
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মাঝেও গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তারিখ উল্লেখ করার পর অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন যে, ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ তিনি এর আগে কখনো ডিসেম্বর, কখনো জুন মাসের কথা বলেছেন। এই ধারাবাহিক মতবিরোধ, তারিখে দ্বিধা এবং সময় নিয়ে সরকারের টালবাহানা—সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ এই সরকার গণতান্ত্রিক নাকি শুধু ক্ষমতা ধরে রাখার একটা উপায় খুঁজছে?
একটি গণতান্ত্রিক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত একটি নির্দিষ্ট, পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্য সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন আয়োজন। সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন জনগণের প্রত্যাশা থাকে একটি রোডম্যাপ, যার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে কোন সময়ের মধ্যে কী কী কাজ হবে এবং কখন নির্বাচন হবে। কিন্তু এই সরকার একে একে তিনটি সময় বলেছে—প্রথমে জুন, পরে ডিসেম্বর, সর্বশেষ এপ্রিল। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক রোডম্যাপ নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রকম তারিখ পাল্টানোর প্রবণতা প্রমাণ করে যে, সরকার হয়তো নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় ভুগছে, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। এ ধরণের দোদুল্যমান অবস্থান মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও অনাস্থা তৈরি করেছে।
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি এখনো দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য বা জনভিত্তিক কোনো শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। এ দলের সংগঠন দুর্বল, কর্মীসংখ্যা নগণ্য, এবং রাজনৈতিক আদর্শ অস্পষ্ট। মাঠের রাজনীতিতে তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবুও সরকার মনে করছে, এই দল ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষত বিরোধীদল বিএনপি কিংবা অন্যান্য বড় দলের অনুপস্থিতিতে।
এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপিকে প্রস্তুত হতে সময় দিতেই সরকার নির্বাচন পিছিয়ে দিচ্ছে। এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে মূলত এনসিপিকে সংগঠিত হওয়ার, মাঠে নামার এবং জনমুখী ভাবমূর্তি তৈরির একটা সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এপ্রিল মাস হলো গ্রীষ্মের সবচেয়ে তীব্র সময়। এই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ক্ষেত্রেই কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ে। মানুষ খোলা মাঠে কাজ করা তো দূরের কথা, প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতেও কষ্ট পান। এই বাস্তবতায় নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ।
ডিসেম্বর মাস হলো বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ে আবহাওয়া ঠান্ডা, উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে, স্কুল বন্ধ থাকে, মানুষ সময় নিয়ে ভোট দিতে পারে। অতীতে বেশিরভাগ নির্বাচন এই সময়েই হয়েছে, এবং সেগুলোর ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিল।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—সরকার কেন এপ্রিলের মতো প্রতিকূল সময় বেছে নিল? অনেকে মনে করছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে এমন সময় নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে যাতে ভোটার উপস্থিতি কমে যায়। এতে করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম হবে, এবং যাদের ওপর সরকার নির্ভর করছে—তাদের জিতিয়ে আনা সহজ হবে।
গরমে মানুষের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে নারী, প্রবীণ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠী গরমে রোদে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে আগ্রহী হবেন না। এর ফলে ভোটার উপস্থিতি কমবে। সরকার যদি চায় নির্বাচনের নামে একটি আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে, তবে এই কৌশল খুবই কার্যকর। গণতান্ত্রিক চেহারা বজায় থাকবে, অথচ জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হবে না।
এই পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রিত ও পূর্বনির্ধারিত রূপে পরিণত করা সম্ভব—এমনটাই আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, এটি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনার বিষয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন একাধিকবার নির্বাচন আয়োজনের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা চায়, একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও সময়মতো নির্বাচন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানও অন্তত দুবার বলেছেন যে, ১৮ মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। এতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও সময়ক্ষেপণ নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে।
এপ্রিলে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেও সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে, সরকার আদৌ নির্বাচন করবে কিনা। কারণ, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির কোনো লক্ষণ নেই। ভোটার তালিকা, ইভিএম, প্রার্থীতার নিয়ম, মনোনয়ন যাচাই, প্রচার প্রক্রিয়া—এ সবকিছুই এখনো ধোঁয়াশায়। এমনকি নির্বাচন কমিশনের সাথে কোনো পরামর্শ ছাড়াই তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সুতরাং প্রশ্নটা এখন আর কেবল ‘নির্বাচন কখন?’ নয়, বরং ‘এই সরকার আদৌ নির্বাচন চায় কিনা?’ এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধার ওপর।
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ হয় না। স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সর্বজনীন অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে সেই নির্বাচন গণতান্ত্রিক নয়। সরকার যদি সত্যিই জনগণের রায় জানতে চায়, তাহলে ডিসেম্বরেই নির্বাচন আয়োজন করে একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করাই ছিল যুক্তিযুক্ত। অন্যথায়, এই নির্বাচনও হয়ে উঠতে পারে আরেকটি বিতর্কিত অধ্যায়—যা আগামী দিনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
আপনার মতামত জানানঃ