২০১৭ সালের ঘটনা। নিউ ইয়র্কের ক্রিস্টি’স অকশন হাউজে সালভাদর মুন্ডি নামের একটি চিত্রকর্ম নিলামে তোলা হবে। পেইন্টিংটি সম্ভবত আসল কিংবা বলা যায় যথেষ্ট সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিত্রকর্মটিকে আসল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছেন। চিত্রকর্মটিতে দেখা যাচ্ছে : স্বচ্ছ চেহারার যিশু খ্রিস্ট, ডান হাত দিয়ে ক্রস আঁকছেন আর তার বাম হাতের তালুতে রয়েছে একটি স্বচ্ছ গোলক। তিনি ‘বিশ্বের রক্ষাকর্তা’-এর ভূমিকায় রয়েছেন, ছবিতে সেটাই প্রতীকিভাবে তুলে ধরা হয়েছে। স্বর্গ রয়েছে তার বাম হাতের মুঠোয়।
ছবি : সালভাদর মুন্ডি পেইন্টিং
এই চিত্রকর্মটি মূলত কালেকটর’স আইটেমের চেয়ে বরং জনপ্রিয় আইটেম হয়ে উঠেছিল। সদ্য চালু হতে যাচ্ছে এমন কোনো জাদুঘরে ভিঞ্চির নতুন কোনো চিত্রকর্ম প্রচুর দর্শনার্থী টানার সক্ষমতা রাখে, পর্যটন খাতে প্রচুর ডলার আনতে পারে এবং একটি শহরে সাংস্কৃতিক মানচিত্রে স্থান করে দিতে পারে। তবে চিত্রকর্মটি যেহেতু খ্রিস্টান আবহে আঁকা, তাই তারা ভাবতে পারেননি এটা কিনতে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো গ্রাহক আগ্রহী হবে।
নিলাম অনুষ্ঠিত হবে নভেম্বরের ১৫ তারিখে। ক্রিস্টি’স অকশন হাউজের টিম সম্ভাব্য গ্রাহকের নামের তালিকাটিকে কেঁটে-ছেঁটে সাতজনে নামিয়ে এনেছে। প্রচন্ড মাত্রায় বিত্তশালী, আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত এবং সাম্প্রতিক সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া চীনা ও রাশিয়ান ব্যক্তিবর্গ সেই তালিকায় রয়েছেন। এর মাঝে আরেকজন গ্রাহক উদয় হলেন, তার নাম বদর বিন ফারহান আল সৌদ। চট করে গুগলে একবার সার্চ দিয়ে এই তরুণ সৌদির ব্যাপারে তেমন কিছুই জানা গেল না। ক্রিস্টি’স অকশন হাউজের নির্বাহী কর্মকর্তাদের মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেও তারা কখনো এই ব্যক্তির নাম শোনেননি। নামটি অপরিচিত হলেও তাকে বেশ আগ্রহী বলে মনে হয়েছিল এবং তার নামের শেষ অংশ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বেশ বিত্তশালী। ক্রিস্টি’স ব্যাংকিং টিম জানালো, পেইন্টিংটি কেনার জন্য প্রিন্স বদর সর্বোচ্চ যত টাকা দিতে প্রস্তুত তার প্রায় ১০% টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অগ্রীম পাঠিয়ে রাখলে, তিনি সেই সর্বোচ্চ অংক পর্যন্ত নিলামে অংশ নিতে পারবেন।
নিলামের যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য জানার অনুমতি সবার ছিল না। ক্রিস্টি’স-এর কর্মীদের মধ্যকার ছোট্ট একটি অংশ বিস্তারিত তথ্য জানতো। পরদিন সকালে তারা রীতিমতো উত্তেজিতভাবে আলাপ করতে শুরু করেছিল। কারণ গতরাতে ক্রিস্টি’স ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০০ মিলিয়ন ডলার টান্সফার করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রিন্স বদর ইঙ্গিত দিচ্ছেন- পেইন্টিংটি তিনি সর্বোচ্চ ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনতে প্রস্তুত! অংকটি এতই বিশাল যে সালভাদর মুন্ডি’র অনুমিত সর্বোচ্চ মূল্যকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে পুরো মিউজিয়ামের আর্ট কিনে নেওয়া সম্ভব!
