নমরুদ শব্দটি হিব্রু শব্দ ‘মরদ’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বিদ্রোহী’। হিব্রু বাইবেল বা তানাখের জেনেনিস এবং ক্রনিকেলস অনুযায়ী, নমরুদ ছিলেন শিনারের (মেসোপটেমিয়া) রাজা এবং কুশের তথা নূহের নাতির পুত্র। তিনি তার খোদাদ্রোহীতা এবং টাওয়ার অব ব্যাবেল নির্মাণের জন্য পরিচিত।
ইহুদিদের বিভিন্ন র্যাবাইনিক সাহিত্য যেমন : Midrash, Tanhuma, Lekh Lekhah 6, Targum থেকে শুরু করে হিব্রু বাইবেলের Exodus (14:1) এবং Eruvin (53a) প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ ঐতিহাসিক চরিত্র নমরুদ বলতে রাজা আমরাফেলকে চিহ্নিত করেছে। সপ্তাদশ শতাব্দীতে লেখা Sefer Hayashar Midrash গ্রন্থের ১১ নাম্বার অধ্যায়ে বলা আছে-
“নমরুদ ব্যাবিলনে বসবাস করতেন এবং সেখানে অবশিষ্ট প্রজাদের নিয়ে নিরাপত্তার সাথে রাজত্ব পুনরায় স্থাপন করলেন। সেখানে তার প্রজা ও রাজকর্মচারীরা তাকে আমরাফেল নামে আখ্যায়িত করলো…”
মিদ্রাশে (Genesis Rabbah 42) বলা আছে, আমরাফেলকে তিনটি নামে অভিহিত করা হয়েছিল : কুশ, নমরুদ এবং আমরাফেল। কুশ ছিল তার পিতার নাম (Genesis 10:)। কুশ ছিলেন হামের পুত্র এবং নূহের নাতি। তবে নবি নূহ তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। পূর্বপুরুষের মাধ্যমে নমরুদের রাজা বা শাসক হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী, কৌশলী এবং দুর্ধর্ষ শিকারী। তার অনুসারীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করে একসময় তিনি ব্যাবিলনের শক্তিশালী রাজা হয়েছিলেন এবং তার সাম্রাজ্য অন্যান্য বড় বড় অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছিল।
অবশ্য নমরুদ তার সিংহাসন খুব বেশিদিন নিরাপদ থাকবে বলে মনে করেননি। তিনি আশংকা করেছিলেন যে, একসময় নূহের আরেক উত্তরাধিকারী শেমের বংশধররা উপস্থিত হবে এবং সিংহাসন দাবি করবে। নমরুদ তার কোনো প্রতিদ্বন্দী না রাখার শপথ করলেন। তবে ততদিনে শেমের বংশধরদের কেউ কেউ উর ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়ে তাদের নিজস্ব শহর এবং সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল। কিন্তু শেমের বংশধরদের মাত্র একজন সদস্য তার দেশে রয়ে যায়। তিনিই হলেন তেরাহ। তবে তেরাহ ছিলেন নমরুদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং অনুগত। ব্যাবিলনের অন্যান্য লোকদের মতো, তেরাহও বিশ্বাস করেছিলেন যে, নমরুদ তার রাজত্ব দেবতাদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন এবং তিনি নিজেও একজন দেবতা। তেরাহ নমরুদকে অত্যন্ত ভক্তি করতেন। ফলস্বরূপ, নমরুদ তার সেনাবাহিনীর সেনাপতিত্ব তেরাহর হাতে ন্যস্ত করেছিলেন এবং তাকে রাজ্যের সর্বোচ্চ মন্ত্রীর পদে আসীন করেছিলেন।
নমরুদ কীভাবে মারা গিয়েছিলেন সে সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত আছে। কারো কারো মতে, তাকে বন্যপ্রাণী দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, নূহের পুত্র শেম তাকে হত্যা করেছিল কারণ নমরুদ বিশ্বকে মূর্তিপূজার দিকে ধাবিত করেছিলেন। Jewish Encyclopedia-তে উল্লেখ আছে-
“নমরুদ ছিলেন বিশ্বের প্রথম পাপী সম্রাট।”
ইয়াহওয়েহের পক্ষ থেকে একজন মাল’আখ তার কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে তওবা করার আহবান জানান কিন্তু নমরুদ তাকে বলেন, তিনি নিজেই একমাত্র শাসক। তিনি ইয়াহওয়েহকে তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য আহবান করেন! নমরুদ মাত্র তিন দিনের মাঝে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন। ইয়াহওয়েহ পোকামাকড়ের ঝাঁক প্রেরণ করে নমরুদের সৈন্যদল ধ্বংস করে দেন। এর মধ্যে একটি পোকা নমরুদে নাকের ভেতর দিকে মস্তিষ্কে ঢুকে যায় এবং প্রচন্ড যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। ৪০ বছর যাবত তীব্র ব্যথা সহ্য করে নমরুদ মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাসবিদগণ ঐতিহাসিক কোনো চরিত্রের সাথে নমরুদকে মেলাতে ব্যর্থ হয়েছেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাকে কাল্পনিক চরিত্র বলে মনে করেন। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র যেমন : দেবতা নিনুর্তা (Ninurta) অথবা দুজন আক্কাদিয়ান রাজা সারগন এবং তার নাতি নারাম সিন (২২৫৪-২২১৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) অথবা ১ম টুকুলটি নিনুর্তার (১২৪৩-১২০৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) সাথে মেলানোর চেষ্টা করেন।
অনেক ইতিহাসবিদ গিলগামেশ এবং নমরুদকে একই চরিত্র মনে করেন। গিলগামেশ প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান কিংবন্তির (Myth) অন্যতম নায়ক। তিনি ১৮৩০ থেকে ১৫৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মধ্যে আক্কাদিয়ান ভাষায় রচিত একটি মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র ছিলেন। সম্ভবত তিনি সুমেরীয় নগর-রাজ্য উরুকের ঐতিহাসিক রাজাও ছিলেন। তার মৃত্যুর পর মেসোপটেমিয়ানরা তাকে দেবতা হিসেবে পূজা করতে শুরু করে।
এছাড়া বিখ্যাত রাজা হাম্মুরাবি-কে অনেক ঐতিহাসিক নমরুদ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তথ্যসূত্র :
britannica.com
জুদাইজম- মাশরুর ইশরাক
আপনার মতামত জানানঃ