ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ
পদ্মা সেতু নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের উদযাপনকে আমি ভাল চোখেই দেখছি। আমাদের জাতীয় জীবনে ‘আসল’ অর্জন কম, নকলের পিছনে আমাদের অহেতুক ছোটার প্রবণতা বড্ড বেশি। অহেতুক বিষয়ের ক্যাচাল বাদ দিয়ে এধরনের বহু ‘উন্নয়ন উদযাপন’ই বরং বেশি হোক। পাশাপাশি আমি চাই কিছু আত্ম সমালোচনাও হোক।
আমাদের মনে রাখতে হবে দুই যুগেরও বেশি সময় নিয়ে বাংলাদেশে ছয় ছয়টি সরকার এই একটা মাত্র ৬ কিমি সেতু নিয়ে কাজ করেছে। এমটা একটা দেশের সক্ষমতাকে প্রশ্ন করে!
১৯৯৮ সালে প্রাক নির্মাণ সমীক্ষা শুরু হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ হিসেবে ষষ্ঠ মেয়াদের সরকার সেতুটি নিয়ে কাজ করছে! বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার জাইকার সহায়তায় পদ্মা সেতু নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি এবং স্থান নির্বাচনের সমীক্ষা ভিত্তিক সামান্য কিছু কাজ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে পদ্মা সেতুর খরচ সমীক্ষা করে এবং অর্থায়নের মডেল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যায়। মহাজোট সরকার সেতুটির নির্মাণে অগ্রাধিকার ও গুরুত্বারোপ করে, কিন্তু শুরুতেই দুর্নীতির অপতৎপরতার অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অতি সহজ সুদের অর্থায়ন থেকে সরে গেলে প্রকল্পে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দ্বিতীয় ভিত্তিপ্রস্তরের পরেও কেটেছে প্রায় ১৩ বছর!
আর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পরে ২১ বছর কেটে গেলেও বাংলাদেশের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের সরকার সেতুটি উদ্বোধন করতে সময় পার করেছে। বাংলাদেশের মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতায় পড়ছে, দুর্নীতি, বর্ধিত খরচের লাগামহীন অনিশ্চয়তায় ভুগছে এবং একইসঙ্গে কাজের মান প্রশ্নযুক্ত থাকছে। পদ্মা সেতুর নকশায় বেশ কিছু ভুল ছিল, নদী শাসনেও কাজের মান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এটা এক অবধারিত চক্র যা থেকে বাংলাদেশ বেরুতে পারছে না। আমরা মাঝারি এবং বৃহৎ প্রকল্পের ইকনোমিক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনপুট তৈরিতে এখনও যোগ্য হয়ে উঠিনি। এই আত্ম সমালোচনা গুলো খুব দরকার।
আমাদের অপরাপর মেগাপ্রকল্পগুলোর কোনোটাই ঋণের গ্রেস-পিরিয়ড শেষ হওয়ার আগে আলোর মুখ দেখছে না। বাংলাদেশের সামগ্রিক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতার ইতিহাসে এই দীর্ঘসূত্রীতার ধারা একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আধুনিক নির্মাণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। পদ্মার উপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ (১৯০৯-১৫), নদীমাতৃক বাংলাদেশ বদ্বীপে রেলপথ নির্মান, ভৈরব-আশুগঞ্জ মেঘনা রেল সেতু (১৯৩৭), কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, তিস্তা ব্যারেজ, গোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শাহজালাল ও যমুনা সার কারখানা, ইস্টার্ন রিফাইনারি, চট্রগ্রাম বন্দর, যমুনা সেতু, রুপসা সেতু, ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটোয়ার্ক নির্মাণ ইত্যাদি এক একটি বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান সময়ের মেগা প্রকল্প। এমনকি আশির দশকের শেষে ও নব্বই দশকের শুরুতে নির্মিত ভৈরব-মেঘনা-গোমতি সেতু গুলাও সেই আমলের বিবেচনায় মেগা প্রকল্প ছিল। রুপপুর পারমাণবিক প্রকল্প নির্ময়মান মেগা প্রকল্প।
