বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলমান জনসংখ্যার দেশ ভারত। কিন্তু দেশটিতে সেই তুলনায় এ সম্প্রদায়টির ভেতর থেকে আইনপ্রণেতাদের সংখ্যা একেবারে কম। তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
ভারতের পার্লামেন্টে বিজেপির কোনো মুসলিম আইনপ্রণেতা থাকছেন না। বিজেপির ইতিহাসে এই প্রথম পার্লামেন্টে দলটি মুসলিম আইনপ্রণেতাশূন্য হচ্ছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন ভারতের মন্ত্রিসভার একমাত্র মুসলিম সদস্য। তার পদত্যাগের ফলে মন্ত্রিসভা মুসলিমশূন্য হয়ে পড়ল। ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন ঘটনা ঘটল।
বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) রাজ্যসভার সদস্যপদের মেয়াদ শেষ হচ্ছিল। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার এক দিন আগে ইস্তফা দেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি।
সম্প্রতি রাজ্যসভার নির্বাচনের শেষ দফায় চমক দিয়ে নকভিকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেনি ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। সেই পরিস্থিতিতে নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রিত্ব থেকে তাকে ইস্তফা দিতে হতো।
সেইমতো বুধবার মন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার সাথে দেখা করেন নকভি। তিনি ঝাড়খণ্ড থেকে সংসদের উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতেন।
ভারতের পার্লামেন্টে বিজেপির প্রায় ৪০০ জন এমপি রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় ৬৪ বছর বয়সী নাকভি ছিলেন একমাত্র মুসলিম মন্ত্রী। নাকভির পদত্যাগের পর সংখ্যালঘুবিষয়কমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন অভিনয় থেকে রাজনীতিতে আসা ৪৬ বছর বয়সী স্মৃতি ইরানি। তিনিও রাজ্যসভার একজন আইনপ্রণেতা।
অবশ্য পদত্যাগের আগে থেকেই আলোচনায় ছিলেন নাকভি। তাঁকে ভারতের পরবর্তী ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করার কথা বিজেপি বিবেচনা করছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
দুই নেতার ইসলামবিরোধী মন্তব্যের জেরে বৈশ্বিক সমালোচনার মুখে রয়েছে বিজেপি। এমন প্রেক্ষাপটে দলটি একজন মুসলিমকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করার বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
আগামী ৬ আগস্ট ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দেশটির বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট এম ভেঙ্কাইয়া নাইডু। তার মেয়াদ শেষ হবে ১০ আগস্ট।
মোদির বিজেপি নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল দাবি করে। দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিজেপির ৩০১ জন সদস্য রয়েছেন। তারা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। তাদের মধ্যে কোনো মুসলিম সদস্য নেই।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, যেহেতু রাজ্যসভার সদস্যপদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই আইন মোতাবেক নকভিকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হতো। সংবিধান বিশেষজ্ঞ পিডিটি আচার্য বলেছেন, ‘এমপি পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য মন্ত্রীদের হাতে ছয় মাস থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই নিয়ম তাঁদের জন্য কার্যকর হবে না। তাই তাদের পদত্যাগ করতে হবে।’
তবে নকভিকে কেন মনোনীত করেনি বিজেপি, তা নিয়ে বিভিন্ন কারণ উঠে আসছে। বিশেষত নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রিসভার একমাত্র মুসলিম মুখ ছিলেন নকভি। রাজনৈতিক মহলে কানাঘুষো, নকভির জন্য আরো বড় পদ ভেবে রেখেছে বিজেপি। তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হতে পারে। যে নির্বাচন আগামী ৬ অগস্ট হবে।
তবে আবার অপর একটি মহলের বক্তব্য, নকভিতে ত্রিপুরা থেকে রাজ্যসভায় আনা হতে পারে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মানিক সাহা নির্বাচিত হওয়ার পর যে আসন ফাঁকা হয়েছে।
ভারতের ২৮ রাজ্যের ১৮টিতে সরাসরি বা জোটগতভাবে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। এসব রাজ্যের বিধানসভায় বিজেপির কোনো মুসলিম আইনপ্রণেতা নেই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিজেপির স্লোগান হলো সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবার উন্নয়ন। দলটিতে মুসলিম আইনপ্রণেতা না থাকার বিষয়টি এই স্লোগানের বিপরীত।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে সাতজন মুসলিমকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু সেবার তাদের কেউ জিততে পারেননি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। এই নির্বাচনে ছয়জন মুসলমিকে বিজেপি মনোনয়ন দিয়েছিল। তারা সবাই হেরে যান।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর নিগ্রহ চালানোর অভিযোগে বিজেপি সমালোচিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রায় ২০ কোটি মুসলমান রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরে বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস ভারতে।
ভারতে এসময়ে মুসলমান রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব একটু বেশিই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ১৯৮১ সালে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছয় কোটি ৮০ লাখ। কিন্তু ২০১১ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ২০ লাখে।
কিন্তু সেই তুলনায় মুসলমান জনপ্রতিনিধির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৯৮০ সালে যেখানে ছিল ৪৯জন, সেখানে সেই সংখ্যা কমে ২০১৪ হয়েছে ২২জন।
১৯৮০ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব ছিল নয় শতাংশ। কিন্তু ২০১৪ তা কমে হয়েছে চার শতাংশ।
এই সময়ের মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা ও পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্বের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে বর্তমানে ১০ থেকে দুই শতাংশ হয়েছে। গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে এই ব্যবধান বেড়েছে।
এই সংখ্যাগত সন্দেহটা হঠাৎ করে জাগেনি। ২০১৪ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিধস বিজয়ে দেশটির হিন্দুত্ববাদে জোয়ার লেগেছে।
ইউনাইটেড মুসলিম পলিটিক্যাল ইমপাওয়ারম্যান্টের সদস্য মুশতাকিম সিদ্দিকী বলেন, তারা মুসলমানদের মানসিকতায় বিজেপির ভয় ঢুকিয়েছে। এতে তারা যদি আমাদের একটি আসনেও প্রার্থী না করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা টু শব্দটি করবে না।
২০১৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার জ্যাফরেলট বলেন, পার্লামেন্টে আপনাদের (মুসলমানদের) প্রতিনিধিত্ব করার মতো লোক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমনটা না-ই ঘটে তবে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়ার মতো কোনো লোক থাকবে না।
ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান সংখ্যালঘুদের হয়ে কতটুকু কথা বলা হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করেন জ্যাফরেলট। দাঙ্গা, মুসলিম পারিবারিক আইন ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন এবং বিতর্ক নিয়ে গবেষণা করেন তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