১৯৭৩ সালে এক মামলার রায়ে যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা পেয়েছিলেন গর্ভপাতের অধিকার৷ সেই অধিকার এখন আইনত নিষিদ্ধ৷ গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চলছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ।
প্রতিবাদকারীদের কোনও কোনও পোস্টারে লেখা, ‘‘যুদ্ধ না নারী, এর পরে কে?’’ কোনওটায় লেখা, ‘‘যার জরায়ু নেই, তার মতামত থাকা উচিত নয়।’’ শনিবার রাতে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের বাইরের রাস্তায় আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিতে দিতে এ ভাবেই বিক্ষোভ দেখালেন।
শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট প্রায় ৫০ বছর আগের ‘রো ভার্সেস ওয়েড’ মামলার রায় বাতিল করায় আমেরিকায় গর্ভপাত নিষিদ্ধ হতে চলেছে। তার জেরে শুক্রবার রাত থেকেই বিভিন্ন প্রদেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। মোমবাতি নিয়ে মিছিল করেন অনেকে। আজ, দু’দিন পরেও সেই বিক্ষোভের আঁচ থামেনি। বরং নতুন করে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়েছে নানা জায়গায়।
ওয়াশিংটন ডিসিতে সুপ্রিম কোর্টের বাইরের জমায়েতে ছিলেন ১৯ বছরের কলেজ পড়ুয়া মিয়া। বললেন, ‘‘একটা মেয়েকে মা হতে বাধ্য করা কাম্য নয়। এই রায় বিরক্তিকর।’’ তবে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে অ্যারিজোনা। গর্ভপাতের অধিকার রক্ষার দাবিতে শনিবার মূল প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিভোক্ষ দেখাচ্ছিলেন এক দল আন্দোলনকারী।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পক্ষে সওয়াল করে অন্য একটি দলও হাজির হয় সেখানে। পাল্টা প্রতিবাদ জানান তারাও। দু’পক্ষের মধ্যে বিতর্ক বেধে যায়। বিক্ষোভকারীদের কয়েক জন প্রশাসনিক ভবনের কাচের দরজার ঘা দিলে কাঁদানে গ্যাসের গোলা ছুড়তে বাধ্য হয় পুলিশ। ভবনের ভিতরে তখন প্রশাসনিক বৈঠক চলছে। নিরাপত্তার খাতিরে সরকারি কর্মকর্তাদের বিশ মিনিট জন্য মাটির তলার বাঙ্কারে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে হয়।
এদিকে, সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণার দিনেই এই আইন কড়া ভাবে চালু করেছে মিসৌরি। ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বাদের ক্ষেত্রেও ছাড় মিলবে না সেখানে। তার পর পরেই আলাবামা, আরকানস, কেন্টাকি, লুইজ়িয়ানা, ওকলাহোমা, সাউথ ডাকোটা, উটার মতো আটটি প্রদেশ আইন কার্যকর করেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্তত আরও ছ’টি প্রদেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হতে চলেছে।
পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চার্লসটনে গর্ভপাতের অধিকার ফিরিয়ে দিতে মোমবাতি মিছিল করেন অন্তত ২০০ জন। তাদের এক জন কেটি কিনোনিজ। কেটি ওই প্রদেশের নারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের শীর্ষকর্তা। তিনি বললেন, ‘‘রায় শোনার পরে রাগের চোটে ফোনটা দেওয়ালে ছুড়ে দিয়েছিলাম।’’ কেটি জানান, এই রায়ের প্রেক্ষিতে গর্ভপাতের জন্যে স্লট বুকিং করেছিলেন এমন ৭০ জন অন্তঃসত্ত্বাকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করতে হয়েছে। তারা হয় আর গর্ভপাত করতে পারবেন না অথবা যেখানে এখনও তা নিষিদ্ধ হয়নি, তেমন কোথাও যেতে হবে।
তবে মিনেসোটা, মিসিসিপির মতো কয়েকটি প্রদেশে অন্য ছবিও রয়েছে। মিসিসিপির একমাত্র গর্ভপাত কেন্দ্রটি শুক্রবারেও কাজ বন্ধ করেনি। মিনেসোটায় এখনও গর্ভপাত আইনত স্বীকৃত। গর্ভপাত করাতে যারা সেখানে আসতে চান, তাদের আইনি রক্ষাকবচ দিতে একটি বিশেষ নির্দেশ জারি করেছেন গভর্নর টিম ওয়ালজ। তিনি বলেন, ‘‘জনন-স্বাস্থ্য সংক্রান্ত স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।’’ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিষয়টি বিলক্ষণ নজরে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
গর্ভপাত কেন নারীর অধিকার হওয়া উচিত?
