
সম্প্রতি উপসাগরীয় অঞ্চলের লোকজন ওপরমুখ তাকালেই দেখছেন কমলা রঙের আকাশ। যেন আকাশ ভেঙে মহাপ্রলয় নেমে আসছে। একের পর এক বালু ও ধূলিঝড়ের দমকা এসে অঞ্চলটিকে পর্যুদস্ত করে তুলছে।
বাঁধ নির্মাণ, বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ, পানি অব্যবস্থাপনা, অতি শুষ্কতা, মরুকরণসহ বিভিন্ন ধরনের ঘটনা মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে আবির্ভাব হচ্ছে। জলবায়ুসংক্রান্ত ঘটনায় ১৬ মে কুয়েতের তিনটি বন্দরে—দোহা, শোয়াইবা ও শুয়াইখ—নৌ-অভিযান বাতিল করতে হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ সংকট ও সংঘাত নেমে আসছে মধ্যপ্রাচ্যে। বালু ও ধূলিঝড় আঘাত হেনেছে রিয়াদসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন অংশে।
ইরাকের হাজারো মানুষ হাসপাতালের জরুরি কক্ষে গিয়ে ভিড় করছে। তাদের অভিযোগ, শ্বাস নিতে পারছে না তারা। বেশ কিছু মানুষকে শ্বাসযন্ত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বাড়িতে থেকে কাজ করতে বলেছে। অনেক স্কুল বন্ধ। বিমানবন্দরগুলোতে ফ্লাইট বন্ধ করতে হয়েছে। এর কারণ মারাত্মক ধূলিঝড়। মরুভূমির বালুর ঘূর্ণিতে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক জায়গায় জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সেখানকার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এ ঝড় বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
গত এপ্রিল থেকে ইরাকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে তীব্র ধূলিঝড়ের এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। কয়েক দশক আগে প্রতিবছর দুই বা তিনটি বড় বালুর ঝড় দেখা যেত। অথচ এবারের বসন্তেই ইরাক ইতিমধ্যে কমপক্ষে আটটি ঝড়ের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে গত ১৬ মের একটি ঝড়েই প্রায় চার হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এর মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে ঝড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ঘন ঘন বালুর এ ঝড় লাখো মানুষের জন্য দুর্দশা সৃষ্টি করছে এবং বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করছে।
ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী, বালুর ঝড় সব সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষের জীবনের একটি বাস্তবতা। বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণ মরুভূমি সাহারা ও তৃতীয় স্থানে থাকা আরব মরুভূমি এ অঞ্চলেই রয়েছে। প্রতিবছর বাতাস প্রায় ছয় কোটি টন সাহারার বালু ক্যারিবীয় অঞ্চলে বয়ে নিয়ে যায়।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ধূলিঝড় যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা গত মে মাসে টের পেয়েছে আরব বিশ্বের দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বয়ে যাওয়া ওই ঝড় আঘাত হানে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও। এতে দেশটিতে জরুরি সতর্কতা জারি করা হয়। ধূলিঝড়ের কারণে ধুলায় ছেয়ে যায় চারপাশ। এতে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা কিছু সময়ের জন্য চোখের আড়ালে চলে যায়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবন বুর্জ খলিফাকেও ছাড়েনি ধূলিঝড়। ধুলার আস্তরণে ভবনটি মানুষের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। একই কারণে ইরানের রাজধানী তেহরানের স্কুল ও সরকারি অফিস বন্ধ রাখতে হয়েছে। বাতিল কিংবা বিলম্ব করতে হয়েছে কয়েক ডজন ফ্লাইট।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়াও ধুলার ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ঝড় আসার খবরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অনেক বিমানবন্দর, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবশেষ উপসর্গ হিসেবে উপসাগরীয় দেশগুলো এসব বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও অস্বাভাবিক হতে এতে ভূমিকা রাখছে যুদ্ধবিগ্রহসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ইরানিয়ান স্টাডিজের গবেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বানাফেসহাহ কেইনুশ বলেন, বালু ও ধূলিঝড়ে লেক-জলাভূমির কাছে পলি জমে আটকে যাচ্ছে। কখনো-কখনো উপসাগরীয় জলাশয়ের বিশাল অংশ ঢেকে যায় এতে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবন বুর্জ খলিফাকেও ছাড়েনি ধূলিঝড়। ধুলার আস্তরণে ভবনটি মানুষের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, যখন সবকিছু ধুলোয় ঢেকে যায়, তখন নবায়নযোগ্য সৌর প্যানেলেও ত্রুটি দেখা দেয়। এ বিষয় আমলে নিয়ে বলা যায়, বালু ও ধূলিঝড়ের এক দুষ্টচক্রে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড় হচ্ছে। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও তীব্র করে তুলছে ক্রমাগত ঝড়। আবহাওয়ার ধরনের সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ছে। এতে মানুঝের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক হুমকিতে।
মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিঝড় এখন আরও ঘন ঘন ও তীব্র হয়ে উঠছে। এ প্রবণতার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত ঘাস কেটে ফেলা, বন উজাড়, নদীর পানির অত্যধিক ব্যবহার ও বাঁধনির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন আঞ্চলিক আবহাওয়ার ধরনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। মরুকরণের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধুলার ঝড় অনেক জটিল এবং এটা সহজে বুঝতে পারার মতো বিষয় নয়। তবে এর মূল কারণ প্রাকৃতিক। ২০১৫ সালে অনেকেই ভয়ংকর ঝড়ের জন্য সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে দায়ী করেন। অনেকেই মনে করেন, সাঁজোয়া যানের কারণে ওই অঞ্চলে ব্যাপক ধুলার সৃষ্টি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এ ঝড়ের পেছনে বাতাস ও অতিরিক্ত গরমকে দায়ী করেন। তারা এ ক্ষেত্রে বন্দুকধারীদের ভূমিকা পাননি।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিঝড় সৃষ্টিতে মানবসৃষ্ট কারণও ভূমিকা রাখছে। পানির ঘাটতি ওই অঞ্চলকে আরও শুষ্ক করে তুলছে। বিশ্বব্যাংকের করা ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড যেমন নদী ও হ্রদের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিকণার চার ভাগের এক ভাগ তৈরি হয়েছে।
কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ শতাংশের বেশি সৌদি নাগরিকের অ্যাজমা রয়েছে। এর পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারণ ধূলিকণা। ধূলিঝড়ের কারণে অনেক ক্ষুদ্র বালুকণা ফুসফুসে চলে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রামের বেশি ধূলিকণা অস্বাস্থ্যকর। কাতারের জনগণ এর চেয়ে আট গুণ বেশি ধূলিকণায় শ্বাস নেয়।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বায়ুদূষণে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিবছর ৩০ হাজারের বেশি মানুষ অকালমৃত্যুর শিকার হয়। এ মৃত্যু আরও বাড়ছে। এর অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক। কর্মীদের বাড়িতে থেকে কাজ করতে হয়। ফসল বালুতে ডুবে যায়। বিমানবন্দরগুলোকে ফ্লাইট বাতিল করতে হয়।
জাতিসংঘের হিসাবে, মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিঝড়ে সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রতিবছর ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর বাইরে পরোক্ষ ক্ষতিও অনেক।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, মাঝেমধ্যে ধূলিঝড় একটি অসুবিধামাত্র, কিন্তু ঘন ঘন হলে তা মহামারি হবে।
এদিকে এসব ঝড়ের সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বাড়ছে সহিংসতা। ধুলা ও বালুর কারণে মানুষের দৃষ্টির পাল্লা কমে যায়। অর্থাৎ, দূরের দৃশ্যাবলি চোখে পড়ে কম। সেই সুযোগ নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে ইরাকে।
গেল মে মাসে কিরকুক ও দিয়ালা প্রদেশে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে তারা। এপ্রিলেও ভয়াবহ দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে আনবার প্রদেশের হিত শহরে ইরাকি সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় আইএস। এতে দুই সেনা নিহত হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই ধুলাবালির সঙ্গে পেরে উঠছে না ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী। এতে ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের, যা ভবিষ্যতে আইসের হামলার সুযোগ তৈরি করে দেবে। আবহাওয়ার চরম মাত্রায় সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু অভিযান স্থগিত রাখতে হচ্ছে। আর আইএসসহ অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সেই সুযোগ নিয়ে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে সহিংসতা বেশি ঘটেছে।
সন্ত্রাসবাদের উদ্বেগ ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, এই অস্বাভাবিক ঝড়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত বেড়ে যেতে পারে। আর তা হবে পানি নিয়ে। জলবায়ু সংকটে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টিতে নদীর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা তীব্রতর হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