বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এ খাতের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের হাতে থাকাই বাঞ্ছনীয়। নইলে আশঙ্কা থাকে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার এই খাতকে ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে একগুচ্ছ পদক্ষেপ কার্যকর করেছে। সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নের নীতিই ছিল ব্যক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি খাতকে সংকুচিত করে আনা। এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চেয়ে সরকার আমদানিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আইএমএফ বেসরকরি খাতের বিকাশ এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ের শর্তারোপ করে সরকারকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়। শর্তাবলির অধীনে থাকা নানা বিষয়ের মধ্যে অন্যতম একটি ছিল বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন জানান দেন যে, সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়েছে।
০৪ জানুয়ারি, ২০১২ তারিখে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, ‘আগামী তিন বছরে (২০১৫ পর্যন্ত) পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হবে এবং বিদ্যুৎখাত থেকে ভর্তুকিও ন্যূনতম স্তরে নামিয়ে আনা হবে। নিয়মমাফিক বছরে অন্তত দুইবার বিদ্যুতের দাম বাড়বে।’ এরপর এই সময়সীমা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন অবধি বিদ্যুতের দামসহ এ খাতের পরিকল্পনাগুলো গৃহীত হচ্ছে বিদেশি সংস্থার নির্দেশিত সেই পথেই।
বিদেশি দাতাদের চাপে বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয়া হয় তার ফসল হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাকরণ। সরকারের সুস্পষ্ট নীতি হলো, বেসরকারি খাত থেকে কত বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এজন্য ব্যয় বাড়ার ঝুঁকিকে তারা মোটেও পরোয়া করেনি। বরং ‘যত দাম লাগুক, আমরা বিদ্যুৎ চাই’ বলে বেসরকারি খাতকে অবাধ কার্যক্রম পরিচালনার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। এগুলো যেন কোনোভাবে ঠেকানো না যায় সেজন্য করা হয়েছিল দায়মুক্তি আইন। প্রথমে বিদ্যুতের সঙ্কটকে পুঁজি করে, পরবর্তীকালে সঙ্কটের ধোঁয়া তুলে ব্যক্তি খাতকে মুনাফা লোটার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
২০১৪ সালের মধ্যে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদায় নেয়ার কথা থাকলেও তা টিকিয়ে রাখা হলো এবং মূলত ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প সুযোগ সত্ত্বেও চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ না পাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হয়। বিইআরসি এক সময় সুপারিশ করেছিল যে, রেন্টালের মেয়াদ আর যেন বৃদ্ধি না করা হয়। সে সময় বিইআরসির শুনানিতে বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সবাই সম্মত হয়েছিল যে, রেন্টালের মেয়াদ আর বৃদ্ধি করা যাবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে তা কার্যকর হয়নি, এখনো সেগুলো চলমান রয়েছে। কার্যত ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ীই এই খাতের উন্নয়ন চলছে। তাতে করে ব্যবসায়ীদের পকেট ছাড়া আর কারো কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।
২০১৫ সালে দেখা গেল, সরকারের যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে তেলের অপর্যাপ্ততার কারণে তার একটা অংশ ব্যবহার না করে বসিয়ে রাখা হচ্ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলেও সেই সুবিধা কাজে লাগানো হয়নি। জ্বালানির মূল্য খানিকটা কমানো হলেও তা ন্যায্য ছিল না। বরং সেটা এমনভাবে করা হয়েছিল যে, জনগণ তার সুবিধা পায়নি। লাভটা গেছে পুরো ব্যবসায়ীদেরই পকেটে।
একসময় এরকম ঘটোল যে, সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে তেল দেয়া গেলে সেখান থেকেই ৫০০ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু তা না করে ২৮০০ থেকে ৩৪০০ মেগাওয়াট তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জরুরি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। বিকল্প জ্বালানিও নয়, তেলের উপর ভিত্তি করেই এগুলো করা হলো। এগুলো ছিল পরিষ্কারভাবে বিদ্যুৎ খাতকে ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়ার পদক্ষেপ।
সংকটটা তৈরি করা হলো এভাবে যে, সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে চড়া দামে তেল কেনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। কারণ সরকার দেশের বাজারে তেলের দাম কমায়নি। ফলে বিপিসি আমদানি মূল্যে নয় সরকারের মুনাফা ধরে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে তেল বিক্রি করতে বাধ্য। আর বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের সুযোগ দেয়া হলো নিজেদের তত্ত্বাবধানে তেল আমদানি করার। দেখা গেল তাদের তেলের দাম ও সে অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম খানিকটা কম পড়ছে। এভাবে ব্যক্তি খাতকে তেল আমদানিতে কারচুপি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করে লাভ করার সুযোগ করে দেয়া হলো এবং সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসে থাকল।
