
অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়েছেন এক আফগান বন্দী। তিনি বিনা বিচারে ১৫ বছর গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দী ছিলেন। আফগানিস্তানের তালিবান সরকার এবং একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এসব কথা জানিয়েছে। খবর আল-জাজিরার।
আসাদুল্লাহ হারুন গুলের মুক্তির বিষয়টি গতকাল শুক্রবার ঘোষণা দেন তালিবান সরকারের সংস্কৃতি ও তথ্যবিষয়ক উপমন্ত্রী জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ। তিনি জানান, গুয়ানতানামো বে কারাগারে শেষ দুই আফগান বন্দীর একজন গুল।
কাতারে অবস্থানরত জ্যেষ্ঠ তালিবান কর্মকর্তা সুহাইল শাহিন বলেন, শিগগিরই কাবুলের উদ্দেশ রওনা হবেন গুল। ২০০৭ সালে জালালাবাদ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে মার্কিন বাহিনী। বিনা বিচারে তাকে ১৫ বছর আটক রাখা হয়েছিল।
মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গুলকে তালিবানের হাতে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান মুজাহিদ। তিনি টুইটারে বলেন, ‘গুয়ানতানামো কারাগারে থাকা দুই বন্দীর একজন আসাদুল্লাহ হারুন মুক্তি পেয়েছেন। আফগান সরকারের প্রচেষ্টা ও নির্দেশনায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক যোগাযোগের ফলে তিনি মুক্তি পান।’
যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার সংগঠন ‘রিপ্রিভ’ জানিয়েছে, গুলকে ২০০৭ সালে গুয়ানতানামো বে কারাগারে পাঠানো হয়। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অনেক বছর ধরে তার পরিবার আশঙ্কা করছিল, তিনি মারা গেছেন।
বন্দী থাকার প্রথম ৯ বছর তিনি কোনো আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। যদিও আইনি প্রতিনিধিত্ব পেতে একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছিল।’
‘রিপ্রিভ’ এবং আইনি সংস্থা ‘লুইস বাচ কাউফম্যান মিডলমিস’ ২০১৬ সালে গুলের পক্ষে একটি পিটিশন দাখিল করে এবং ‘তার মুক্তি দাবি করে’। কয়েক বছরের আইনি প্রক্রিয়ার পর ২০২১ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটনের একটি আদালত রায়ে বলেন, গুল আল-কায়েদার কেউ নন। পাশাপাশি তাকে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দেন আদালত।
বন্দী থাকার প্রথম ৯ বছর তিনি কোনো আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। যদিও আইনি প্রতিনিধিত্ব পেতে একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছিল।’
গুয়ানতানামো বে কারাগার। ‘নাইন-ইলেভেন’ হামলার পর দুই দশক আগে ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি কিউবায় কারাগারটি চালু করে যুক্তরাষ্ট্র। কথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’র নামে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বিভিন্ন দেশে যে সামরিক অভিযান শুরু করে, সেখানে গ্রেপ্তার লোকদের এই কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা বলেন, কোনো ধরনের প্রচলিত আইন-বিচারের মুখোমুখি না করেই বিদেশি ‘যুদ্ধবন্দিদের’ এই কুখ্যাত কারাগারে বছরের পর বছর রেখে দেয় মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উড়োজাহাজ ছিনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আল-কায়েদার সন্ত্রাসীদের হামলার প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত এ কারাগারে বন্দি হয়েছেন অন্তত ৭৮০ জন। এই তালিকায় এক বাংলাদেশির নামও দেখা গেছে। তবে তিনি এখনো বন্দী নাকি মুক্তি পেয়েছেন, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। কিছু বন্দির মৃত্যু এবং বিপুল সংখ্যক বন্দিকে অন্যত্র স্থানান্তরের পর এখন এই কারাগারে বন্দি আছেন ৩৯ জন।
বলা হয়, আমেরিকান আইন-কানুন এবং মানবাধিকারের ধারাগুলোকে ফাঁকি দিতে স্বদেশভূমির বাইরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার গুয়ানতানামো বে প্রদেশের সামরিক ঘাঁটিতে এই কারাগারটি স্থাপন করা হয়। ১৯০৩ সালের হাভানা চুক্তির আওতায় কিউবা থেকে ইজারা নিয়ে ওই দ্বীপ এলাকায় মার্কিন এই সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছিল।
কারাগারটি চালুর পর দ্রুত এর কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন সময় খাঁচার ভেতর জখম, বেড়ি ও হাতকড়া পরা বন্দিদের ছবি প্রকাশ হতে থাকে। এতে সমালোচনায় বিদ্ধ হতে থাকে মার্কিন প্রশাসন। এই কারাগারকে ‘ঘৃণার প্রতীক’ হিসেবে দেখে বিশ্বের অধিকারবাদী মানুষ।
বিশ্লেষকরা বলেন, দ্বীপপুঞ্জের সোভিয়েত ইউনিয়নের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে সে দেশের ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক বন্দীদের যেভাবে নির্যাতন করা হতো বন্দীদের, গুয়ানতামো বে কারাগারে যাদের আটকে রাখা হয়েছিল এবং যারা গত ২০ বছর ধরে আজ পর্যন্ত বন্দী জীবনযাপন করছে, তাদের রাজনৈতিক মত যাই হোক না কেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ নয়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তার ক্ষতি করেছে বা করবে এমন লোক যে দেশেরই হোক না কেন তাদের ধরে এনে আটকে রেখে বিচার করছে। বন্দীদের ওপর মার্কিনি বাহিনীর চরম অত্যাচার, নির্যাতন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন রোমহর্ষক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি, পড়েছি এবং তা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
চরমতম অন্যায়ই কেবল নয়, যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তির জোরে অন্য দেশের ভেতরে ঢুকে কোনো সন্ত্রাসী বা সাধারণ একজনকে ধরে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটা করছে। তাদের গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দী করে রেখে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করেছে।
এএসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৪২
আপনার মতামত জানানঃ