তবে ক্রিস্টি’স টিম জানতো না বদর বিন ফারহান মূলত মোহাম্মদ বিন সালমানের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং দূর-সম্পর্কের চাচাতো ভাই। মোহাম্মদ ছোটবেলা থেকে বদরের সাথে সময় কাটিয়েছেন। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তাদের জন্ম হয়েছিল, দুজন একসাথে বেড়ে উঠেছেন। বিশ-বাইশ বছর বয়স থেকেই তারা একাধিক ব্যবসায় দাঁড় করিয়েছেন এবং এক নতুন সৌদি আরব কল্পনা করেছেন। সৌদি আরবের পুরাতন কর্পোরেট নথিতে দেখা গেছে, মোহাম্মদ ও বদর বিভিন্ন ব্যবসায় অংশীদার ছিলেন। একটি প্লাস্টিক কোম্পানি, একটি রিয়েল স্টেট ডেভেলপমেন্ট ফার্ম এবং প্রায় এক দশক আগে ভ্যারাইজন নামক আমেরিকান ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক অপারেটর কোম্পানির সাথে তাদের যৌথ ব্যবসায় ছিল। মোহাম্মদ বিন সালমান বেশ নামডাক করলেও, তার বন্ধুদের পরিচয় এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে খুব কম মানুষই বুঝতে পেরেছিল। মোহাম্মদের সম্পদের পরিমাণ কত তা কেউ ঘেটে দেখেনি কিংবা তার রুচিবোধ কেমন সেটাও জানার চেষ্টা করেনি।
ছবি : বদর বিন ফারহান
ক্রিস্টি’স টিমে একজন চৌকস বিক্রয় বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তার নাম- লুইক গুযেইর; তিনি তখন যুদ্ধ পরবর্তী এবং সমকালীন আর্ট বিষয়ক যুগ্ম-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। নিলামের জন্য অপ্রত্যাশিত এবং মাঝে মাঝে অসঙ্গতিপূর্ণ আয়োজন করার মাধ্যমে তিনি ক্রিস্টি’স-এর উর্ধ্বতন পদে পৌঁছেছিলেন। ২০১৫ সালের ‘লুকিং ফরোয়ার্ড টু দ্য পাস্ট’ নামের নিলাম অনুষ্ঠানে, একই প্রদর্শনীতে তিনি ক্লদ ম্যনে এবং রিচার্ড প্রিন্সের চিত্রকর্ম উপস্থাপন করেছিলেন। সাথে ছিল ১৯৫৫ সালে পাবলো পিকাসো কর্তৃক আঁকা লেস ফেমস দ্যলজার, ভার্সন O; যা বিক্রি হয়েছিল ১৭,৯৩,৬৫,০০০ ডলারে! নিলামে এত উচ্চমূল্যে কোনো চিত্রকর্ম বিক্রি হওয়ার ঘটনাটি তখন রীতিমতো রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। চিত্রকর্মটি কিনেছিলেন শেখ হামাদ বিন জসিম, তিনি কাতারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তরুণ আমির তামিম বিন হামাদের দ্বিতীয় কাজিন । মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে একজন হলেন- হামাদ বিন জসিম। সেলেব্রেটি, খেলোয়ার এবং চরম বিত্তশালীদের সাথেও গুযেইরের চমৎকার যোগাযোগ ছিল।
আর্ট দুনিয়ার আর্থিক হালচালের ব্যাপারেও গুযেইর ওয়াকিবহাল ছিলেন। কোনো ভুলের কারণে বা খারাপ সময়ে চিত্রকর্ম বিক্রি করতে গিয়ে মূল বিক্রেতার যেন লোকসান না হয়ে যায়, তাই ঝুঁকি কমানোর জন্য অকশন হাউজ অনেকটা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ভূমিকায় নেমেছিল। গুযেইর নিজের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পিয়ের চেন নামক একজন তাইওয়ানিজ বিনিয়োগকারী এবং আর্ট সংগ্রাহককে খুঁজে বের