দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতায় পড়তে যাচ্ছে পাকিস্তান। ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট। বিশ্ববাজারের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ডলারের বিপরীতে দাম কমেছে পাকিস্তানি রুপির। অপরদিকে, দেশজুড়ে লংমার্চের ডাক দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের লংমার্চ ঠেকাতে এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে সিন্ধু প্রদেশে। সারা দেশেই প্রস্তুত রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীকে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায়।
পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ‘আজাদি মার্চে’র কারণে সবার নজর আজ রাজধানী ইসলামাবাদের দিকে। দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে পিটিআই’র নেতাকর্মীরা রাজধানীর অভিমুখে যাত্রা করেছেন। যদিও কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের সমাবেশের অনুমতি দেয়নি।
এই সমাবেশ ঠেকাতে সরকার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা উচ্চ সতর্কতায় অবস্থান করছেন। এদিকে লাহোরের বাট্টি চকে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেখানে পিটিআই কর্মীরা ব্যারিকেড ভেঙে সমাবেশে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে পুলিশ।
লাহোরে পিটিআইয়ের শীর্ষ নেতারা তাদের কর্মীদের বাট্টি চকে জড়ো হতে বলেছেন। সেখান থেকেই তারা ইসলামাবাদের উদ্দেশে রওনা হবেন।
দলীয় কর্মীরা মোড়ে মোড়ে জড়ো হয়ে ব্যারিকেড সরানোর চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশ কাঁদানেগ্যাস নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করেছে।
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, খাইবার পাখতুনে ইমরান খানের সমর্থকরা তার হেলিকপ্টার ঘিরে রেখেছে। পরে পিটিআইয়ের টুইটার পেজে একটি ছবি টুইট করা হয়, যেখানে ইমরান খানকে গাড়ি থেকে তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে দেখা গেছে।
এদিকে, দেশটির সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়াসমিন রশিদের গাড়িতে হামলা চালিয়েছে পুলিশ। আজাদি মার্চে যোগদান ঠেকাতে পিটিআইয়ের এই নেত্রীর গাড়ির সামনের কাঁচ পুলিশ ভেঙে ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ঘটনার ভিডিওতে দেখা যায়, পিটিআইয়ের নেত্রীকে থামাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করছে। কিন্তু তারপরও তার গাড়ি সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পুলিশের ব্যাপক বাক-বিতণ্ডা হয় সাবেক এই মন্ত্রীর।
অন্যদিকে পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান ইমরান খান ওয়ালি মোড় থেকে আজাদি মার্চে নেতৃত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হেলিকপ্টারে করে সেখানে অবতরণ করেছেন তিনি। আজাদি মার্চে যোগ দিতে যাওয়ার আগে এক ভিডিও বার্তায় সাবেক এই পাক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তানের জন্য এটি একটি চূড়ান্ত মুহূর্ত।
আজাদি মার্চে তার সাথে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সমর্থকদের আশ্বস্ত করে ইমরান খান বলেছেন, পিটিআই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে।
‘যদিও লংমার্চের সময় ইমরানসহ অন্যান্য পিটিআই নেতাকে গ্রেপ্তার করা অসম্ভব বলে মনে হলেও সরকারবিরোধী কর্মসূচিকে ঘিরে সম্ভাব্য সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা এড়াতে তাদের আটক করা ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই।’
রাজধানী ইসলামাবাদে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে পিটিআইয়ের সমর্থকদের তীব্র সংঘর্ষের মাঝে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ পুলিশ এবং প্রশাসনকে রাজধানীতে সরকারি সব কর্মীকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। গণমাধ্যম কর্মীদের থামানো যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি হাসপাতালগামী সড়ক চালু রাখার নির্দেশও দিয়েছেন পাকিস্তানের এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করতে পারে ইসলামাবাদ সরকার। একইসঙ্গে গ্রেপ্তার করা হতে পারে দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাকেও।
পাকিস্তান সরকারের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে বুধবার (২৫ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল। অন্যদিকে পাকিস্তানের আরেক শীর্ষ সংবাদমাধ্যম দ্য ডন জানিয়েছে, ইমরান খানের ডাকে রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে যাওয়ার সময় দেশটির লাহোরে পিটিআই কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে।
দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল বলছে, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বুধবার পেশোয়ার থেকে ইসলামাবাদে যাওয়ার পথে পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানকে দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে আটক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নামপ্রকাশ না করার শর্তে পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের অন্যতম শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, ইমরান খানকে আটকের পর সম্ভাব্য বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনা করেছে সরকার। তবে আলোচনা শেষে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে আটকের পরিকল্পনাটি এগিয়ে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সূত্রটির দাবি, ‘যদিও লংমার্চের সময় ইমরানসহ অন্যান্য পিটিআই নেতাকে গ্রেপ্তার করা অসম্ভব বলে মনে হলেও সরকারবিরোধী কর্মসূচিকে ঘিরে সম্ভাব্য সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা এড়াতে তাদের আটক করা ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই।’
এদিকে শ্রীলঙ্কার মতো হাল চলেছে পাকিস্তানেরও! ক্রমশ বাড়ছে এমন আশঙ্কা। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বেড়ে চলেছে পাকিস্তানের ঋণের বোঝা। বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ার খালি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সরকার এক বিলিয়ন ডলারের পাকিস্তান সুকুক বন্ড বিক্রি করেছিল। সুদ ছিল ৫.৬২৫ শতাংশ। বর্তমানে সেই বন্ডের সুদ বেড়ে হয়েছে ২৭ শতাংশ। তাতে পাকিস্তানের দেউলিয়া হওয়ার পথ অনেকটাই প্রশস্ত হয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
পাকিস্তানি সংবাদপত্র দ্য নিউজের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই সপ্তাহে পাকিস্তানের ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তান (এসবিপি) জানিয়েছে, ২০২২ সালে জুন শেষ হওয়ার আগে ৪.৮৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ বকেয়া রয়েছে পাকিস্তানের মাথায়। সেই সঙ্গে বাড়ছে রাজকোষের ঘাটতিও। মনে করা হচ্ছে, জুনের শেষ নাগাদ পাকিস্তানের রাজকোষের ঘাটতি ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে।
বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলেরও দ্রুত পতন হচ্ছে পাকিস্তানে। এটাও দেউলিয়া হওয়ার কারণ হতে পারে। ২০২১ সালের অগাস্টে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ৯ মাসে নেমে এসেছে ১০.১ বিলিয়ন ডলারে।
গত ৮ সপ্তাহে পাকিস্তানের স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা হারিয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং রাজকোষের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে দেশের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। এমন পরিস্থিতিতে, পাকিস্তান বড় কোনও আর্থিক সাহায্য পেলেই ঋণখেলাপি থেকে বাঁচতে পারবে। দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থাও সাম্প্রতিক অতীতে রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখেছে পাকিস্তান। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কারণে পিটিআই-এর ইমরান খান সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হতে হয়েছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