এক একটি মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের প্রকৌশল অঙ্গনে পালক যুক্ত হয় ও মেগা প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা অর্জিত হয়। নলেজ ট্র্যান্সফার হয়। এখনও বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের মত সক্ষমতা অর্জিত হতে বাকি আছি। অফশোরে তেল গ্যাস উত্তোলনে এখনও ভারত-চীন-মার্কিন-রাশানদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। দেশে বিদ্যুতের স্মার্ট গ্রীড করতে বাকি আছে, নবায়ন যোগ্য জ্বালনীর সমন্বিত মাষ্টার প্ল্যান, উত্তর-দক্ষিণের একমুখী সড়ক-রেলের পাশাপাশি দেশের পূর্ব-পশ্চিমে সড়ক ও রেল অবকাঠামো তৈরি, নদী ভাঙন রোধ, সহ নদী শাসন ও উপকূলীয় আরো বহু অবকাঠামো বাস্তবায়ন হতে বাকি আছে। যে কোন সামরিক অর্জনের বিষয় বাদই দিলাম। যদিও পৃথিবীর বহু দেশে সামরিক অর্জনকে, জীবন মানের উন্নয়নকেই অন্য সব অবাকাঠামো অর্জনের উপরে রাখা হয়।
বহু সময়, বহু বিতর্ক এবং বহু খরচের পরে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। এই জন্য শেখ হাসিনা বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। এটা সেতুটি করতে তাঁর পলিটিক্যাল উইলের স্মারক। তবে সাথে সাথে একটি সেতু করতে ২১ বছর লাগিয়ে ফেলার অদক্ষতার দায় ও তা থেকে শিক্ষাও তাঁকে এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিতে হবে। এই দীর্ঘসূত্রীতার পুনরাবৃত্তি যাতে অন্য কোন প্রকল্পে না হয়।
বাংলাদেশের মেগা প্রকল্প নির্মাণ কারিগরি প্রকৌশল, নকশা ও বাস্তবায়ব ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে মূলত বিদেশ নির্ভর। এটাই মূল সক্ষমতার যায়গা। অন্যান্য দেশের তুলনায় মেগা প্রকল্প কম বা বেশি যাই থাকুক না কেন, নকশা তৈরি, প্রকৌশল সক্ষমতা ও কারিগরি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা না আসা পর্যন্ত তৃপ্তির সুযোগ নেই। আজকে আমরা আমদের প্রকল্প গুলোতে শুধু কিছু ইঞ্জিনারিং ইনপুট যুগিয়ে দিচ্ছি, বহু ক্ষেত্রে তাও পারছি না, বিদেশীরাই এসে ইনপুট ঠিক করে দেয়, বিদ্যুতের মাষ্টারপ্ল্যান করে দেয় এবং সেতুর নকশা করে দেয়। আর মূল নির্মাণ কাজ তো বিদেশীরাই এসে করে! এই দিক গুলো ৫০ বছর বয়সী দেশের ভাবতে হবে।
অপরাপর মেগা প্রকল্পের মত পদ্মা সেতুতেও দেশীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদের অংশগ্রহন ‘দেখুন শুনুন’এর বাইরে খুব বেশি আগাতে পারেনি। সেতুটি মূলত একটা চাইনিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ইমপ্লিমেন্টেশান শো। বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ (মূলত তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিক ও প্রাবসীদের রেমিটেন্স নির্ভর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ) থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে (নকশায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ঋণ আছে), তবে এখানে নকশা (AECOM), কন্সট্রাকশান (চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং) ও নদী শাসন (সিনোহাইড্রো করপোরেশন) ঠিকাদার সবাই বাইরের। স্টীল ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ সরবারহের ঠিকাদার সহ। তাই আমাদেরকে নকশা তৈরি, ইঞ্জিনিয়ারিং ইমপ্লিমেন্টেশানেও সক্ষমতা অর্জনের কথা ভাবতে হবে। কারণ আমরা যে ৫০ বছর পূর্ণ করে ফেলেছি স্বাধীনতার! এখন না পারলে আর কবে?
