আগামী ১৭ মাসের মধ্যে যে নির্বাচন হতেই হবে, তা নিয়ে কেউ কিছু জানে না, এটাই সবথেকে বড় বিস্ময়ের। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। নির্বাচন হতে হবে এই সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে যেকোনো সময়ে। সরল হিসাবে, ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। তার মানে নির্বাচনের আরও অন্তত ১৭ মাস সময় আছে। কোনো কারণে আগাম নির্বাচন হলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
এই হিসাবে কোনও বিভ্রান্তি নেই। বিভ্রান্তি অন্যখানে, নির্বাচনটি কেমন বা কীভাবে হবে, তা কেউ জানে না। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল ঘটনাবহুল। তবে এবারের নির্বাচনটি যে আগের দুটির কোনোটির মতোই হবে না, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মোটামুটি একমত। কীভাবে ও কেমন হবে আগামী নির্বাচন, এটা জনগণের সামনে এক বড় রহস্য।
মূলত ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে প্রতিটি নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল গ্রহণের কৃতিত্ব যেমন আওয়ামী লীগের, তেমনি নির্বাচনের আগপর্যন্ত সেই কৌশল পুরোপুরি গোপন রাখার কৃতিত্বও দলটির। তবে দল ও দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি দিনে দিনে যে মাত্রায় কেন্দ্রীভূত ও এককেন্দ্রিক হয়েছে, তাতে দলের কৌশল গোপন রাখার কাজটি খুব সহজ হয়ে গেছে। দলের লোকজনও তেমন কিছু জানেন বলে মনে হয় না।
এই যে ‘কেউ কিছু জানে না পরিস্থিতি’, তা বিএনপিকে ফেলেছে মহাবিপদে। আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে এমনিতেই দলটি বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত। আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা কী, তা আঁচ বা অনুমান করা গেলে হয়তো সে অনুযায়ী কৌশল ঠিক করা বিএনপির জন্য সহজ হতো। ঘটনা ঘটে গেলে বিশ্লেষণ করা সহজ। অনেক বিশ্লেষকের মূল্যায়ন হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যেমন ভুল করেছে বিএনপি, তেমনি ভুল করেছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে। এর মানে গত দুটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির দুটি সিদ্ধান্তই ভুল ছিল। নির্বাচন বর্জন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ—দুটো পথ ধরেই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এবার তাহলে কী করবে বিএনপি?
বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি কি করবে? রাজনীতির চাকা ফের ঘুরতে শুরু করেছে। এর কতটা আসল, কতটা মেকি তা এখনই বলা কঠিন। প্রশ্ন উঠেছে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যাবে কিনা? গেল তিনটি সংসদ নির্বাচনের আগেও এ প্রশ্ন উঠেছিল। ২০০৮ এ অবশ্য প্রকাশ্যে ওতোটা নয়। সে সময় প্রায় সব আলোচনাই হয় পর্দার আড়ালে। তিনটির মধ্যে দুটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বড় হার দেখে বিএনপি। এরমধ্যে গত নির্বাচনের ফলতো দলটির জন্য অবিশ্বাস্যই।
রাজনীতির চাকা ফের ঘুরতে শুরু করেছে। এর কতটা আসল, কতটা মেকি তা এখনই বলা কঠিন। প্রশ্ন উঠেছে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যাবে কিনা? গেল তিনটি সংসদ নির্বাচনের আগেও এ প্রশ্ন উঠেছিল। ২০০৮ এ অবশ্য প্রকাশ্যে ওতোটা নয়। সে সময় প্রায় সব আলোচনাই হয় পর্দার আড়ালে। তিনটির মধ্যে দুটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বড় হার দেখে বিএনপি। এরমধ্যে গত নির্বাচনের ফলতো দলটির জন্য অবিশ্বাস্যই। বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি কি করবে?
