ফাইজ. তাইয়েব আহমেদ
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নাইজেরিয়া তার প্রায় সকল রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। বিদেশে নাইজেরিয়ার কূটনৈতিক মিশনগুলো থেকে বিশ্বমানের সেবা প্রদান নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা দেয়া হলেও পেছনের কারণ রাষ্ট্রদূত সহ কূটনৈতিক মিশনগুলোর অব্যাহত দুর্নীতি, বাণিজ্য এবং হয়রানি।
কয়েক বছর আগে আমি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস গুলোর সেবা কেমন তা জানতে বেশকিছু প্রবাসীর সাথে আলাপ করেছি। কিছু ক্ষেত্রে খুবই বাজে ফিডব্যাক পেয়েছি। আমার মনে হয়েছে অন্ততপক্ষে চার ধরণের দুর্নীতি অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে দূতাবাস গুলো-
১.
প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়ন, জাতীয় পরিচয় পত্র ভিসা প্রদানে সীমাহীন হয়রানি ও ঘুষের চক্রে জড়িয়ে পড়েছে দূতাবাস গুলো। মধ্যপ্রাচ্যের দূতাবাস গুলোতে প্রবাসী শ্রমিকদের সাথে অসম্মানজনক এবং কখনো খুব বাজে ভাষায় কথা বলা হয়। চাহিবামাত্র প্রবাসীরা দূতাবাসে প্রবেশ করতে পারেন না, ফোনে দূতাবাসের কর্মীদের সঠিক প্রশ্নোত্তর এবং সেবা বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না।
অপেশাদার দিয়ে তৈরী বলে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় পত্রে গন্ডায় গন্ডায় ভুল আছে। অনেক সময় ঘুষের চক্র জারি রাখতে এসব ইচ্ছাকৃত। পাশাপাশি দালালদের ভিসা জালিয়াতি, এনআইডি জালিয়াতির কারণে দূতাবাস কর্মকর্তারাও খুব ঝামেলায় থাকেন. অনাকাঙ্খিত পেশাগত জঞ্জালে পড়েন। তবে এটাকে কাজে লাগিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের মিশনগুলোতে ঘুষ বাণিজ্য চলছে দেদারসে।
২.
অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দিবস পালন, পণ্য প্রদর্শনী, ভিআইপি এমপি-মন্ত্রীর ভ্রমণ কভারসহ বিবিধ অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব, দূতাবাসের অফিস উন্নয়ন ও ইন্টেরিয়রের কাজ জোর করে নিয়ে নেন স্থানীয় প্রবাসী আওয়ামীলীগের লোকেরা। অভিযোগ আছে, প্রবাসী সরকারী দল সংশ্লিষ্টরা দুতাবাসের কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে, গালাগালি করে, ফোনে এটাসেটা করার নির্দেশ দিয়ে দুর্ব্যবহার করা নিত্তনৈমত্তিক ঘটনা। মূলত এসবের কারণ হচ্ছে দুর্নীতি করে দূতাবাসের অর্থ লোপাট করার জন্য দুতাবাসের কর্মকর্তাদের উপর একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করা। আওয়ামীলীগের নেতা-এমপি-মন্ত্রীদের পরিবারের (বেগমপাড়া এফেক্ট) সদস্য, বিদেশে অবস্থানরত ছেলে-মেয়েদের দেখভালে দূতাবাসের উল্লেখ্যযোগ্য শ্রমঘণ্টা ব্যয় হওয়ার অভিযোগ অনেক পুরানো।
দূতাবাস গুলোর চেইন অফ কমান্ড ভেঙে পড়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যনির্দেশ নয় বরং আওয়ামীলীগের বিদেশ শাখার লোকেরা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের পেশাগত নির্দেশ দেন। এতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পেশাদার ও সুনামধারী কর্মকর্তাদের জীবন ও সম্মান বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে বহু দেশে।
৩.
