প্রথমবারের মতো আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা অন্ধকার ও ধুলোর যবনিকা ভেদ করার দাবি করেছেন জ্যোর্তিবিদরা। ছায়াপথের মধ্যখানে থাকা কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলেছেন তারা। এর আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি।
কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা চলছে। আমাদের এই মিল্কিওয়ে ছায়াপথেও রয়েছে বিশাল কৃষ্ণগহ্বর। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সেই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি প্রকাশ করলেন জ্যোর্তিবিদেরা। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে করে তারা জানালেন, আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে দৈত্যাকার এক কৃষ্ণগহ্বরে প্রথম সরাসরি চিত্র পেয়েছেন তারা। ডোনাটের মতো দেখতে এই কৃষ্ণগহ্বরে ছবি তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষভাবে নির্মিত ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি)।
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যে কৃষ্ণগহ্বরটির ছবি তোলা হয়েছে, সেটি স্যাগিটারিয়াস এ* নামে পরিচিত। এর মহাকর্ষীয় কবল থেকে আলো বা কোনো বস্তুই বের হতে পারে না বলে এটি দেখা যায় না। কিন্তু এর ছায়া একটি উজ্জ্বল ও অস্পষ্ট আলোর বলয় এবং বস্তুর দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। এই আলো কৃষ্ণগহ্বরে নিমজ্জিত হওয়ার আগে বিশেষ বলয় তৈরি করে।
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) মূলত আটটি রেডিও টেলিস্কোপের একটি নেটওয়ার্ক। এর আগে ২০১৯ সালে মেসিয়ার ৮৭ নামের একটি ছায়াপথে থাকা একটি কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছিল এটি।
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিদ এবং ইএইচটি বিজ্ঞান কাউন্সিলের সহসভাপতি সেরা মার্কফ বলেন, মিল্কিওয়ের কৃষগহ্বর আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল। এটাই আমাদের কাছাকাছি থাকা বিশাল কৃষ্ণগহ্বর। এ কারণেই একে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। প্রায় শতবর্ষ ধরেই এর অনুসন্ধান চলেছে। তাই বৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে এর খোঁজ পাওয়া বিশাল ব্যাপার।
আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে যে বিশাল কৃষ্ণগহ্বর আছে, তা নিয়ে জ্যোর্তিবিদদের এত দিনের ধারণা এই ছবির মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো কিছু গবেষক বোসন নক্ষত্র বা অন্য গুপ্ত বস্তুর সম্ভাবনা নিয়ে তাদের সন্দেহের কথা বলছেন।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক ও ইএচটির সদস্য জিরি ইউনসি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি বিষয়টি জেনে আনন্দিত যে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে নিশ্চিত একটি কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে। এটি একটি অশান্ত, বিশৃঙ্খল এবং বিক্ষিপ্ত পরিবেশ। এটি আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে ছায়াপথের প্রান্তে বসবাস করার জন্য আমরা বেশ ভাগ্যবান।’
আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে যে বিশাল কৃষ্ণগহ্বর আছে, তা নিয়ে জ্যোর্তিবিদদের এত দিনের ধারণা এই ছবির মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো কিছু গবেষক বোসন নক্ষত্র বা অন্য গুপ্ত বস্তুর সম্ভাবনা নিয়ে তাদের সন্দেহের কথা বলছেন।
ইউনসি বলেন, ‘এটা অনেকটা মেসিয়ার ৮৭ নামের একটি ছায়াপথের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু সেটি সাড়ে পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। কিন্তু নতুন পর্যবেক্ষণ আমাদের নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিচ্ছে। এটা আমাদের ছায়াপথে থাকা কৃষ্ণগহ্বর।’
একে ডোনাটের সঙ্গে তুলনা করে ইউনসি বলেন, ‘এটা আরেকটি ডোনাট। তবে সেটি আমাদের ডোনাট।’
অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্সে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাসংক্রান্ত নিবন্ধ।
গবেষকেরা বলছেন, আমাদের ছায়াপথে থাকা স্যাগিটারিয়াস এ* নামের কৃষ্ণগহ্বরটি ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। জ্যোতির্বিদ্যার হিসাবে এটি স্থানীয় হলেও একে শনাক্ত করা সহজ ছিল না। ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন মহাদেশ থেকে পরিষ্কার আকাশে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে তবেই একে শনাক্ত করা গেছে। তবে মেসিয়ার ৮৭* এর তুলনায় এটি অনেক ছোট। এর চারপাশে থাকা গ্যাস ও ধুলা একে আবর্তন করছে। ফলে এর ছবি ক্রমাগত পরবির্তন হতে থাকে বলে একে শনাক্ত করা কঠিন ছিল।
ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপ নামের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প ছবিটি তুলেছে। প্রকল্পটি পরিচালনা করছেন তিন শতাধিক বিজ্ঞানী ও ১৩টি ইনস্টিটিউট।
গবেষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে আমাদের নিজস্ব ব্ল্যাকহোলের প্রকৃতি সম্পর্কে আকর্ষণীয় ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি এখনো সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। যদি এতে কোনো বড় নক্ষত্র পড়ে যায়, তবে তা কিছু সময়ের জন্য আবার জেগে উঠতে পারে।
বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্যারল মান্ডেল বলেন, ‘মহাবিশ্বের গঠন ও বিবর্তন ঘিরে এটি উন্মুক্ত প্রশ্ন। ছায়াপথ নাকি কৃষ্ণগহ্বর কোনটি আগে এসেছে তা আমরা জানি না। এ ধরনের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ হবে।’
ছায়াপথের কেন্দ্রে বিশাল কৃষ্ণগহ্বর থাকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই ছবিটি। এর আগে মূলধারার জ্যোতির্বিজ্ঞানে এমন একটি অনুমান নিয়ে কাজ চলছিল। কিন্তু সেখানে অন্য কোনো অদ্ভুত বস্তু থাকতে পারে বলেও ধারণা করা হয়েছিল।
এবার সব জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে দিয়ে কৃষ্ণগহ্বর থাকারই প্রমাণ দিলেন বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিদ ড. জিরি ইউনুসি বলেন, আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি কৃষ্ণগহ্বর আছে। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় আমার ভালো লাগছে। এটির পরিবেশ খুবই উত্তাল, নৈরাজ্যপূর্ণ ও সহিংস। সত্যিকার অর্থে ছায়াপথের প্রান্তে বসবাস করায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
এখানে দেওয়া ছবিতে যা দেখা যায় তা হচ্ছে মাঝখানে একটি অন্ধকার অঞ্চল। সেখানেই কৃষ্ণগহ্বরটির অবস্থান।
এর চারপাশে রয়েছে অতি উত্তপ্ত গ্যাস থেকে তৈরি আলোর গোলক।
মাত্রা বোঝানোর জন্য বললে কালো বৃত্তটির আকার মোটামুটি আমাদের নক্ষত্র সূর্যের চারপাশে বুধগ্রহের কক্ষপথের সমান। এর বিস্তার প্রায় চার কোটি মাইল।
সৌভাগ্যবশত, এই দানবাকৃতির গহ্বরটি বহুদূরে- প্রায় ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বে। তাই আমাদের পৃথিবীর কখনোই অন্তত এর দিক থেকে বিপদ আসার কোনো আশঙ্কা নেই।
আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার মাইল বেগে চলে। সেই গতিতে টানা এক বছর চলার পর যতদূর যাওয়া যায় তা-ই এক আলোকবর্ষ।
প্রসঙ্গত, কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল হচ্ছে মহাকাশের সেই অংশ, যেখানে মহাকর্ষ শক্তি এত প্রবল যে কিছুই সেখান থেকে বের হতে পারে না। এমনকি আলোও না। কিছু বৃহৎ তারকার ধ্বংস থেকে কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয়। কিভাবে এটি হয় তা এখনো স্পষ্ট না। তবে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে নিশ্চিত যে কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশে শক্তির সঞ্চার করে এবং এর বিবর্তনে প্রভাব ফেলে।
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) সহযোগিতা নামে একটি আন্তর্জাতিক দল দীর্ঘ সময় ও শ্রমসাপেক্ষ ছবিটি তৈরি করেছে।
২০১৯ সালে মেসিয়ার ৮৭ বা এম৮৭ নামের আরেকটি ছায়াপথের (গ্যালাক্সি) কেন্দ্রে বিশালাকার কৃষ্ণগহ্বরের একটি ছবি প্রকাশ করার পর এটি তাদের দ্বিতীয় এই ধরনের ছবি। সেই বস্তুটি ছিল এক হাজার গুণেরও বেশি বড়, যার ভর আমাদের সূর্যের সাড়ে ছয় শ কোটি গুণ।
‘কিন্তু এই নতুন চিত্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি আমাদের একান্ত নিজের সুবিশাল কৃষ্ণগহ্বর’, বলেছেন অধ্যাপক হেইনো ফাল্কে। ইএইচটি প্রকল্পের পেছনে প্রধান ইউরোপীয় গবেষকদের অন্যতম তিনি।
নেদারল্যান্ডসের রাডবুড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হেইনো ফাল্কে বলেন, ‘এটি যেন একেবারে আমাদের বাড়ির উঠোনে। কৃষ্ণগহ্বর ও এর কাজ ভালো করে বুঝতে চাইলে এটিই আপনাকে সাহায্য করবে। কারণ আমরা তা অতি বিশদভাবে দেখতে পাচ্ছি। ’
পৃথিবী থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বে অবস্থিত কৃষ্ণগহ্বর স্যাগিটারিয়াস এ* সংক্ষেপে (এসজিআর এ*) আকাশে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক কণার মতো। এই ধরনের লক্ষ্যবস্তুর অস্তিত্ব বোঝার জন্য অবিশ্বাস্য মাত্রার রেজল্যুশনের টেলিস্কোপের প্রয়োজন।
ইএইচটি কাজটা করেছে একটি বিশেষ কৌশলে, যার নাম ‘ভেরি লং বেসলাইন অ্যারে ইন্টারফেরোমেট্রি’ (ভিএলবিআই)।
এ পদ্ধতিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে থাকা আটটি শক্তিশালী রেডিও অ্যান্টেনার একটি নেটওয়ার্ককে এক করে কার্যত গোটা পৃথিবীর সমান একটি টেলিস্কোপ তৈরি করা হয়েছে। এই বিন্যাসটির মাধ্যমে ইএইচটি আকাশের এমন একটি সূক্ষ্ম কোণ তৈরি করতে সক্ষম, যা মাইক্রো-আর্কসেকেন্ডে পরিমাপ করতে হয়। তাদের টেলিস্কোপের দৃষ্টি এত শক্তিশালী যে চাঁদের বুকে একটি বার্গার রাখা হলে তা-ও দেখতে সক্ষম।
তারপরেও সংগৃহীত বেশ কয়েক পেটাবাইট (১ পিবি সমান দশ লাখ গিগাবাইট) ডাটা থেকে একটি চিত্র তৈরি করতে পারমাণবিক ঘড়ি, স্মার্ট অ্যালগরিদম এবং অগণিত ঘণ্টার সুপারকম্পিউটিং দরকার হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৩
আপনার মতামত জানানঃ