করেছিলেন। চিত্রকর্মটির জন্য গ্যারান্টি হিসেবে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছিলেন পিয়ের। অর্থাৎ, নিলামে যা-ই হোক না কেন, চিত্রকর্মটির প্রকৃত বিক্রেতা ধনাঢ্য রাশিয়ান ব্যবসায়ী দিমিত্রি রাইবোলভলেভ অন্তত এই ১০০ মিলিয়ন ডলার পাবেন, তবে সেখান থেকে অকশন হাউজের ফি কেটে নেওয়া হবে। যদি আর কোনো ক্রেতা না পাওয়া যায় তাহলে পিয়ের চেন এই চিত্রকর্মটির গ্রাহক হয়ে যাবেন। তবে ১০০ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি দামে যদি কেউ কিনে নেয় সেক্ষেত্রে রাশিয়ান বিক্রেতা লভ্যাংশটুকু পিয়ের চেনের সাথে ভাগ করে নেবেন।
বড় পেইন্টিং মানে বিজ্ঞাপনের জন্য বিশাল বাজেট। বড় পরিসরে বিজ্ঞাপন করার উদ্দেশ্য- নিলাম আয়োজনের কথা যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়া এবং নিলাম অনুষ্ঠানে আসার জন্য সম্ভাব্য ক্রেতাদের দৃষ্টিআকর্ষণ করা। বিলাসী ম্যাগাজিন, ব্যাবসায়িক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া এবং বড় বড় জেলা শহরে আউটডোর বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করার মাধ্যমে সেটা করা যায়। তবে গুযেইর কোনোটাই করলেন না। তিনি দ্রগা৫ নামের একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে একটি ভিডিও তৈরি করার দায়িত্ব দিলেন। যার ফলে ‘দ্য লাস্ট দা ভিঞ্চি’ নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের কিন্তু মনমুগ্ধকর বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মিত হয়।
কিন্তু ক্রিস্টি’স টিমের জানা ছিল না যে তখন সৌদি আরবে বিষয়টা নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। মোহাম্মদ বিন সালমান বড় বড় আইডিয়া আর সম্পদের প্রতি দূর্বল ছিলেন। তরুণ সৌদি যুবরাজ খুব করে চাচ্ছিলেন এই নিলামে অংশ নিয়ে তিনি যেন অন্যান্য দেশের প্রধানমন্ত্রী ও শাসকগোষ্ঠীর সাথে একই কাতারে জায়গা নিতে পারেন। অথচ পেইন্টিংটি কিনে এনে ঠিক কী করবেন সেটা তার জানা ছিল না, তবে এতটুকু ধারণা ছিল পেইন্টিংটি তিনি সৌদি আরবে প্রদর্শন করবেন।
নিলাম অনুষ্ঠানের দিন বদর বিন ফারহান আল সৌদ যুদ্ধ পরবর্তী এবং সমকালীন আর্ট বিষয়ক যুগ্ম-চেয়ারম্যান আলেকজান্ডার রটারকে ফোন করেন; তিনি যুগ্ম-চেয়ারম্যান হিসেবে গুযেইরের সাথে কাজ করতেন। রটার তখন অকশন ফ্লোরের ফোন ব্যাংকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে অন্যান্য ব্যক্তিরা ফোনে আলাপ করছিল সম্ভাব্য ক্রেতাদের সাথে।
নিলাম শুরু হওয়া কয়েক মিনিটের মাঝে পেইন্টিংটির নির্ধারিত প্রাথমিক মূল্য ১০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। তারপর ১০ মিলিয়ন, ৫ মিলিয়ন করে বাড়তে বাড়তে মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় ২৬৫ মিলিয়ন ডলারে! উপস্থিত দর্শকদের মাঝে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়, তারপর বিক্ষিপ্তভাবে করতালি দেয় তারা। সবচেয়ে বেশি দামে পেইন্টিং বিক্রির রেকর্ডটি ততক্ষণে ভেঙে গেছে।
