জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বড় ধরনের বন্যার পর এবার তীব্র দাবদাহের মুখে পড়েছে চীন। একই অবস্থা ইউরোপ ও আমেরিকার একাধিক দেশে।
দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় অংশ ও চীনের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। যার ফলে বেশ কিছু শহরকে চলতি গ্রীষ্মে অপ্রত্যাশিত গরমের মুখে পড়তে হয়েছে। অন্তত ৮৬টি চীনা শহর তাপ সংক্রান্ত সতর্কতা জারি করতে হয়েছে। চীনের সবচেয়ে জনবহুল শহর সাংহাইয়ে কর্তৃপক্ষ শহরবাসীকে অস্বাভাবিক গরমের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে।
জানা গেছে, ১৮৭৩ সালে যখন থেকে এ শহরের তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হয়েছে তখন থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১৫ দিন শহরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়।
সাংহাইয়ের বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী ওয়াং ইং বলেন, জুলাইয়ের জন্য এটা খুব বেশি গরম। সারাটাদিন আমার এয়ার কন্ডিশন চালু আছে, আমি বাইরে, এমনকি বারান্দাতে যাওয়ারও সাহস করছি না। এ সপ্তাহটা আমি বাসা থেকেই অফিস করব।
অসহনীয় এ তাপমাত্রার জন্য বয়স্কদের বিশেষভাবে সতর্ক করছে চীনের বেশি কিছু শহর।
চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর নিংবোর নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফেইথ চ্যান বলেছেন, যারা চীনের জলবায়ু খবর রাখেন তাদের কাছে আবহাওয়ার এ ধরনের আচরণ একেবারে নতুন কিছু নয়। গত বছর চীনে ব্যাপক বন্যা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, কলোরাডো, ওকলাহোমা, আরকানসাসসহ কয়েকটি শহরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ইউরোপের মধ্যে স্পেন দ্বিতীয় দফায় তাপপ্রবাহের মুখে পড়েছে। দেশটির দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো কোনো শহরে তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে যেতে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
গত বছরের আগস্টে স্পেনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত সপ্তাহে পতুর্গালে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর ফলে দাবানালও সৃষ্টি হয়। পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে ধোঁয়াশা দেখা যায়।
পশ্চিম স্পেনের লা হার্দেসে দাবানলে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল পুড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে ইউরো নিউজ। ইতিমধ্যে এলাকাটি থেকে প্রায় ৪০০ বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সোমবারে পর্তুগালের তাপমাত্রা কিছুটা নেমে এলেও আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তাপমাত্রা আবার বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ফ্রান্সের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ২০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে বলে ভেবেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখন তারা বিশ্বাস করছেন, সেটি এ বছর থেকে শুরু করে ২০৪০ সালের মধ্যেই ঘটবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