বাংলাদেশে রাস্তা, সেতু বা ব্রিজ, রাস্তার কার্পেটিং হচ্ছে উন্নয়ন। মান সম্পন্ন কর্মসংস্থান, ধনী গরিবের সার্বজনীন পেনশন, সবার জন্য স্বাস্থ্য, বেকার ভাতা কিংবা সবার জন্য নিরাপত্তা, কর্ম সুরক্ষা এখনও ‘উন্নয়ন দর্শন’ বলে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়নি।
একশ পাঁচ বছর আগে পদ্মার উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজে করে গেছে ব্রিটিশরা এবং ১৯৩৭ সালে মেঘনার ভৈরব রেলসেতুতেও করেছে ব্রিটিশরা। মিহি কাঁদা পলির স্তর থাকা নদীর উপরে পিলার ব্রিজ করতে গিয়ে অনেক বেশি কারিগরি চ্যালেঞ্জ ও ত্রুটিতে পড়েছে সেতুটি, মাটির গুনাগুন মিলেনি, ভূমির গভীরে কাদার স্তরের জন্য নকশা সংশোধন করতে হয়েছে কয়েকবার। প্রাথমিক নকশায় বড় ধরনের ভুল থাকায় নির্মাণে বিলম্ব হয়েছে। প্রতিটি পিলারে টেস্ট পাইল না করার খামখেয়ালী ছিল অমার্জনীয়। এক মূখী রেলের কারণে সম্ভবত পদ্মায় দ্রুতই হয়ত আরেকটি রেল সেতু নির্মান করতে হবে বাংলাদেশকে। অতি উদযাপনের পাশাপাশি এসব থেকে বাংলাদেশের প্রকৌশলী স্থপতি রাজনৈতিক ব্যবস্থাপকদের শিক্ষা নিতে হবে।
বহু সময়, বহু বিতর্ক এবং বহু খরচের পরে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। এই জন্য শেখ হাসিনা বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। এটা সেতুটি করতে তাঁর পলিটিক্যাল উইলের স্মারক। তবে সাথে সাথে একটি সেতু করতে ২১ বছর লাগিয়ে ফেলার অদক্ষতার দায় ও তা থেকে শিক্ষাও তাঁকে এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিতে হবে। এই দীর্ঘসূত্রীতার পুনরাবৃত্তি যাতে অন্য কোন প্রকল্পে না হয়।
‘পদ্মা সেতু’ পদ্মা নদীর দু-তীরকে সংযোগকারী প্রথম সেতু নয়, শেষ সেতুও হবে না। আমাদেরকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় আরেকটি ২য় পদ্মা সেতু করতে হবে। ভারত পদ্মা নদীর উপর ফারাক্কা সহ বহু সড়ক ও রেল সেতু করেছে কয়েক দশক আগেই। বাংলাদেশের ব্রিটিশ প্রশাসন (ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের )পদ্মার উপর মেগা প্রকল্প হার্ডিঞ্জ ব্রিজ করেছে এক শতাব্দীরও আগে। দেশের প্রথম দিকের মেগা প্রকল্প হিসেবে (১৯০৯-১৯১৫)। ফলে আজকে মেগা প্রকল্পের নকশা, ইঞ্জিনিয়ারিং ইমপ্লিমেন্টেশান সক্ষমতা আনার উপলব্দি তৈরি করা দরকার।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের গর্ব হলেও মনে রাখতে হবে এটা ‘চাইনিজ ইঞ্জিনিয়ারিং’ শো। পদ্মা সেতু দিয়ে চীন বাংলাদেশ তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় তার কারিগরি সক্ষমতা ও প্রভাবের ফুটপ্রিন্টকে অত্যন্ত শক্ত করে দিল।
তাই বিদেশী ‘ইঞ্জিনিয়ারিং শো’ কে প্রকৃত ‘দেশীয় ইঞ্জিনিয়ারিং শো’ দিয়ে রিপ্লেইস করা গেলেই আসবে বাংলাদেশের আসল গৌরব। স্বাধীনতার ৫১ তম বর্ষে সেই সক্ষমতা না আসলেও অন্তত এই উপলব্দি আসুক।
আপনার মতামত জানানঃ