গত শনিবার রাতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী বৈঠকের পরই আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জোরদার হয়। ওই বৈঠক নিয়ে সমকালের রিপোর্টে বলা হয়, বিএনপিসহ সব দলকে আগামী নির্বাচনে আনতে সব ধরনের চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। আর ওই নির্বাচনে তিনশ’ আসনেই ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া হবে।
গত শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করতে হবে। বিএনপি’র সঙ্গে নির্বাচন করেই আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বিএনপিসহ সব দলকেই আগামী নির্বাচনে আনা যায় কিনা, সে বিষয়ে কৌশল গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পরে এ প্রসঙ্গে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ কেন বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যাবে? এ সময় মাহবুব-উল আলম হানিফকে তিরস্কার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে না এলেই বুঝি তোমার সুবিধা হয়! তোমার এলাকায় ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছে। তুমি নির্বাচন করলে তো তারাই হারিয়ে দেবে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘নির্দলীয় সরকার ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত একটি কথাও হবে না।’ বিএনপি’র এই অবস্থান কত দিন থাকে, এটি কতটা কথার কথা সে প্রশ্নও রয়ে গেছে। কিন্তু রাজনীতির যেকোনো ছাত্রই এটা বুঝতে পারেন, বিএনপি’র জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া সত্যিই কঠিন। ফখরুদ্দিন জমানায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিতে অনাগ্রহ ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার।
কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং দল ও জোট নেতাদের আগ্রহে তিনি শেষ পর্যন্ত ভোটে অংশ নেন। যুদ্ধাপরাধ মামলায় ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিএনপি ও জামায়াতের দুই নেতা সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে বলা হয়। ওই নির্বাচন দৃশ্যত অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল। তবে বিএনপি সংসদে সম্মানজনক আসনও পায়নি। এরপর আওয়ামী জমানায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে যায়। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিতে অনড় থাকে। রাজপথে সহিংস আন্দোলনের পরও সরকার ক্ষমতায় থেকে যায়। কারাদণ্ড, কারাভোগের কারণে খালেদা জিয়া দলটির নেতৃত্ব দিতে পারছেন না তাও সবার জানা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৃটেনে। এই অবস্থায় গত সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি বিএনপি।
গেল তিনটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি’র সিদ্ধান্ত ভুল না সঠিক ছিল তা নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। এ আলোচনা চলবে আরও দীর্ঘদিন। কী করলে কী হতো তা হলফ করে বলা কঠিন। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এরইমধ্যে আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনসহ পশ্চিমা দুনিয়ার প্রকাশ্য অবস্থান অনেকটাই স্পষ্ট। যদিও তাদের ভূমিকা নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা দুরূহ। প্রতিবেশী ভারত এবং চীন নির্বাচন নিয়ে খোলাসা করে এখনো কিছু বলেনি। কে না জানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের ভূমিকাই অন্যতম প্রধান।
বিএনপি’র এক নেতা কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘বিএনপি বার বার ভুল করলে জনগণ তা গ্রহণ করবে না। বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অত্যন্ত ভেবে-চিন্তে।’ এখন কথা হলো, তাহলে বিএনপি কি করবে? নির্বাচনে অংশ নেবে? নির্বাচন বর্জন করবে? সরকার হটানোর আন্দোলন করবে? আগেই বলেছি, এর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াই বিএনপি’র জন্য সহজ নয়। কারণ ঘর এবং বাইরের মাঠ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বিএনপি আরও অনেক সময় নেবে।
আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ আমাদের জানা। কিন্তু নির্বাচনটি কীভাবে হবে, তা অজানা। আমরা কি জানি এই নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হবে কি না? অথবা এই নির্বাচন ঠিক কোন ক্ষণে হবে? দিনে, রাতে নাকি অন্য কোনো সময়ে? এই নির্বাচন কি সবার সাধারণ চাওয়া অনুযায়ী ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য’ হবে? আমরা জনগণ তো জানিই না, সম্ভবত কেউই জানে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