা কোনো চিন্তাভাবনা রয়েছে। এমন না হলে বিষয়টি নিয়ে এত বিলম্বের কারণ ছিল না।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠনের বিচার আমরা অনেক আগে থেকে চেয়ে আসছি। সুযোগ আসার পরও সরকার কেন তা করছে না, তা তারাই ভালো বলতে পারবে।
তিনি বলেন, তদন্ত পর্যায়ে গিয়েও বিষয়টি থেমে যায়। এ জন্য তিনি সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির ভূমিকারও সমালোচনা করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াতকে কেন নিষিদ্ধ করতে হবে, আমরা হাজারটা যুক্তি দিতে পারব। বঙ্গবন্ধু কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, তিনি কিন্তু তার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। এখন সরকার কারও কথা শুনবে না। তারা বঙ্গবন্ধুকে মানবে না, আমাদের কথা শুনবে না। হেফাজতের সঙ্গে বৈঠক করবে, তাতে কার কী করার আছে?’
যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত জামায়াত ইসলামী’কে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধের স্বপক্ষে জনমত বেশ শক্তিশালী। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ বিষয়ে সরকারের কাছে যথেষ্ঠ আকাঙ্খা তৈরি হলেও অজানা কারণে সরকার এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে বিশেষজ্ঞমহলের অভিমত।
এসডব্লিউ/কেএইচ/নসদ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