নিলাম প্রতিযোগিতায় তখন মাত্র দুজন টিকেছিলেন। একজন হলেন রটারের ক্লায়েন্ট এবং অন্যজন হলেন চীনা বিলিয়নিয়ার ল্যুউ ইউচিন। পুরোনো প্রতিথযশা চিত্রকরদের মূল্যায়ন বিভাগের প্রধান ফ্রাঁন্সোয়া ডি পোর্তে-এর সাথে তিনি ফোনে সংযুক্ত ছিলেন। ফ্রাঁন্সোয়া ফোন ব্যাংকে রটারের পাশেই বসেছিলেন। তবে ক্রিস্টি’স-এর নিয়মানুযায়ী, দুপক্ষের কেউই তাদের প্রতিযোগী ক্রেতার পরিচয় জানতেন না।
নিলাম কার্যক্রম চলছে, শেষপর্যন্ত কে জিতবে তা নিয়ে সাসপেন্স তৈরি হচ্ছে। ক্রিস্টি’স-এর কার্যনির্বাহকরা ফোনে তাদের ক্লায়েন্টদের সাথে জোরদার আলোচনা করে চলেছেন। গুযেইরের ক্লায়েন্ট আগেই নিলাম থেকে ছিঁটকে গেলেও, গুযেইর মনোযোগ দিয়ে নিলাম কার্যক্রম দেখছিলেন। তার চোখের সামনে নিলামদার ২৪৫ মিলিয়ন, ২৮৬ মিলিয়ন, ২৯০ মিলিয়ন, ৩১৮ মিলিয়ন, ৩২৮ মিলিয়ন এবং তারপর ৩৩০ মিলিয়ন ডলার হাঁকলো! ডি পোর্তে নিলামদারকে সংকেত দিলেন : ৩৫০ মিলিয়ন ডলার!
নিলাম শুরু হওয়ার ১৯ মিনিটের মাথায় রটার শান্তভাবে চূড়ান্ত দর হাঁকলেন : ৪০০ মিলিয়ন ডলার! অর্থের পরিমাণ শুনে প্রথমে পুরো রুম থমকে গিয়েছিল, তারপর উত্তেজিত হয়ে শোরগোল জুড়ে দিয়েছিল সবাই। ক্রিস্টি’স-এর ফি মেটানো সহ মোট বিল এসেছিল ৪৫০ মিলিয়ন ডলার! ২০১২ সালে বারাক ওবামা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য একজন প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, পেইন্টিংটির বিক্রয় মূল্য তার নির্বাচনী প্রচারণার পুরো বাজেটকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
পরবর্তী তিন সপ্তাহ জুড়ে আর্ট জগতে পেইন্টিংটির ক্রেতার পরিচয় রীতিমতো রহস্য ছিল। কে কিনেছে; দ্রুত বিভিন্ন গুজব ছড়াতে শুরু করেছিল এটা নিয়ে। অবশেষে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে, আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ থাকা একাধিক সূত্র ক্রেতার পরিচয়টি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ফাঁস করে দেয়। সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ যে কীরকম হাস্যকর/অযৌক্তিক একটি কাজ করেছেন, সেটাও খবরে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। শুধু যে তিনি জলের মতো অর্থ অপচয় করেছেন তা-ই নয়, বরং পেইন্টিংটি কিনে তিনি সৌদি আরবের রক্ষণশীল ইসলামিক সম্প্রদায়কেও অযথা উস্কে দিয়েছেন।