গর্ভপাতের আইন নিয়ে আমেরিকায় বেশ কিছু বছর ধরেই চলছে নানা কথা। এ বার সে দেশের শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছে, গর্ভপাত আর সাংবিধানিক অধিকার নয়। দেশের যে কোনও স্টেট এ নিয়ে নিজের মতো আইন তৈরি করতেই পারে। ঠিক যেমন আফগানিস্তান, ভ্যাটিকান সিটি, পোল্যান্ড, কঙ্গো, মিশরের মতো দেশে গর্ভপাত বিরোধী আইন রয়েছে, এ বার সেখানেও তেমন ঘটতে পারে বলে আতঙ্কিত অনেকেই। শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে আন্দোলন।
নাগরিকদের একাংশের ভয়, গর্ভপাত নিষিদ্ধ হতে পারে একাধিক স্টেটে। তা অপরাধ হিসাবেও বিবেচিত হতে পারে কোথাও কোথাও। আর সে কথাই কপালে ভাঁজ ফেলছে এ দেশেও। কারণ গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়া মানে মেয়েদের নিজের শরীরের উপর অধিকার কমে যাওয়াও বটে। নিজের ইচ্ছায় সে সন্তান রাখবে কি না, তা আর তার সিদ্ধান্ত থাকে না। পরিবারেরও থাকে না। চলে যায় সোজা রাষ্ট্রের হাতে। যে ব্যবস্থার চোখে এক নাগরিক (তিনি নারী হোন বা পুরুষ) শুধুই একটি পরিচয়পত্রের নম্বরের দ্বারা চিহ্নিত, তার পক্ষে শরীরের ভালমন্দ কী করে বোঝা সম্ভব, এ প্রশ্নই উঠছে দিকে দিকে।
কোনও ক্ষমতাবান দেশে বড় বদল এলে, তার প্রভাব পড়ে আশপাশেও। আমেরিকার গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন আগামী দিনে আরও কোনও দেশের আইনি ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণ হয়ে উঠবে না তো, এটিই মূল চিন্তা এ দেশের নাগরিকদের। মূলত বিষয়টি যখন গর্ভপাত, তখন তা চিন্তা বাড়ায়। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেয়েদের শারীরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুরক্ষার প্রসঙ্গ।
এমনিতেই সমাজের নানা স্তরে নারীর ইচ্ছায় গর্ভপাত নিয়ে ছুঁৎমার্গ রয়েছে। এমনকি, সঙ্গমের সময়ে নিরোধ ব্যবহার সম্পর্কেও আছে নানা ধরনের মতামত। তার মধ্যে একটি আইন এক ধাক্কায় বছর পঞ্চাশ পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তথাকথিত প্রগতিশীল একটি দেশকে। তার প্রভাব যদি পড়ে অন্য দেশের জনতার চিন্তাধারায়, তবে তা আতঙ্কের বিষয় হবে বলেই মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী থেকে মনোবিদ, নানা জনেই।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন মনে করেন, নারী শরীরের উপর নারীর অধিকার শেষ কথা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘‘কী কারণে তিনি গর্ভপাত করাবেন, সে একেবারেই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার। এই সিদ্ধান্তকে যখন আমরা রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিচ্ছি, তখন তাতে নানা রকম চোখরাঙানির এবং নৈতিক নিষেদ্ধজ্ঞার প্রবণতা চলে আসে। সেখানে আবারও নারীর অধিকার খর্ব হয়।’’ মনোবিদ মনে করান, এখনও দেখা যায় কন্যাসন্তানের ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে যখন-তখন। তাতে কোনও সমস্যা থাকে না। এ দিকে, যদি কোনও নারী নিজে মনে করেন যে, তিনি একটি সন্তানকে আনতে চাইছেন না, সেখানে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকবে না! এমন কি হওয়া কাম্য, প্রশ্ন অনুত্তমার। এই দ্বিচারিতাই কিন্তু ভাবার বিষয় বলে মত মনোবিদের।
অনুত্তমার বক্তব্য, গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত এক জন নারীর নিজস্ব। একমাত্র তাঁর চিকিৎসক এই নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনায় যেতে পারেন। যদি স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকে, সেই নিয়ে আলোচনা সম্ভব। কিন্তু এ নিয়ে রাষ্ট্রের মতামতের কোনও জায়গাই নেই।
নারী আন্দোলনকর্মী দোলন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমেরিকায় যা হল, তাকে সম্পূর্ণ রাষ্টের দ্বারা নারী শরীরের উপর জুলুম বলা চলে। এটি প্রগতিশীল চিন্তার বিপরীত একটি রায়। কোনও নারী মা হবেন, না কি হবেন না, তা একেবারেই তার সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ নিয়ে অন্য কোনও মত চলতে পারে না।’’
বিভিন্ন কারণে গর্ভপাত করানোর প্রয়োজনও পড়ে মেয়েদের। কিশোর বয়সে গর্ভধারণ বাড়ছে দুনিয়া জুড়ে। ধর্ষণের জেরে গর্ভধারণও কম হয় না। এ ছাড়াও রয়েছে অসুস্থতা, অর্থনৈতিক সঙ্কট। এ সব সমস্যা উপেক্ষা করে যদি রাষ্ট্র আইন চাপায় গর্ভপাত না করানোর, তবে তা অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলেও মত দোলনের। বহু ক্ষেত্রে গর্ভপাত করাতে না পারার কারণে মেয়েদের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে এর আগে। সে কথা মনে রাখা জরুরি বলেই মনে করেন তিনি। দোলনের মত, ‘‘এ তো যেন শরীরের উপর রাষ্ট্রের বুলডোজার চালানোর সিদ্ধান্ত হচ্ছে!’’
নারীর শরীরের উপর তার অধিকার কায়েম করতে না দেওয়ার আসলে কোনও ভৌগলিক সীমা থাকে না বলে মনে করেন অনুত্তমা। কোথাও তা আইনি ভাবে কায়েম হয়, কোথাও বা তা পরোক্ষ ভাবে সমাজের কোণে চুপচাপ বাড়তে থাকে। এমনই মত তার। অনুত্তমা বলেন, ‘‘আমেরিকার মতো একটি দেশ যদি এমন পিতৃতান্ত্রিক এবং পশ্চাৎমুখী আইন আনে, তবে উদ্বেগও তৈরি হয়। আরও কোনও দেশ আবার সে পথে হাঁটবে না তো!’’
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২৩
আপনার মতামত জানানঃ