সামিট গ্রুপ কিভাবে সুবিধা পায়, তার উদাহরণ হলো বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১২ সালে এটি নির্মাণে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দরপত্রে সামিট গ্রুপ ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। একমাত্র কোম্পানি হিসেবে সামিট অংশ নেওয়ায় তারা যে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরেছে সেটাই গৃহীত হয়েছে এবং অভিযোগ রয়েছে যে, এটি বেশি ছিল। ‘বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট’ (বিডব্লিউজিইডি) চলতি বছরের মার্চে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য দেয়।
ব্যক্তি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দেয়ার কথাও বলা হয়। এরপর দেখা গেল, দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের সংস্থান হলো না। তখন অবিবেচকের মতো সরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখে ব্যক্তি খাতে গ্যাস সরবরাহ করা হলো। সরকারি খাতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে যে ব্যয় হতো তার প্রায় তিন গুণ দামে বেসরকারি খাত থেকে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ নেয়া হলো। কারণ সরকারের নীতি ছিল, সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকবে, চলবে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন।
ব্যক্তি খাতকে প্রতিষ্ঠা করতে আরো নানামুখী উদ্যোগ কার্যকর করা হলো। ব্যবস্থা করা হলো যেন ব্যক্তি খাতের মালিকরা মোট ব্যয়ের ৩০ ভাগ বিনিয়োগ করলেই ব্যাংক থেকে বাকি ৭০ ভাগ ঋণ পেতে সক্ষম হয়। এর বিপরীতে সরকারি খাতে অর্থ বরাদ্দকে করে রাখা হলো জটিল বিষয়। তাছাড়া প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে গড়িমসি, কালক্ষেপণ ও স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রীয় খাতকে পেছন থেকে বেঁধে রাখা হলো।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে জানে। দেশেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের পূর্ণ সক্ষমত রয়েছে। তবু ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হলো দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব। পরিকল্পনা করা হলো, আমদানিকৃত এলএনজি চট্টগ্রামের এলএনজি টার্মিনাল থেকে মেঘনাঘাটে যাবে। ভারতীয় রিলায়েন্স কোম্পানি সেখানে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি ধরা হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল বিশেষজ্ঞদের। তাছাড়া বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়াটাও ছিল গোলমেলে। সাধারণত বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে। কিন্তু ভারতীয় কোম্পানি দাম নির্ধারণ করবে সরকারের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে। এখানে কমিশন ভাগাভাগি করে দেশের স্বার্থ বিনষ্টের সুযোগ রাখা হলো।
বিশ্লেষকরা বলেন, সরকারের নীতি হওয়া উচিত ছিল, ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন কোনোক্রমেই ২৫ ভাগের বেশি হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু বেসরকারি খাতকে দিনে দিনে একচেটিয়া হয়ে উঠতে দেয়া হলো। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ মূলত দেশীয় বেসরকারি খাত ও বিদেশিদের হাতে। সর্বশেষ জুন মাসের শেষে বিদ্যুৎ খাতের যে চিত্রটি পিডিবি সরবরাহ করেছে, তা থেকে দেখা যায়, এ খাতে সরকারের প্রকৃত হিস্যা এখন ৪০ শতাংশেরও কম।
এক নজরে বিদ্যুৎ খাত
৩০ জুন ২০২২, সূত্র: বিপিডিবি
উৎপাদনের মালিকানা | মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র | স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা (মেগাওয়াট) | উৎপাদনে হিস্যা |
সরকারি খাত | ৫৭ | ১০,১৩০ | ৩৯.৪% |
যৌথ (সরকার ও চীনা কোম্পানি) | ১ | ১,২৪৪ | ৪.৮% |
বেসরকারি খাত (রেন্টালসহ) | ৯৪ | ৯,৯৪৮ | ৩৮.৭% |
আমদানিকৃত (ভেড়ামারা ও ত্রিপুরা) | – | ১,১৬০ | ৪.৫% |
ক্যাপটিভ | – | ২,৮০০ | ১০.৯% |
অফগ্রিড নবায়নযোগ্য | – | ৪১৮ | ১.৭% |
মোট | – | ২৫, ৭০০ | ১০০% |
যৌথ খাতকে সমান ভাগে ধরলে সরকারি মালিকানায় রয়েছে মোট বিদ্যুতের = ৪১.৮% এবং বেসরকারি মালিকানায় রয়েছে = ৫৮.২%
বিদ্যুৎ খাতের মালিকানা বেসরকারি খাতে গেছে এবং তাদের মুনাফার প্রয়োজনে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে উচ্চহারে। বেসরকারি মালিকরা কিভাবে মুনাফা হাতিয়েছে তার চিত্র মেলে একটি তথ্য থেকে। বিদ্যুৎ বিক্রি করে, জ্বালানি আমদানি করে নানা পথে তো তারা লাভ করেছেই। এর বাইরে সরকারের সঙ্গে তারা এমনভাবে চুক্তি করেছে যেন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও, কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও যেন টাকা পাওয়া যায়। এভাবে ক্যাপাসিটি চার্জের নাম করে গত ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নিয়ে গেছে ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের পেছনে গিয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে এর সঙ্গে নতুন করে আরো যোগ হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। ১২ বছরে পিডিবিকে রেন্টাল, কুইক রেন্টালে মোট ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা।