মোহাম্মদ বিন সালমান তখন স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলেন। একদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালনা, অন্যদিকে গোপনে কেনা পেইন্টিঙের খবরটি এত দ্রুত ফাঁস হওয়া। মোহাম্মদ তার বড় বড় প্রজেক্টের খবর গোপনে রেখেছিলেন, যেমন : NEOM প্রজেক্টের খবর এক বছর গোপন ছিল। অথচ পেইন্টিং কেনা, সেরিন নামক বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘতম ব্যক্তিগত সুপার-ইয়ট অধিগ্রহণ এবং একটি বিশালাকার ফ্রেঞ্চ দূর্গ কেনার খবর খুব জলদি ফাঁস হয়েছে। মোহাম্মদের সন্দেহ হয়েছিল এসবের সাথে কাতার জড়িত। তাই সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা বন্ধুদের সাথে মিলে মোহাম্মদ বিন সালমান একটি গল্প ফাঁদলেন : সৌদি আরব মূলত পেইন্টিংটি কিনেছে আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের জন্য। আবুধাবিতে কয়েক সপ্তাহ আগে ল্যুভর মিউজিয়ামের একটি নতুন শাখা খোলা হয়েছে। এই পেইন্টিংটি সেই সদ্য খোলা জাদুঘরে প্রচুর দর্শনার্থী টানতে সক্ষম হবে। দর্শকরা দা ভিঞ্চির আঁকা দুষ্প্রাপ্য চিত্রকর্ম স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাবে।
কিন্তু তারপরেও মোহাম্মদ বিন সালমান চিন্তায় পড়ে গেলেন : পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পেইন্টিংটি তিনি আবুধাবিকে কেন দেবেন? যেখানে তার নিজেরই সৌদি আরবকে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়া তোলার স্বপ্ন রয়েছে?
পেইন্টিংটি ইউরোপের একটি গোপন সংরক্ষণাগারে চলে গিয়েছিল। বদর বা মোহাম্মদ কেউই সে-ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে রাজি নন। সাক্ষাৎ করতে এসে কোনো বিলিয়নিয়ার কিংবা শিল্প পরামর্শদাতা একান্তে যতবারই তথ্য জানার চেষ্টা করুক না কেন তারা কোনো জবাব পায়নি।
যখন আবুধাবি ল্যুভর কর্তৃপক্ষের সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে ব্যবহার করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আর্ট আনার চেষ্টা করছিল, তখন সৌদি আরবের পরামর্শকগণ এমন একটি কৌশল প্রস্তাবনা করলেন, যা দেশের আয়তন, বৈচিত্রময়তা এবং ইতিহাসকে কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধ করবে। কোনো সেলেব্রেটি স্থপতিকে দিয়ে বিশাল ও চিত্তাকর্ষক একটি জাদুঘর ডিজাইন ও নির্মাণ না করে বরং দেশের বিভিন্ন স্থানে তুলনামূলক ছোট ছোট জাদুঘর নির্মাণ এবং প্রত্মতাত্তি¡ক পুনরুদ্ধারের দিকে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাদের মাঝে কিছু জাদুঘর একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর জন্য বরাদ্দ থাকবে। যেমন : সুগন্ধী জাদুঘর বিভিন্ন ধরনের পারফিউমের ইতিহাস তুলে ধরবে এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভেতরে যেসব কিংবদন্তি বাণিজ্যিক পথ ব্যবহার করা হতো সেগুলো উপস্থাপন করার কাজ করবে।
এধরনের স্থাপনা নির্মাণ করার বিষয়টি মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করেছিল। কারণ সৌদি আরবে ওয়াহাবি মতবাদ অনুযায়ী জাদুঘরকে, বিশেষ করে যেখানে প্রাচীন, প্রত্মতাত্তি¡ক জিনিসপত্র প্রদর্শন করা হয় সেগুলোকে মূর্তিপূজার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচনা করতো। ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত, সৌদিতে পাওয়া প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলো রিয়াদের এক প্রাসাদে অবস্থিত গোপন জাদুঘরে সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল, যেন মোল্লারা জানতে না পারে আল সৌদ এসব ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করছিলেন।
