তীব্র তাপদাহে নাকাল হয়ে পড়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। দেশটির সিন্ধু প্রদেশের জ্যাকোবাবাদে তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে।তীব্র দাবদাহে মানুষের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। গরমজনিত বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর খবর জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ। বিশেষ করে সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে মারাত্মক দাবদাহ শুরু হয়েছে।
তীব্র দাবদাহে পুড়ছে উত্তর পাঞ্জাবের মরু অঞ্চল চোলিস্তান। তাপে শুকিয়ে গেছে সব জলাধার। খাওয়ার পানির দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। আর এই সংকটের মুখে এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। পানির অভাবে দিন দিন বাড়ছে গবাদিপশুর মৃত্যু। পাকিস্তানের দরিদ্রতম এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবিকা এই গবাদিপশুর ওপর নির্ভর করে।
চোলিস্তানের বাসিন্দাদের দুরবস্থা দেখতে সেখানে চষে বেড়িয়েছে ভাইস নিউজ। মধ্য দুপুরে তারা দেখতে পান, বৃদ্ধ এক খামারি লুটিয়ে পড়েছেন কাদামাটিতে। আশপাশের লোকজন তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। তবে দাঁড়ানোর সক্ষমতা ছিল না বৃদ্ধের।
এ ঘটনার মাত্র কিছু আগে নিজের মারা যাওয়া পশুদের দেহ নিয়ে আসার জন্য ওই কর্দমাক্ত জলাশয়ের কাছে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ ব্যক্তিটি।
একপর্যায়ে তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘হে ঈশ্বর, তাদের (পাকিস্তান সরকার) ধ্বংস করুন। আমার গবাদিপশু তৃষ্ণায় মারা গেছে। আমাদের কোনো রক্ষক নেই। তারা যা করেছে তার জন্য ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’
ওই বৃদ্ধের আবেগঘন দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে নিজ দেশের সরকারকে অভিশাপ দিতে দেখা যাচ্ছে অসহায় এই খামারিকে। তার অভিযোগ, সরকারের উদাসীনতার জন্যই চোলিস্তানের মরু অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছে।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহে পাকিস্তানের ২২০ মিলিয়ন জনসংখ্যার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশে তীব্রতর হয়েছে, চালিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহজাদ জুগনু বলেন, ‘যদি পরিস্থিতি না বদলায়, তবে আমরা মারা যাব। আপনি খবরে দেখতে পাবেন চোলিস্তানের বাসিন্দারা মারা গেছে।
‘ঈশ্বরের ভালোবাসার জন্য, সরকারকে চোলিস্তান সম্পর্কে ভাবতে হবে। আমাদের পানি দেয়া উচিত। অন্যথায় আমরা মারা যাব।’
বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে ১ শতাংশেরও কম নিঃসরণ করে পাকিস্তান। তবে জার্মানওয়াচের ২০২১ সালের সমীক্ষা বলছে, আবহাওয়ায় পরিবর্তনের কারণে দেশটি এখনও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে আছে।
‘যদি পরিস্থিতি না বদলায়, তবে আমরা মারা যাব। আপনি খবরে দেখতে পাবেন চোলিস্তানের বাসিন্দারা মারা গেছে।
সাম্প্রতিক দিনগুলোয় পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই অঞ্চলের মানুষ এবং প্রাণীরা পানিশূন্যতায় ভুগছে, হিটস্ট্রোকের বড় ঝুঁকিতে আছে।
চোলিস্তানে তীব্র তাপমাত্রা এবং কম বৃষ্টিপাতের ফলে কূপগুলো শুকিয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে ফসল। বাধ্য হয়ে অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছে বহু মানুষ।
রেহাই পাচ্ছে না পশু-পাখিরাও। এই অঞ্চলে বাস করা দুই লাখ মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস গবাদিপশু। গত কয়েক দিনে অন্তত ৫০ প্রাণী মারা গেছে। তবে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, সংখ্যাটা ২০০-র কাছাকাছি।
জুগনু বলেন, ‘চোলিস্তানের পরিস্থিতি ভয়াবহ। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় চারদিকে খরা। অনেক প্রাণী মারা গেছে। কিছুর অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
বিষয়টি আমলে নিয়েছে প্রশাসন। জরুরি ত্রাণ ও চিকিৎসা শিবির স্থাপন করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। বিশুদ্ধ পানি আছে এমন জায়গায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে মানুষ ও গবাদিপশুকে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে আরও পরিকল্পনা নিচ্ছে পাকিস্তান সরকার।
তবে ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই ব্যবস্থা আগেই নিতে পারত সরকার। এতে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা কমানো যেত অনেক। গ্রীষ্মে যখন থেকে তাপদাহ বাড়তে শুরু করেছিল, সে সময় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ভূগর্ভস্থ পানির জন্য ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টের অভাবকে দায়ী করছেন বাসিন্দারা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য পুকুরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হতো না তাদের। সরকার প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চোলিস্তানে পানি সরবরাহ করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করলেও, পাইপগুলো শুকিয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মুহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে খরা মৌসুমে পানি সরবরাহের জন্য নিয়মিত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
পাঞ্জাবের অনেক শহরে দিনের বেলার তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এমন দাবদাহের মধ্যে লাহোরের অনেক মানুষকে ঘরের বাইরে থাকতে হয়। পানিস্বল্পতার কারণে তারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দাবদাহের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়া অনেককে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হচ্ছে। ইসলামাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ সতর্ক করেছে, দেশের বিভিন্ন অংশে উচ্চ তাপমাত্রায় হৃদ্রোগ ও পানিবাহিত রোগীর ঝুঁকি বাড়তে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত বিষয়কে আমলে নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের তুলনায় মানুষের আচরণগত পরিবর্তন আনার জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন তা একেবারেই কম। কিন্তু অভ্যাস ও আচরণগত পরিবর্তনের প্রতিদান এবং কো-বেনিফিটস অনেক বেশী।
তারা বলেন, কভিড-১৯ এর কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। ভেবে দেখা যেতে পারে, কী ধরনের সামাজিক প্রণোদনা মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।
তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা স্বভাবিক রাখতে বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনদস্যুদের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত বনাঞ্চল নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবেশ ও উষ্ণতা স্বভাবিক রেখে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৬
আপনার মতামত জানানঃ