
ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে বাংলা একাডেমি একুশের বইমেলা অনলাইনে করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হল। অনলাইনে না হয়ে আগের মতোই এবারের অমর একুশের গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল সমিতির নেতারা৷ রবিবার (১৩ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে এ তথ্য জানান তারা৷
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশে ২০২১ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্থগিত করার যে সিদ্ধান্ত বাংলা একাডেমি নিয়েছে তার কড়া সমালোচনা করছিলো লেখক, প্রকাশক ও এক্টিভিস্টরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন এক্টিভিস্টরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন, বাংলাদেশে শপিং-মল, পর্যটন, কলকারখানা এবং গণ-পরিবহন সহ সবই যেহেতু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে, সেক্ষেত্রে কেন বই মেলা বন্ধ রাখা হবে?
এ সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক্টিভিস্ট রাখাল রাহা বলেন, “ভার্চুয়াল বইমেলা কোনো বইমেলাই নয়। সরকারের সমস্যা করোনা নয়। ঢাকার রাস্তায় যে কেউ, যে কোনোদিন হাঁটলেই বুঝবেন এখানে করোনার কোনো প্রভাব নেই। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা বই, লেখালেখি, শিক্ষার্থী এবং বইমেলার সূত্রে জমায়েতের ভয়। ভয় তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন!”
এক্টিভিস্ট রাখাল রাহা অন্য একটি লেখায় বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা এই দেশের মানুষ গড়ে তুলেছে, কোনো সরকার বা রাষ্ট্র নয়। মানুষ গড়ে তোলার পর সরকার তার উপর খবরদারী ও কর্তৃত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে এবং অনেক বছর ধরেই তারা আছে। সেটাও একভাবে মানিয়ে গেছে এবং সেটা তারা থাকুন। কিন্তু এটাকে নিয়ে নয়-ছয় ভাবনা পরিত্যাগ করুন। আমাদের বইমেলা পৃথিবীর মধ্যে অনন্য। এমন মেলার চরিত্র আর কোনো দেশের নেই। এটাকে মূল্যবান না করতে পারলেও ধ্বংস করার অধিকার সরকার বা রাষ্ট্রের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই।
ইউসুফ আলী নামের একজন এক্টিভিস্ট ফেসবুকে মন্তব্য করে বলেন, বই পড়লে মানুষের বোধশক্তি জাগবে, তারা অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। সরকার চায়না মানুষ বই পড়ে সচেতন হোক। তাই মনে হয় বইমেলা বন্ধ করার আয়োজন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির অন্যতম পরিচালক ড. জালাল আহমেদ বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি’কে বলছেন, বইমেলা আয়োজনের জন্য তারা আরো আগে থেকেই প্রস্তুত নেয়া শুরু করেছিলেন। তাদের আশা ছিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির হয়তো উন্নতি হবে। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বাংলা একাডেমি ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা বাদ দিয়ে অনলাইনে করার প্রস্তাব সম্পর্কে রোদেল প্রকাশনীর প্রকাশক রিয়াজ খান স্টেটওয়াচকে বলেন, অনলাইন মেলা আমরা সারাবছরই করে থাকি রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন বুকশপের মাধ্যমে। বাংলা একাডেমি অনলাইন মেলায় প্রকাশকদের প্রত্যাশার বিন্দুমাত্র ধারের কাছে যেতে পারবে না বলে আমি মনেকরি।
এ সম্পর্কে স্টেটওয়াচকে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান বলেন, “শুনতে পাচ্ছি বইমেলা ভার্চুয়ালী হবে। ভার্চুয়াল বই মেলার ধরনটা কেমন হবে আমার কাছে এখনও ষ্পষ্ট না। ভার্চুয়াল মেলায় নিঃসন্দেহে প্রচলিত মেলার প্রান থাকবে না। আমরা যে অভুতপূর্ব মহামারী পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তাতে প্রচলিত ধারায় মেলা করা সম্ভব না উচিৎও না। তবে আমি মনে করি সীমিত পরিসরে, স্বাস্খ্য বিধির বিশেষ ব্যাবস্থা করে, রেজিষ্ট্রেশনের মাধ্যমে মেলার অংশগ্রহন সীমিত করে, ষ্টল বিন্যাসে সতর্কতা অবলম্বন করে এমনকি মেলার ভেতর গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রন