ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ
আপনি ১৪ বছরী সরকারকে জিজ্ঞেস করুন তার জ্বালানী কূটনীতি কই? তার পানি কূটনীতি কই? তার জলবায়ু কূটনীতি কই? খাদ্য কূটনীতি কই? আওয়ামীলীগ সরকার কূটনীতি বলতে বুঝে ওয়াশিংটন ডিসি, লন্ডন এবং নয়াদিল্লীতে লবিস্ট আর পিআর ফার্মে টাকা ঢালা।
ইমাজিন! ১৪ বছরের একটা সরকারের ওপেক কান্ট্রি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশ গুলোর সাথে কোন বড় পরিসরের জ্বালানী সরবারহ চুক্তি নাই। কাতারের সাথে একটা মধ্য পর্যায়ের এলএনজি চুক্তি না থাকলে আজকের লোডশেডিং ব্ল্যাক আউট পর্যায়ে থাকত। ভারতের সাথে ৬০ হাজার মেট্রিকটন ডিজেল সরবারহের একটা ছোট চুক্তি আছে। ইউক্রেন আগ্রাসনের পরে রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল না পেলে ভারত নিশ্চিত এই ডিজেল সরবারহ বন্ধ করে দিত, সে নিজেই তখন জ্বালানি সংকটে থাকত। ইউক্রেন যুদ্ধের সুফল ভোগ করছে ভারত ও চায়না, রাশিয়ার সাথে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প করেও বাংলাদেশ রাশিয়ার সস্তা তেলের বেনেফিশিয়ারি নয়, দেশের নেই কোন লার্জ স্কেইল রিফাইনারি বিনিয়োগ!
কিন্তু আপনি দেখবেন আওয়ামীলীগের লোকেরা গর্বে গর্ভবতী যে তাঁদের একজন হার্ভার্ড প্রফেসর গওহর রিজভী আছেন। মাসুদ বিন মোমেন আছেন, আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, আর আছেন শাহরিয়ার সাহেব। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সাহেব। সুবিশাল এক পররাষ্ট্রনীতি বহর।
কিন্তু রেজাল্ট কি? দেশের ৫১ বছরের ইতিহাসে পররাষ্ট্রনীতি সবচেয়ে কালো একটা সময় পার করছে। শেখ হাসিনা ইউরোপ আমেরিকার অর্থাৎ পশ্চিমের কোন দেশের রাষ্ট্রদূতকে, বিদায়ী শুভেচ্ছা দিতে পারছেন না, এমনকি জাতিসংঘের কর্তাদেরও! কেন? মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হবেন বলে! এমনকি মাসুদ বিন মোমেনও গত সপ্তাহে ডাচ দুতকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানাননি। কিভাবে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টের শীর্ষ দশে থাকা দেশ বাংলাদেশের শত্রু হয়ে গেল?
দেশের এলিট ফোর্স ইতিহাসের ১ম বারের মত নিষেধাজ্ঞায় আছে, অথচ বিশ্বের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনারা বহু রক্ত ও জীবন দিয়েছে। গুম ও মানবাধিকার প্রশ্নে সরকারের নিস্ক্রিয়তায় আরও নিষেধাজ্ঞার আয়োজন চলছে। মার্কিন বাজারের জিএসপি সুবিধা ৯ বছরের দেন দরবারেও আসেনি। উল্টো ইউরোপের বাজারের অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা বন্ধের আলাপ হচ্ছে ক্লোজ ডোরে!
আজকে বাংলাদেশের কুয়েত, ইরাক, সৌদি আরব কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর তেল উৎপাদনকারীদের সাথে জ্বালানী সরবারহের স্থায়ী কোন চুক্তি নেই। বাংলাদেশ তেল গ্যাস কিনে সিংগাপুরের স্পট মার্কেট থেকে। স্রেফ দেশি বিদেশী দালালদের স্বার্থে! অথচ জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রাইমারি জ্বালানির ডাইভার্স সোর্স থাকাটা বাধ্যতামূলক বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল উদীয়মান অর্থনীতির জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের ডজন ডজন তেল উৎপাদনকারী দেশ থেকেও বাংলাদেশ তেলের সুফল পাচ্ছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সত্তর দশকে মধ্যপ্রাচ্য সহ তেল উৎপাদনকারী দেশ সমূহের অবরোধের প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন তৎকালীন স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানী তেল প্রাপ্তির দাবী করেন। (বঙ্গবন্ধুর সময়ে আলজিয়ার্সের জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের সাথে অংশগ্রহণ কারী প্রায় প্রতিটা দেশ এমন দাবীর প্রশংসা করেছে)। এমন আহবানের প্রশংসা করেছিল পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলোও। ফলশ্রুতিতে ৮০ ও ৯০ দশকের পুরো সময় বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী একাধিক দেশ থেকে (কুয়েত, ইরাক, সৌদি আরব) থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে তেল পেয়েছে।