এসব মুনাফা কার পকেটে গেছে? অনুসন্ধানে দেখা যায়, জনগণের করের টাকা থেকে দেয়া এই ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কেবল ১২টি কোম্পানির পকেটেই গেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। পিডিবির তথ্যানুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে আজিজ খানের মালিকানাধীন সামিট গ্রুপ। বর্তমানে সামিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর জন্য কোম্পানিটি বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
সামিট ছাড়াও যারা বিদ্যুৎ খাতের মুনাফা লুটেছে তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মনজিত দালে ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাদেক ওয়াহবার মালিকানাধীন এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাণিজ্য বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বস জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আজিজ খান রয়েছেন ৩৪ নম্বরে। ৬৩ বছর বয়সী আজিজ খান গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সাবেক বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের ভাই।
সামিট গ্রুপ কিভাবে সুবিধা পায়, তার উদাহরণ হলো বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১২ সালে এটি নির্মাণে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দরপত্রে সামিট গ্রুপ ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। একমাত্র কোম্পানি হিসেবে সামিট অংশ নেওয়ায় তারা যে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরেছে সেটাই গৃহীত হয়েছে এবং অভিযোগ রয়েছে যে, এটি বেশি ছিল। ‘বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট’ (বিডব্লিউজিইডি) চলতি বছরের মার্চে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য দেয়।
বিডব্লিউজিইডি দেখায় যে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩৭টি কোম্পানিকে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে সরকার। এর মধ্যে ৬৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন-ক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ ১২টি কোম্পানি ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। এ তালিকার এক নম্বরে সামিট গ্রুপ। সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন ১৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে জুলাই ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ অবধি নয় মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৬১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
সামিট ছাড়াও যারা বিদ্যুৎ খাতের মুনাফা লুটেছে তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মনজিত দালে ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাদেক ওয়াহবার মালিকানাধীন এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত চায়না জেনারেল নিউক্লিয়ার পাওয়ার করপোরেশনের মালয়েশিয়াভিত্তিক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিংস ৮১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গত ১১ বছরে সাত হাজার কোটি টাকার ওপর ক্যাপাসিটি চার্জ গ্রহণ করে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপ এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে নিয়েছে। পানামা পেপারসে নাম আসার পর ইউনাইটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা তার ছেলে মঈন উদ্দিন হাসান রশিদের হাতে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। হাসান মাহমুদ রাজাকে দুর্নীতি দমন কমিশনও ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। বাংলাক্যাট ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আমিনুল হক। তিনি আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রাইম ব্যাংকের মালিকদের মধ্যে অন্যতম।
ওরিয়ন গ্রুপ ৫০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে। আইসিবি ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থ লুটের দায়ে অপসারিত ওরিয়নের মালিক ওবায়দুল করিম দুর্নীতির নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। তার বড় ভাই এবাদুল করিম বুলবুল আওয়ামী লীগের মনোনীত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য।
এদের বাইরে হোসাফ গ্রুপ ও মোহাম্মদী গ্রুপ দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই ক্যাপাসিটি চার্জ নেয়ার তালিকায় আছে ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ কনফিডেন্স গ্রুপ, কেপিসিএল, ও এপিআর এনার্জি।
আপনার মতামত জানানঃ