অর্থ পাচার এবং হুন্ডির সংযোগ আছে অনেক কর্মকর্তার সাথে। বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশের প্রবাসীদের আয় দিন দিন কমছে, হুন্ডির চ্যানেলে চলে যাচ্ছে প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের ভিতরে উপার্জিত কালো টাকা দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে হুন্ডির টাকা স্থানীয়ভাবে বরাদ্দ হচ্ছে। যে বৈদেশিক মূদ্রা বৈধ চ্যানেল দেশে আসার কথা ছিল, সেটা ব্যয় হচ্ছে স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালনে, সামান্য কিছু ক্ষেত্রে আমদানিতেও। কিছু ক্ষেত্রে দূতাবাস ও বিমানের কর্মকর্তারা এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
আওয়ামীলীগের বিদেশ শাখার লোকেরা অর্থ পাচারে বড় ভূমিকা রাখে। এরা দেশে থাকা এমপি মন্ত্রী আমলা ও ব্যবসায়ীদের সাথে শক্ত কানেকশান বজায় রাখে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথাপি দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্তা এই চক্রের সাথে কাজ করে। অর্থ পাচারের বাইরেও পাচারের অর্থে এমপি মন্ত্রী আমলা ও ব্যবসায়ীদের জন্য বিদেশে প্রপার্টি কিনে দেয়া তাদের বড় কাজ।
৪.
রাষ্ট্রদূতদের কেউ কেউ বিদেশে বসে টেন্ডার বাণিজ্য করেন। দেশে ছোট মাঝারি কাজ পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য, ঘুষ ও অর্থপাচারে জড়িয়ে গেছেন অনেকেই।
ওয়াশিংটন দিল্লি বেইজিং লন্ডন টোকিও এবং রিয়াদ ছাড়া বাংলাদেশের বাদবাকি দূতাবাস গুলোকে সেভাবে কূটনৈতিক মিশন বলা চলে না। মূলত পাসপোর্ট ও ভিসার কাজ এবং কিছু সাধারণ রাষ্ট্রীয় যোগাযোগই মূল কাজ। বাংলাদেশি দূতাবাস থেকে সারা বছর যেসব মেইল আসে তা প্রায় সবগুলোই দিবস পালন কেন্দ্রিক। বিদেশে বাংলাদেশের ফিউচার এসেট বা সম্পদ তৈরী, কৌশলগত মানব সম্পদ উন্নয়ন, উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা ফ্রেইমওয়ার্ক এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রায় শ’খানেক দূতাবাসের বলার মত কোন কাজ নেই। বাণিজ্য সম্প্রসারণের নামে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের লোকেরা বিদেশে আসেন মূলত ভ্রমণ ও শপিং এ, কেউ বা টাকা পাচারের জন্য। ইদানিং এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে পিআইবি’র ছত্রছায়ায় আওয়ামীলীগ দলীয় সাংবাদিকরাও।
প্রবাসীদের পাসপোর্ট ও ভিসা সেবার বাইরে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো অর্থ অপচয়ের এক একটি ছোটখাট কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ওয়াশিংটন দিল্লি লন্ডনের তিনটি দুতাবাসকে লবিস্টের পেছনে অর্থ অপচয়ের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে যেন! সরকারের সমর্থনে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা, বিদেশী রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী লোক ভাড়া করা এবং স্পনসর দেয়ার জন্য এই তিন দূতাবাসকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেয়া আছে বলে কানাঘুষা চলে সেগুনবাগিচায়। এভাবে দূতাবাস তিনটি পরিণত হয়েছে দুর্নীতি ও দলের পাচারের বড় কেন্দ্রে।
এমতাবস্থায় নাইজেরিয়ার মত প্রায় সকল রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফেরানোর ‘বাল্কি’ উদ্যোগ আশা না করলেও বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোকে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে আনা দরকার হয়ে পড়েছো। বিদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোর সেবামান নিয়ে যেসব প্রশ্ন আছে- পাচার, দুর্নীতি, বাণিজ্য এবং হয়রানির প্রতিটি অভিযোগ আমলে নেয়া প্রয়োজন।