করে সরাসরি উপস্থিতিতে মেলাটা হয়তো করা যেত। মেলা ফ্রেব্রুয়ারীতে না হয়ে মার্চে হতে পারতো, এক মাস না হয়ে স্বল্প সময়ে জন্য হতে পারতো। বাংলাদেশের জীবনযাপনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তো বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে ন। তবে বিশেষ মনিটরিং এর মাধ্যমে এই ধরনের বই মেলা আয়োজনের মতো অর্থ এবং লোকবল বাংলা একাডেমীর আছে কিনা সেটা ভাববার ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত যদি ভার্চুয়াল বই মেলারই সিদ্ধান্ত হয় তবে এই কোভিড ১৯ এর সুবাদে জীবনের বহু নতুন অভিজ্ঞতা যেমন হলো মানুষের তেমন একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।”

ইতোমধ্যে, করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে এক্টিভিস্ট ও লেখকরা ভার্চুয়ালী বইমেলা না করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেছিলো। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দু’টি প্রস্তাব হচ্ছে- ১. ১৫ টাকা টিকিটের ব্যবস্থা করা এবং টিকিটের মূল্যের সমপরিমাণ টাকার একটা মাস্ক ও হাফ লিটার পানি দেওয়া। এতে শুধুই ঘুরতে আসা মানুষ কমে যাবে এবং ক্রেতা-দর্শকও ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন। ২. মেলা ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত করা এবং সময় সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত করা। এতে করোনা প্রকোপ কমে আসবে এবং সন্ধ্যার ভিড়ও ততোটা থাকবে না।
এদিকে কেউ কেউ অনলাইনে প্রস্তাবিত প্রবেশ মূল্যের বিষয়ে আপত্তি তুলে বলেন, মেলায় প্রবেশের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির মানার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। আমাদের প্রাণের বইমেলায় মূল্য দিয়ে আমরা প্রবেশ করব কেন?
অবশেষে লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদের মুখে বাংলা একাডেমি পিছু হটলো। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, বাইরে একটি কথা শোনা যাচ্ছিল, অমর একুশে বইমেলা ভার্চুয়ালি হবে। এ নিয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। আলোচনা শেষে আমরা একটা সিদ্ধান্ত এসেছি, অমর একুশে বইমেলা চিরাচরিতভাবে যেভাবে হয়, এ বছরও সেভাবেই হবে। তবে তারিখের কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। একটি তারিখ নির্ধারণ করে বইমেলার আয়োজন কীভাবে করা যায় সেরকম একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে আমরা বাংলা একাডেমিকে দেবো। বাংলা একাডেমি সেই প্রস্তাবনা সরকারকে দেবে। সরকার অনুমতি দিলে ফেব্রুয়ারি মাসের যেকোনও তারিখ থেকে বইমেলা শুরু হবে।
বৈঠক শেষে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী সাংবাদিকদের বলেন, ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আজ পর্যন্ত নানারকম বিভ্রান্তির মধ্যে আমরা যাচ্ছি৷ বিশেষভাবে নানাভাবে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে হোক, বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে হোক বা প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে হোক, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা তথ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আজকে প্রকাশক সমিতির নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় আমি উত্থাপন করেছি যে, বইমেলা কখনও বাতিল করা হয়নি, স্থগিত করা হয়েছে। তাদের দাবি ছিল, ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলাটি শুরু করা যায় কিনা। আমি তাদের বলেছি, কখন থেকে ফেব্রুয়ারির বইমেলা শুরু করা যায় সে বিষয়ে আমাকে লিখিতভাবে জানান। তবে বাংলা একাডেমিকে বইমেলাআয়োজনের জন্য অবশ্যই দুই মাসের সময় দিতে হবে। তিনি আরও বলেন সবকিছু নির্ভর করবে কোভিড পরিস্থিতির উপরে, রাষ্ট্রের বিবেচনার উপরে এবং সর্বোপরি মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উপর৷
এসডব্লিউ/নসদ/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