২০২০ সাল নাগাদ, সালভাদর মুন্ডি উদ্বোধন করার জন্য মোহাম্মদ এবং বদর মিলে একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। তখন রিয়াদে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি নতুন জাদুঘর চালু করা হচ্ছিল, সেগুলোর যেকোনো একটায় পেইন্টিংটি উন্মোচন করা হবে পরিকল্পনা করা হলো। কিন্তু পেইন্টিংটির বিষয়বস্তু বেশ ঝুঁকিপূর্ণ : যীশুর ছবি দেখামাত্র ওয়াহাবি মোল্লারা শিরক, মূর্তিপূজা ইত্যাদি বলে চিৎকার জুড়ে দেবে। যীশু আরবিতে ঈসা নামে পরিচিত। নবী যীশুকে নিয়ে মূলত তাদের কোনো সমস্যা নেই। কোরআনে তাকে নবী মোহাম্মদের পূর্ববর্তী নবী হিসেবে খুব গুরুত্বের সাথে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা ছবিতে, অঙ্কিত অবয়বে। ছবিটি দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যীশুই রক্ষাকর্তা, যীশুই সব; যা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে যীশুর শ্রেষ্ঠত্বের ইঙ্গিত করছে; ব্যাপারটা মোল্লারা মোটেও সহজভাবে গ্রহণ করবে না। প্রাচীন সৌদি আরবে, মানুষের অবয়ব এঁকে জনসম্মুখে প্রদর্শন করার অনুমতি ছিল না।
পেইন্টিংটির জন্য নিজস্ব জাদুঘর নির্মাণ না কীভাবে তা প্রদর্শন করা যায় সে-ব্যাপারে বদর ও তার দল নতুন একটি কৌশল বের করেছিলেন। তারা রিয়াদে ওয়েস্টার্ন আর্ট সংক্রান্ত একটি জাদুঘর খোলার পরিকল্পনা করলেন। মূলত পশ্চিমা শিল্প কেন্দ্রিক জাদুঘর নির্মাণ করে সেখানে সুকৌশলে পেইন্টিংটি প্রদর্শন করা হবে। এটা দর্শকদের দৃষ্টিআকর্ষণ করবে ঠিকই, তবে এটার পাশপাশি দৃষ্টিআকর্ষণ করার জন্য আরো অনেক কিছু থাকবে।
এই কৌশলটি ছিল সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার একটি বর্ধিত অংশ মাত্র। সৌদি আরবের এক কোণে অবস্থিত আল-উলা নামক শহরটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল, মোহাম্মদ সেখান থেকে মূল পরিকল্পনাটি শুরু করেছিলেন। মোহাম্মদ পরিকল্পনাটি শুরু করেছিলেন। কয়েক দশক ধরে, শহরটিকে সৎ-সন্তানের মতো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল কারণ তা ক্ষমতাশালী ওয়াহাবি মতবাদীদের অস্বস্তিতে ফেলতো। আল-উলা শহরটি দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানে এককালে ব্যবসায়ীদের কাফেলা জড়ো হওয়ার চমৎকার দৃশ্য দেখা যেত। ব্যবসায়ীরা মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া থেকে আরবীয় উপদ্বীপে যাতায়াত করতেন। তারা যে পথ ব্যবহার করতেন তাকে সুগন্ধী পথ বলা হতো। উত্তর থেকে এসে তারা গিরিখাতে আশ্রয় নিতেন এবং বেলেপাথরের পাহাড়ের গায়ে নবতাঈ সম্প্রদায় কর্তৃক