কিন্তু আজকে বাংলাদেশের কুয়েত, ইরাক, সৌদি আরব কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর তেল উৎপাদনকারীদের সাথে জ্বালানী সরবারহের স্থায়ী কোন চুক্তি নেই। বাংলাদেশ তেল গ্যাস কিনে সিংগাপুরের স্পট মার্কেট থেকে। স্রেফ দেশি বিদেশী দালালদের স্বার্থে! অথচ জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রাইমারি জ্বালানির ডাইভার্স সোর্স থাকাটা বাধ্যতামূলক বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল উদীয়মান অর্থনীতির জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের ডজন ডজন তেল উৎপাদনকারী দেশ থেকেও বাংলাদেশ তেলের সুফল পাচ্ছে না।
আজকে তেল বলেন, গ্যাস বলেন কিংবা কয়লা বলেন- তিনটা প্রাইমারি জ্বালানির কোনটাতেই বাংলাদেশের বড় পরিসরে স্থায়ী জ্বালানী সরবারহ চুক্রি নেই। এটা কোন কথা! এদিকে বাংলাদেশের সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্র মোট বিদ্যুতের মাত্র ৪%।
আজকে বলা হচ্ছে, বড়পুকুরিয়া সহ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর জন্য দরকারি কয়লার রিজার্ভ নেই। অথচ ভাতৃপ্রতীম ইন্দোনেশিয়ায় কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ গ্রেটের কয়লা, সাশ্রয়ী দামে।বাংলাদেশের সাথে নেই কোন বিধিবদ্ধ সরবারহ চুক্রি।
আজকে স্পট মার্কেটে প্রাইমারি জ্বালানির উচ্চ মূল্যের কারনে ডলার সেইভ করতে ব্যতিব্যস্ত সরকার তেল ও এলএনজি আমদানি করতে পারছে না। সমুদ্রবিজয়ের বাড়াবাড়ি উল্লাস আমরা দেখেছি, কিন্তু দেখেন ৮-১০ বছরেও সরকার বঙ্গোপসাগরের ব্লকে কোন গ্যাস উত্তোলন করতে পারেনি। মিয়ানমার/ভারতের জলসীমা সীমান্ত সংলগ্ন ব্লকে জেলে দস্যুতা থামেনি, চলছে মাদক চোরাচালান। অথচ মিয়ানমার নিজস্ব ব্লকে গ্যাস পেয়েছে, উত্তোলনের কাজও শুরু করছে।
আজকে তেল কেনার ডলার সেইভ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে লোডশেডিং করছে। অথচ বসিয়ে বসিয়ে সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ডলারেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে। এই এক অতি উর্বর গোবর মস্তিস্ক উদ্ভূত কূটনীতির ফলাফল।
সরকারকে বলি, রাতের ভোটের ক্ষমতাকে রাষ্ট্রের স্বার্থ্য বিসর্জন করা প্রকাশ্য ও গোপন চুক্তির বিনিময়ে জায়েজ করাকে কূটনৈতিক সাফল্য বলে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কুটনৈতিক সাফল্যের কয়েকটি সূচক হতে পারে-
- ১) সংকট কালে আপনার জ্বালানি নিশ্চয়তা আছে কিনা?
- ২) উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা সম্পর্ক, মেধাস্বত্ব ব্যবহার এবং টেকনোলোজি ট্রান্সফারের উইন্ডো আছে কিনা?
- ৩) শুকনো মৌসুমে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীতে পানি প্রবাহ সচল আছে কিনা।
- ৪) বৈশ্বিক সরবারহ সংকটে খাদ্য আমদানির নিশ্চয়তা আছে কিনা।
- ৫) বৈশ্বিক সরবারহ সংকটে নূন্যতম শিল্প কাঁচামালের নিশ্চয়তা আছে কিনা!
- ৬) বিদেশী শরনার্থী ফেরত যাচ্ছে কিনা!
- ৭) সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে কারিগরি লেনদেন হচ্ছে কিনা!
সংকটে পড়ার পরে গিয়ে ভারত, রাশিয়া থেকে তেল ও গম আমদানির জন্য দৌড়ঝাঁপ করাকে কূটনীতি বলে না। এগুলা সময় থাকতে চিন্তা করা লাগে।
শুধু ২০২৩ এ আরেক দফা ভোট চুরির আয়োজনকে কেন্দ্র করে দেশের পররাষ্ট্রনীতি সাজালে, ক্ষমতামূখী কূটনীতি করলে, ডিসি, লন্ডন এবং নয়াদিল্লীতে লবিস্ট/পিআর ফার্মে টাকা ঢালালে সংকটে তেল, গম, কাঁচামাল আসবে না। সবুজ বিদ্যুৎ টেকনোলোজি আসবে না। গওহর রিজভী সাহেবদের সংকটে পারফর্ম করতে হবে; তেল, গম, কাঁচামাল, টিকা ও টেকনোলোজি এনে, রোহিঙ্গা ফেরতে সাফল্য দেখিয়ে। এইসব ডোমেইনে উনারা সম্মিলিতভাবে সুবিশাল অশ্বডিম্ব প্রসব করেছেন।
সরকারকে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, পানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু নিরাপত্তা, কারিগরি নিরাপত্তাসহ সামরিক নিরাপত্তার ‘আসল’ কূটনীতি করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটচুরির ধান্ধায় থাকা জবাবদিহিহীন সরকারের লোকেদের সেই মেধা থাকে কিনা?
আপনার মতামত জানানঃ