সরকার পররাষ্ট্র সচিব সহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দেশে বিদেশে ব্যস্ত রেখেছে রাতের ভোট গঠিত অবৈধ সরকারের সমর্থন আদায়ের সিরিজ মিটিং এ, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে পাশে সরিয়ে আবারো একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পক্ষে আগাম সমর্থন আদায়ে। অথচ কথা ছিল প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা ব্যস্ত থাকবেন নতুন বাণিজ্য সম্প্রাসরনের দূতিয়ালিতে, নতুন নতুন শ্রমবাজার বিকাশে, শিক্ষা গবেষণা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে, উন্নত বিশ্ব থেকে মেধাস্বত্ব সুবিধা, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন জনিত ছাড় আদায়ে , প্রযুক্তি হস্তান্তরে, প্রতিপক্ষ দেশকে টেক্কা দেয়া কৌশলগত অর্থনৈতিক ফ্রেইমওয়ার্ক তৈরিতে, নতুন রপ্তানি গন্তব্য তৈরিতে, রপ্তানি বহুমুখীকরণে, দক্ষিন এশিয়া সহ আসিয়ান ও আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সাথে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল তৈরিতে, শুল্কমুক্ত সুবিধা আনয়নে, ইউরোপীয় জিএসপি প্লাস, মার্কিন জিএসপি নেগোসিয়েশনেই কাজে, ভারতের সাথে পানি হিস্যা নেগোসিয়েশন, পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষার মত বহুবিধ দূতিয়ালিতে। তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকার এক দশক এবং রোহিঙ্গা সংকটের ৬ বছর অতিবাহিত হলেও প্রত্যাবাসন বিষয়ে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য শূন্য।
নতুন লবিস্ট খোঁজা, আগের নিযুক্ত অকার্যকর লবিস্টের পেছনে ঘুরা এবং আওয়ামীলীগের প্রবাসী শাখার দেখভাল করা প্রজাতন্ত্রের ডিপ্লোম্যাটিক উইং এর প্রধানতম কাজ হতে পারে না!
এসব অযাচিত কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব সম্পদ উন্নয়নে পেশাদারিত্বের ক্ষতি হচ্ছে এবং তাঁরা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কৌশলগত কূটনৈতিক দক্ষতায় পিছিয়ে পড়ছেন। আকসা (অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট), জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট), ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি, আইপিএস, ব্রিকস, রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি), রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, ইউরোপীয় জিএসপি প্লাস, মার্কিন বাজারে অগ্রাধিকারমূলক জিএসপি সুবিধা পূনরুদ্ধার ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৌশলগত নেগোসিয়েশন বাংলাদেশ তথা সেগুনবাগিচা পিছিয়ে পড়ছে। ভারত যেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং, সবুজ বিদ্যুৎ বিনিয়োগ, বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রযুক্তি হস্তান্তর, স্কিল্ড শ্রমবাজার তৈরী, মেধাস্বত্ত্ব সুবিধা গুলো সিকিউর করছে সেখানে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ব্যস্ত রাখা হয়েছে গুম খুন রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক প্রশ্ন, ড মুহাম্মদ ইউনুসের মামলা বিষয়ক আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ডিফেন্ড করতে।
সরকারের নিজের বৈধতার সংকটে প্রলেপ দেয়া, মানবাধিকারের বাজে রেকর্ড ধামাচাপা দেয়ার ডকুমেন্টেশান ও কমিউনিকেশন ম্যাট্রিক্স সাজানো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের কাজ হতে পারে না। এসব অযাচিত কাজে গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স ব্যয় করা রাষ্ট্রীয় সম্পদের নিদারুণ অপচয়, এটা নৈতিকভাবেও অগ্রহণযোগ্য।
আপনার মতামত জানানঃ