খচিত বিশালাকৃতির সদরের বহির্ভাগ দেখতেন, যা কিনা ২ হাজার বছর আগে নির্মিত। এই সদরগুলো মূলত মাদাইন সালেহ গোরস্থানে থাকা সমাধির প্রবেশদ্বার। এগুলো ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্গত। আল-উলায় কাফেলারা পর্যাপ্ত পানি সমৃদ্ধ একটি শহর খুঁজে পেয়েছিল, সেখানে শত শত বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ছিল আর সেগুলোর দু’পাশ জুড়ে ছিল ছোট আকৃতির পাথুরে পর্বতমালা।
ছবি : পাহাড়ের গায়ে নবতাঈ সম্প্রদায় কর্তৃক খচিত সদর
সৌদি সরকার দীর্ঘকাল যাবত প্রাচীন স্থান সংক্রান্ত যেকোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা এড়িয়ে এসেছিল এবং সেখানে মানুষের যাতায়াত সীমিত করে রেখেছিল। মৌলবাদীরা ইসলামের আগের যুগে থাকা কোনোকিছু স্বীকার করতে রাজি নয়, মূলত তাদের ভয়েই সৌদি সরকার এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আফগানিস্তানের এক কোণে অবস্থিত পাহাড়ের গায়ে খচিত, বুদ্ধের প্রাচীন ভাস্কর্য নিয়ে তালেবানরা এতই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল যে ২০ বছর আগে তারা সেই ভাস্কর্য বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে! ভাস্কর্য যেহেতু মূর্তির মতো তাই সেগুলো হারাম, নিষিদ্ধ। একইভাবে নবতাঈ জাতি, লিহিয়ান জাতি এবং আরব উপদ্বীপে বসবসা করা অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ এবং শিল্পকর্মগুলোকে কাঠমোল্লারা মূর্তিপূজা হিসেবে বিবেচনা করতো এবং তাদের সবকিছু ধ্বংস করাকে সঠিক বলে মনে করতো। আদর্শগত দিক থেকে তালেবানদের সাথে ওয়াহাবি মতবাদ অনুসারী অনেকেরই খুব বেশি পার্থক্য নেই।
কিন্তু মোহাম্মদের কাছে বিষয়টা অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছিল, এবং তিনি সাহসিকতার সাথে কাঠমোল্লাদের অনেককেই গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিংবা চাকরিচ্যুত করেছিলেন। তিনি বদর বিন ফারহানকে বলেছিলেন, তিনি যেন আল-উলাকে একটি সাংস্কৃতিক মরুদ্যান হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন করার দিকে জোর দেন। ওখানকার আবহাওয়া তুলনামূলক ঠান্ডা, শীতকালে সেখানে বরফ পড়ে। মোহাম্মদ বিন সালমান আল-উলায় নতুন নতুন অবকাঠামো, জাদুঘর, শিল্প এবং খেলাধূলা উপভোগ করার মতো স্থান নির্মাণ করতে বলেছিলেন। বদর বিন ফারহান রয়্যাল কমিশনের গভর্নর, এসকল কার্যক্রম রয়্যাল কমিশনের অধীনে সম্পাদিত হয়েছিল।
সালভাদর মুন্ডি ক্রয়ের পর বদর বাড়তি কোনো দৃষ্টি আকর্ষণ না করে, নিয়মিত বিরতিতে অন্যান্য আর্ট কিনতে শুরু করেছিলেন। তাকে প্রায়ই লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কে ঝা-চকচকে স্যুট পরিহিত অবস্থায় হাসিমুখে দেখা যেত।
তথ্যসূত্র :
The New York Times
Blood & Oil: Mohammed bin Salman’s Ruthless Quest for Global Power by Bradley Hope and Justin Scheck
আপনার মতামত জানানঃ